ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

দেখে এলাম সবুজে ঘেরা নীল সাগর

আসাদ জামান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৪
দেখে এলাম সবুজে ঘেরা নীল সাগর ছবি: দেলোয়ার হোসেন বাদল / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নীলফামারী থেকে ফিরে: স্বর্গ ও মর্তে্যর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এই যে, স্বর্গে সব চাওয়া মুহূর্তের মধ্যে পূরণ হয়ে যায়, আর মর্তে্যর বেশিরভাগ চাওয়া থাকে অপূর্ণ। কিন্তু ইদানিং দেখছি, আমার বেশিরভাগ চাওয়াই পূরণ হয়ে যাচ্ছে।


 
পেশাগত কারণে মাঝে-মধ্যেই শহরের কোলাহল ছেড়ে দূর বহুদূরে মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ মিলছে। এ সুযোগে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্নসম্পদসহ দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নিচ্ছি। এই তো সেদিন পঞ্চগড়ের মহারাজের দিঘি দেখে এলাম।
 
এবারও যখন নীলফামারী যাওয়ার সুযোগ মিলল, তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, ওখানকার প্রত্ন নিদর্শন নীল সাগরটা দেখেই ফিরবো।
 
২১ অক্টোবর সারাদিন বাস ভ্রমণ শেষে রাত নয়টার দিকে নীলফামারী পৌঁছেই পরের দিনের কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করে ফেললাম। বলা বাহুল্য এই কর্ম পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পেল নীল সাগর পরিদর্শন।
 
২২ অক্টোবর সকালে অফিসিয়াল কাজ শেষ করে ঠিক ভর দুপুরে নীলফামারী শহর থেকে রওনা হলাম নীল সাগরের উদ্দেশ্যে।
 
দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতের বুক চিরে বয়ে চলা পিচঢালা রাস্তায় মোটরবাইকে আধা ঘণ্টা ভ্রমণের পর দুপুর দেড়টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।  
 
স্বর্গের বর্ণনায় জেনেছি- সেখানে প্রচুর বৃক্ষ, পাখ-পাখালি, ফল-ফলাদি, মৎস্যরাজি, সবুজের সমারোহ, পাখির কলতান, ঝর্ণাধারা, সুপেয় পানির প্রবাহমান নদী আরো কতো কি! বলতে গেলে নীল সাগরে এর সবই আছে।
 
নীল সাগর নিয়ে কথা বলার আগে এর জন্ম ইতিহাস একবার জেনে নেওয়া যাক। জনশ্রুতি অনুযায়ী, অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা ক্ষিবরাজ তার অগণিত গরু-মহিষের পানির চাহিদা পূরণের জন্য ৫৪ একর জমির ওপর একটি দিঘি খনন করেন। অত:পর নিজ কন্যা বিন্নবতীর নামানুসারে দিঘিটির নাম রাখেন ‘বিন্নিদিঘি’।
 
এরপর ১৯৭৮ সালে তৎকালীন নীলফামারী মহকুমা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মতিতে ‘বিন্নিদিঘি’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নীল সাগর।
 
বর্তমানে এর অবস্থান নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজার ভবানীগঞ্জ গ্রামে।
 
নীল সাগরের তথ্য ভাণ্ডার খুঁজে জানা গেছে, ৫৩.৯০ একর দিঘির ৩২.৭০ একর জুড়ে রয়েছে পুকুর, ৮.৭০ একর উত্তর-পূর্ব পাড়, ০. ৫৪ একর পশ্চিম পাড় এবং ১১.৯৬ একর দক্ষিণ পাড়। নীলফামারী জেলা শহরের জিরো পয়েন্ট চৌরঙ্গী মোড় থেকে এর দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার।
 
