ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ভোটের-কথা

কোন্দলে পুড়েও ইকবালুরই ভরসা দিনাজপুর সদরে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৩ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৭
কোন্দলে পুড়েও ইকবালুরই ভরসা দিনাজপুর সদরে অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার ও ইকবালুর রহিম

দিনাজপুর থেকে: প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার ও হুইপ ইকবালুর রহিমের দ্বন্দ্বটা বেশ প্রকাশ্য। জেলা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যেও তাই বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘ষড়যন্ত্র’ করে স্বদলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়ার এন্তার অভিযোগও আছে।

নিজেদের মধ্যে দলাদলির এমন নেতিবাচক চর্চায় লাগাম পরাতে না পারলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দিনাজপুরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে পস্তাতে হতে পারে বলে আশঙ্কা জেগেছে তৃণমূলে।

মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং দিনাজপুর-৫ (ফুলবাড়ী ও পার্বতীপুর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য।

১৯৮৪ সাল থেকে শুরু করে সব সংসদ নির্বাচনেই তিনি নির্বাচত হয়ে আসছেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে জিতে প্রথমে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ও পরে ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ এর নির্বাচনে জিতে দায়িত্ব নেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

আর দিনাজপুর-৩ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সক্রিয় অংশ নেন ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। তিনিই গড়েন অনুর্দ্ধ ২৭ বছর বয়সে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রথম নজির। হিজড়াদের জন্য মানব পল্লী ও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলে ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ ফেডারেশন (ডাব্লিউএলএফ) পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম ও মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম জোনের জোনাল চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রহিমের ছেলে ইকবালুর রহিম বর্তমানে পালন করছেন জাতীয় সংসদের হুইপের দায়িত্ব।

তাদের দ্বন্দ্বটা বেশি প্রকাশ্য হলেও এমন বিরোধে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক আজিজুল ইমাম চৌধুরীর (খাটকু চৌধুরী) নামও আসে। এদের কেউ মন্ত্রী ফিজারের পছন্দের, তো কেউ হুইপ ইকবালুর রহিমের পছন্দের।

তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নির্বাচনী আসন আলাদা হলেও তাদের দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে আছে পুরো জেলা জুড়েই। পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে একজনের পছন্দের প্রার্থী দাঁড়ালে সেখানে আরেকজনের বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে।

সদরের সংসদীয় আসনে টানা দুই দফায় নৌকার প্রার্থী জিতে যাওয়ার পরও বিগত দিনাজপুর পৌরসভা নির্বাচনে (২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর) আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী হুইপ সমর্থিত আনোয়ারুল ইসলামের পরাজয়ের পেছনে এই দ্বন্দ্বকেই দায়ী করা হয়।

সদরসহ জেলার বেশ কিছু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলের জেরে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীকে ‘জিতিয়ে’ দেওয়ার নজির রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে হয় নৌকার পক্ষে নিষ্ক্রিয়তা দেখানো হয়, অথবা হয় ভোট সমঝোতা।

দলের নেতৃস্থানীয়দের এমন বিরোধে শঙ্কিত আওয়ামী লীগের সদর আসনের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। তারা মনে করছেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে এ আসনে দলীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রার্থী দিতে না পারলে সদর পৌরসভা নির্বাচনের মতোই ফল জুটে যেতে পারে। আর একটি আসনের বিরোধ স্পষ্ট হয়ে পড়লে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে জেলার ছয়টি আসনেই, যার সবক’টিই এখন ক্ষমতাসীন দলের দখলে।

শেখপুরা ইউনিয়ন, রাজবাড়ীর বটতলী, জেল মোড়সহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে স্থানীয় রাজনীতি-সচেতন ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্টমুখ বর্তমান এমপি ইকবালুর রহিম। তিনি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার স্নেহভাজনদের একজন বলেও চাউর আছে তৃণমূলে। দিনাজপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম।  ছবি: হুসাইন আজাদ

তার বাইরে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রীর একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) মির্জা আশফাকও রয়েছেন

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায়। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইমাম চৌধুরী অবশ্য জেলা পরিষদ প্রশাসক হওয়ায় (২০১৬ সালের ডিসেম্বর) আগের নির্বাচনে (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি) নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বদলে টিকিট পেয়েছিলেন ইকবালুর রহিম। এবার আর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিয়ে আলাপে আজিজুলের নাম শোনা যাচ্ছে না।

রাজবাড়ীর বটতলী মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল আবু বকর সবুজ নামে এক তরুণের সঙ্গে। স্নাতকোত্তর সবুজ মনে করেন, হুইপ ইকবালুর রহিমের চেয়ে বড় প্রোফাইলধারী সদর আসনে আপাতত কেউ নেই। তার বৃদ্ধাশ্রম গড়া, তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে কাজসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তরুণদের আগ্রহী করে তুলেছে।

শেখপুরা ইউনিয়নের হোসেনপুরের মুক্তার মিয়া সদরে আওয়ামী লীগের নেতা বলতে হুইপকেই চেনেন। তার মতে, অপরিচিত  কেউ  ভোটে দাঁড়ালে ভোটাররা বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে আসন্ন নির্বাচনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়ার আগে থেকেই ইকবালুর রহিম ও তার নেতাকর্মীরা জনসংযোগমূলক সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্দেশনা পাওয়ার পর তাদের সে কার্যক্রম গেছে আরও বেড়ে।

আলাপ হচ্ছিল হুইপ ইকবালুর রহিমের বিশ্বস্ত বলে পরিচিত দিনাজপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, নৌকার লোকেরা সবসময়ই মাঠে থাকে। নির্বাচনের ইঙ্গিত আসার পর মাঠপর্যায়কে আরও সুসংগঠিত করে জনগণের দ্বারে দ্বারে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হচ্ছে।

মনোনয়ন ইস্যুতে আনোয়ারুল বলেন, জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ইকবালুর রহিমের বিকল্প এ আসনে নেই। যতই মতবিভেদ থাকুক, তৃণমূলে নৌকার ভরসা ইকবালুর রহিমই।

মনোনয়নপ্রত্যাশী মির্জা আশফাক বাংলানিউজকে জানান, তিনি ১৯৭৯ সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে পদার্পণ করে নানাপদে দায়িত্ব পালন করে এখন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন।

সদর আসনে মনোনয়নপ্রাপ্তিতে নিজেকে যোগ্যতর দাবি করে মির্জা আশফাক বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে এ আসনে মনোনয়ন চেয়ে আসছি। এবারও চাইবো।

১৯৯৬ ও ২০০১ এর নির্বাচনে বাবা আবদুর রহিম বিএনপির প্রার্থী খুরশীদ জাহান হকের (চকলেট আপা) কাছে হেরে গেলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ওই জোটের প্রার্থী শফিউল আলম প্রধানকে হারিয়ে দিনাজপুর সদর আসন নৌকাকে উপহার দেন ইকবালুর রহিম। এই অর্জন তিনি ধরে রাখেন ২০১৪ সালের নির্বাচনেও। এবার তিনি হ্যাটট্রিক বিজয় উপহার দিতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই আসনকেন্দ্রিক বিরোধ মীমাংসা করবে কিনা। নইলে স্থানীয় নির্বাচনের মতো তিক্ত ফল পাওয়া অসম্ভব নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩১ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৭
এইচএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।