ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বাঁশ ছাড়া বাঁচে না পাহাড়িরা

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
বাঁশ ছাড়া বাঁচে না পাহাড়িরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে: বাঁশ ছাড়া বাঁচে না পাহাড়িরা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই বাঁশের চক্রেই বাঁধা তাদের জীবন।

কখনো এই বাঁশ তাদের জীবিকার অবলম্বন, কখনোবা প্রার্থনার নৈবেদ্য। পাহাড়ের আর কোনো বৃক্ষ বুঝি এমন ওতপ্রোতভাবে তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেই।

বাঁশ দিয়ে তারা ঘর বানায়। বাঁশের খুঁটির ওপর গড়া বাঁশেরই প্ল্যাটফর্মে বাঁশের বেড়ার ওপরে বাঁশপাতার ছাউনি বসায় বাঁশেরই আড়ায়। এমনকি রাজবাড়িও তৈরি হয় বাঁশ দিয়েই।

ঘরে ওঠার মইটাও ওই বাঁশেরই। জন্মের পর শিশুকে দোল দেওয়া হয় বাঁশের দোলনায়। বাঁশের বেড়ার ফাঁকেই উঁকি মারে কৌতুহলী শৈশব-কৈশোর। মৃত্যুর পর তাদের শবদেহ এই বাঁশ দিয়েই জ্বালানো হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশই সঙ্গী তাদের।

সহজে পরিষ্কার করা যায় বলে জুম চাষের জন্য বেছে নেওয়া হয় বাঁশবন। তারপর সেই জমিতে বাঁশ পুড়িয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয় বাঁশের ছাই। বুনো পশুর কবল থেকে রক্ষায় জুম ক্ষেত ঘিরে দিতেও ব্যবহার করা হয় বাঁশেরই বেড়া।

বাঁশের মাচায় চাষ হয় লাউসহ সব লতানো সবজি। বাঁশের ঝুড়িতে পালা হয় মুরগি। বাঁশের ঝাঁপিতেই সংগ্রহ করা হয় জুমের ফসল। বিক্রির জন্য বাঁশের পাটাতনেই জমানো হয় পাহাড়ি ফল আর পণ্যের পসরা। গো খাদ্য হিসেবে জুড়ি নেই বাঁশপাতার।

বাঁশের চোঙায় পানি আনে পাহাড়িরা। সেই পানি পানের জন্য তৈরি করে বাঁশেরই চোঙ পেয়ালা। বাঁশের সরু বাতা বা পাত দিয়ে বোনে ঘুমাবার মাদুর। মাথা রাখার বালিশও বানানো হয় বাঁশ দিয়ে। উৎসব-পার্বনে বাঁশ দিয়ে তৈরি তাদের বাঁশির সুর প্রতিধ্বনি তোলে পাহাড়ে পাহাড়ে।

আরও ছবি দেখতে ক্লিক করুন...

পুরো বর্ষকালে বাঁশের কচি ও রসালো ডগা রান্নার রোল পড়ে পাহাড়ি পাড়ায় পাড়ায়। বাঁশের ভেতরই নানা পদের খাবার রান্না হয় বাঁশেরই কঞ্চি জ্বালিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের কাছেও এখন এই বাঁশকোড়লের সুস্বাদু খাবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাহাড়ি জনপদে ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ব্যাম্বো চিকেন।

বাঁশ দিয়ে মেয়েদের কাপড় বোনার যন্ত্রপাতি তৈরি করে পাহাড়িরা। নানা ধরনের ঝুড়ি আর মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে। ধূমপানের জন্য বাঁশ দিয়েই তৈরি হয় সুন্দর পাইপ। বাঁশ পুড়িয়ে ছাই থেকে হয় পটাশ বা ক্ষার। এমনকি বাঁশ দিয়ে দুর্গও তৈরি করে পাহাড়িরা।  

ঝড়ো হাওয়া প্রতিরোধের পাশাপ‍াশি ভূমি ক্ষয়ও রোধ করে বাঁশঝাড়। বর্ষাকালে পাহাড়ি নদীগুলো খরস্রোতা হয়ে উঠলে এই বাঁশ দিয়েই তৈরি হয় পারাবারের সেতু।

