ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আগরতলা

জঙ্গল থেকে ‘জৈবগ্রাম’ ত্রিপুরার মেঘলীপাড়া

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৭
জঙ্গল থেকে ‘জৈবগ্রাম’ ত্রিপুরার মেঘলীপাড়া গোবর থেকে তৈরি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। ছবি: শুভ্রনীল

আগরতলা, ত্রিপুরা: আগরতলা শহর থেকে কিলোমিটার সাতেক এগোলেই খয়েরপাড়া। পূর্বে মোড় নিয়ে আরও তিন-চার কিলোমিটার আঁকাবাঁকা ছবির মতো সুন্দর পথ মাড়িয়ে ত্রিপুরার প্রথম ‘জৈবগ্রাম’মেঘলীপাড়া।

গ্রামের শুরুতে টিলায় মোড়া সবুজ সুন্দর চা বাগানের মতো এখানকার মানুষগুলোও সুন্দর মনের।

গ্রামের ১ হাজার ৭ পরিবার তাদের উৎপাদিত কোনো পণ্যে ব্যবহার করে না কোনো ধরনের কেমিক্যাল।

সরকারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে চেষ্টা করছে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে। একই সঙ্গে নিজেরা অর্গ্যানিক খাবার গ্রহণ ও অন্যকে নির্ভেজাল স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করে গ্রামটি আজ গোটা ত্রিপুরার রোলমডেল। আগে ছিলো জঙ্গল।  এখন অর্গ্যানিক সবজি ক্ষেত্রের সবুজ গ্রাম।  ছবি: শুভ্রনীল- বাংলানিউজ
আর দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার প্রত্যয় থেকে এই কাজটি এগিয়ে নিচ্ছেন রাজ্য সরকারের ডেপুটি স্পিকার পবিত্র কর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী বিজিতা নাথ এবং বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার অঞ্জন সেনগুপ্ত।

গ্রামটি ডেপুটি স্পিকারের নির্বাচনী এলাকায়। ১৪শ হেক্টরের গ্রামের ৭শ হেক্টর জায়গাজুড়ে চা বাগান। বাংলাদেশের মানচিত্রের পেটে ঢুকে থাকা ভারতের বন্ধুপ্রতীম এ রাজ্যের চা বাগানটির সঙ্গে অনেক মিল, সিলেট, শ্রীমঙ্গলের বাগানগুলোর। মুগ্ধতা ছড়ানো বাগানের বুক চিরে পিচঢালা সড়কটির মতো পুরো গ্রামের সড়ক। আদর্শ এ গ্রাম দেখতে গিয়ে ডেপুটি স্পিকার ও জৈবগ্রামের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা অঞ্জন সেনগুপ্তকে পাওয়া গেলো সেখানে। নিয়মিত কাজের অগ্রগতি ও খোঁজ-খবর নিতে আসনে তারা। গরু পালন। ছবি: শুভ্রনীল-বাংলানিউজ
নিমাই দেবনাথের এখন পাকা বাড়ি। রয়েছে পাঁচটি গরু। দুটি আবার দুধ দিচ্ছে। গোয়ালের পাশে ৭-৮ ফুট লম্বা বাড়ন্ত লকলকে নেপিয়ার ঘাস। পাশে থোকায় থোকায় ঝুলছে ডালিম। ৬০-৭০টি রাবার গাছ থেকে এখনও কস আহরণ শুরু হয়নি। গ্রাম পঞ্চায়েতের ডেইরিতে দুধ বিক্রি করে আর অর্গ্যানিক সবজি চাষে দারুণ সফল তিনি।
 
গ্রামের ১০০ জন কৃষককে নিয়ে জৈবসার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন শুরু করে রাজ্য সরকারের বায়োটেক বিষয়ক প্রকল্পের মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত হয় কোনো কেমিক্যাল বা কীটনাশক ব্যবহার করবে না চাষিরা। ফসল তুলনামূলক কম হলেও সফল হন ১০০ জন কৃষক। তারপর কেমিক্যাল এড়িয়ে এগিয়ে চলা। বলছিলেন গ্রামে যাকে সবাই দেবতার মতো শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন সেই পবিত্র কর। গোয়ালের পাশেই নেপিয়ার ঘাসের চাষ। ছবি: শুভ্রনীল- বাংলানিউজ
কেমিক্যাল সার ও কীটনাশকের বিপক্ষে যুদ্ধ অনেক আগে থেকেই বিশ্বে শুরু হয়েছে জানিয়ে অঞ্জন বলছিলেন, শুধু ত্রিপুরায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ৩২ হাজার। এখন চতুর্থ জেনারেশনের যে কীটনাশক ব্যবহার চলছে তা পোকার নার্ভাস সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একইভাবে মানুষেরও। এসব কথা চিন্তা করেই ত্রিপুরায় প্রথম অর্গ্যানিক ফার্মিং শুরু হয়। পূর্ব ভারতে এখানেই প্রথম। বায়োটেক কীট ব্যবহারে একসময় রাজ্যসরকার রাজি হয়। এখান থেকেই পরে চিন্তা আসে জৈবগ্রাম বিষয়ে। পুরনো ট্রাডিশন ফিরিয়ে আনবো নতুন বায়োটেক ইনোভেশনে। সেটা সফলতার দিকে। কাজ এখনও বাকি। দুধের খাদ্যগুণ পরীক্ষার যন্ত্র। ছবি: শুভ্রনীল-বাংলানিউজ
জৈবগ্রামের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন দেখা গেলো ধান, সবজির উৎপাদন একটা পর্য়ায়ে গিয়ে আর বাড়ছে না। কেমিক্যাল মাটি নষ্ট করে দিচ্ছে। উৎপাদিত ফসল খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগে। তখন কেমিক্যাল মুক্ত গ্রামের চিন্তা আসে। যেখানে সব সবজি উৎপাদিত হবে জৈবসারে, কেমিক্যাল ছাড়া। প্রথমে উৎপাদন কম থাকলেও কেমিক্যালযুক্ত মাটি ধুয়ে যাওয়ায় উৎপাদন ক্রমে বাড়ছে। আর বাজারে এসব সবজি বেশি দাম দিয়ে কিনে খাচ্ছে আগরতলাবাসী।

পবিত্র কর বলেন, খাঁটি দুধের চাহিদা থাকায় একটি ডেইরি ফার্মও করা হয়েছে। যেখানে মান নিয়ন্ত্রক যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে দুধ বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন ৩০-৪০ লিটার দুধ আসতো প্রথম দিকে। প্রতিদিন এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ লিটারে। তাদের মাসিক আয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার টাকা। ভালো, খাঁটি জিনিসের চাহিদা বাড়ায় এভাবে গ্রামের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা আরও বাড়ছে। দুই ভাই কলেজে পড়ে।  এরই ফাঁকে পরিবারের চাষে সহায়তা। ছবি:শুভ্রনীল- বাংলানিউজ
 নারীদের কর্মক্ষম করার জন্য ১০টি গ্রুপে ভাগ করে মাশরুম চাষ করানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

লক্ষণ ভৌমিকের বাড়ি গিয়ে দেখা গেলো গোবর কাজে লাগাতে তৈরি বায়োগ্যাস ইউনিট। ৩০ কেজি গোবরে আড়াই ঘণ্টার গ্যাস সরবরাহ হয়। যা কমাচ্ছে জ্বালানি নির্ভরতা। অবশিষ্ট তরল সার হিসেবে ঘাস উৎপাদন করা হয়। যা গরুর প্রধান খাদ্য।

মেঘলীপাড়া পঞ্চায়েত প্রধান গোপীকান্ত দেবনাথ বলেন,আগে জঙ্গলের কাঠ কেটে আগুনে সেঁকে আগরতলায় বিক্রি করে তবে খাবারের চাল জুটতো। একবেলা খেতো। এখন তাদের সেই অবস্থা নেই। ডেইরি এতো এগিয়েছে যে দুধ নিতে অটোতে আর হবে না, ট্রাক লাগবে।
অর্গ্যানিক পদ্ধতিতে ফলানো সবজি। ছবি: শুভ্রনীল- বাংলানিউজ
 সব মিলিয়ে জৈবগ্রামের মানুষ এখন সুখী, স্বাবলম্বী, শিক্ষিত। প্রযুক্তি এই গ্রামকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আদিম পদ্ধতির কাছে। যা পিছনে এখন ছোটা শুরু করেছে গোটা ত্রিপুরা। গ্রামের মানুষকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারলে রাজ্যের প্রতিটি গ্রাম হবে মেঘলীপাড়ার মতো। হবে শতভাগ কেমিক্যাল মুক্ত। এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।

** ট্যুরিস্টদের কাছে আকর্ষণীয় করা হচ্ছে আখাউড়া বর্ডার
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।