বাঁশের সাহায্যে পূজারও আয়োজন করে ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। বাঁশকে তারা মনে করে বন দেবতার প্রতিনিধি বা প্রতীক। বিভিন্ন ধর্মীয় আর সামাজিক উৎসবের মঞ্চও বানানো হয় বাঁশেরই কাঠামোতে। প্রবারণা পূর্ণিমায় বাঁশের কাঠামোতে রঙিন কাগজ বা কাপড় সেঁটে ফানুস ওড়ায় পাহাড়িরা।

উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় এই বাঁশই কাগজ তৈরির অন্যতম উপাদান। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঁশের ওপর নির্ভর করেই চন্দ্রঘোনায় গড়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজ কল কর্ণফুলী পেপার মিলস।

কার্যত এই বাঁশ ফাঁপা কাণ্ড বিশিষ্ট ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। সারা দেশেই কমবেশি বাঁশের চাষ হয়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমি বাঁশ চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এ এলাকায় প্রাকৃতিক বাঁশবনের পাশাপাশি পাহাড়ের পর পাহাড়ে বিস্তৃত সৃজিত বাঁশবনও চোখে পড়ে। বর্ষাকালে নদী পথে উজান থেকে বাঁশের ভেলা ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয় ভাটির বাজারে। সব মিলিয়ে ১১ প্রজাতির বাঁশের দেখা মেলে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি আর বান্দরবানের পাহাড়-সমতলে।

এগুলোর মধ্যে বেড়া, ঘরের চাল, ঝুড়িসহ সব কাজে ব্যাপক ব্যবহার হয় পইয়া, ওরা ও  মৃতিংগা ও তুরাস বাঁশ। ডলু বাঁশে তৈরি হয় মাদুর। দুধ বা পানি রাখার পাত্র, হুক্কা ও পান পাত্র ভালো হয় বুদুম বাঁশে। নয়ন সুখ বাঁশে হয় পানীয় পানের কাপ বা পেয়ালা। ছায়া ও সৌন্দর্যের জন্য ব্যবহার হয় বুরিয়ালি বাঁশ। কাজে লাগে ঘরের খুঁটি আর চালেও। তবে লুদি বাঁশে ঝুড়ি ছাড়া অন্য কিছু তৈরি হয় না। আর কুলাই বাঁশের চাহিদা তুলনামূলক কম। ছোট বলে কম কাজে লাগে কাটা বারিয়াও।

বাঁশের নতুন কুঁড়ি গজায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে। বহু বছর পর পর বাঁশে ফুল হয়। আর জমকালো ফুল ধারণের পর মৃত্যু হয় বাঁশের।

পাহাড় ছাড়াও বাংলাদেশের গৃহ অর্থনীতিতে এই বাঁশ অতিব গুরুত্বপূর্ণ। গৃহস্থালির কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের কারণে বাঁশকে বলা হয দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারুবৃক্ষ। সারাদেশেই নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরিতে এর ব্যবহার ব্যাপক চোখে পড়ে। হালে তো শিল্পের অন্যতম জনপ্রিয় এক ধারাও হয়ে উঠেছে বাঁশ শিল্প।

** ক্ষমা করো রূপমুহুরী

** গিরিখাদ পেরিয়ে রহস্যময় আলীর সুড়ঙ্গে

** সবচেয়ে উঁচু রাস্তায় হাতের মুঠোয় প্রাণ
** পায়ের নিচে ছবির মতো বলি পাড়া
** পাহাড়ের উপরে দেবতার পুকুর 
** পাহাড়ের খাদে রাম-সীতার ধুমনিঘাটে
** বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
** বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে
** বয়সী বটের নিচে বিশ্বাসের বাসা

** গিরিখাদের হাজারছড়ায় সীমাহীন বিস্ময়

** দুর্গম বন-পাহাড়ের সুন্দর ঝরনায়
** আলীর রহস্য গুহা আর আলীকদমের যতো কথা

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
জেডএম/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