দেশের পুরোনো সব স্থাপনা ও প্রত্ন নিদর্শনের মতো নীল সাগর নিয়েও মজার কিছু মিথ প্রচলতি আছে। দর্শনার্থী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে সংস্কারের সময় দিঘির তলদেশে স্বর্ণ, রৌপ্য ও কষ্টিপাথরের মূর্তি মেলে। মাটির তলদেশে মেলে মন্দিরের অস্তিত্ব। কিন্তু মন্দিরের দরজায় বিশাল আকৃতির দু’টি মাছ পাহারায় থাকায় ডুবুরিরা নাকি ভেতরে ঢুকতে পারেননি। তবে ২১ বছর আগের এ ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেল না। সবাই কারও না কারও মুখে শুনেছেন, চোখে দেখেননি।
 
তবে কল্পকাহিনী ঘেরা এ নীল সাগরের পাড়ে প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে আয়োজন করা হয় বারুনী স্নান মেলা। মেলায় থাকে মানুষের উপচেপড়া ভিড়।
 
নীলফামারী তো বটেই, আশপাশের জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এ মেলায় হাজির হন বিপুল সংখ্যক লোক।
 
জনশ্রুতি আছে, সংস্কারের কাজে এক সময় নাকি পানি সেচার কাজে অনেকগুলো মেশিন বসানো হয়েছিল। টানা কয়েকদিন চেষ্টা করেও পানির উচ্চতার কোনো তারতম্য হয়নি।
 
অতীতে নাকি গ্রামের লোকজন বিন্নিদিঘির জলে গাভীর প্রথম দুধ উৎসর্গ করতেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা ঘূর্ণায়মান অবস্থায় দিঘির মাঝখানে চলে যেত। গ্রামবাসীর বিশ্বাস ছিল, এতে গাভীর দুধ বেশি হবে এবং অনিষ্টকারীর দৃষ্টি থেকে গাভী রক্ষা পাবে।
 
নীল সাগরের পাড়ে স্থাপিত কালী ও শিবমন্দিরের সেবক অম্রিশ বর্মণের কাছ থেকে যতোক্ষণে এসব শুনছি ততক্ষণে বিশাল দিঘির নয়ানাভিরাম সৌন্দর্য আমাকে টানছে। সে টান উপেক্ষা করার জো নেই। কিন্তু অম্রিশ বর্মণ কথা শেষ হওয়ার আগে ছাড়তে নারাজ। অগত্যা তাকে কিছু ঘুষ দিতে হলো।
 
সফরসঙ্গী বাংলানিউজের সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট দেলোয়ার হোসেন বাদলের কাছ থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে কয়েকটি ক্লিক মারতেই পটে গেলেন অম্রিশ বর্মণ। শিবলিঙ্গের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য সেবক বর্মণের পোজ এখনো চোখে লেগে আছে।
 
অম্রিশ বর্মণের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া পর বাংলানিউজের ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট নূর আলমের মোটরসাইকেল নিয়ে চতুর্ভূজ আকৃতির বিশাল দিঘির চারপাশ প্রদক্ষিণের সময় চোখে পড়ল নানা প্রজাতির গাছ, দিঘির জলে উদোম শিশুর জলকেলি, মাছেদের জলসংসার, পাখিদের কলকাকলি, গাঁয়ের বধূর সতর্ক স্নান, ক্লান্ত চাষীর ডুবসাঁতার, আর অবুঝ বালিকার বেহিসেবি জলানন্দ!
 
সবুজে ঘেরা দিঘির পাড়ে ছাতা আকৃতির বসার স্থান স্কুলপালানো বালক-বালিকাদের দখল নিতে দেখে নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসল। মুহূর্তেই যেন ফিরে গেলাম ১৬ বছর আগের দিনগুলোতে।

সামনে আরেকটু এগোতেই কপোত-কপোতিরও দেখা মিলল কয়েক জোড়া। তবে সবাই সংযত। ঢাকার রমনা, চন্দ্রিমা বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেড়াতে আসা তরুণ-তরুণীদের মতো অতো ‘বেপরোয়া’ তারা নয়। পরিমতিবোধে টের পাওয়া যায়।  
 
পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষিত নীল সাগরে প্রতি বছর সাইবেরিয়াসহ শীত প্রধান দেশ থেকে প্রচুর পাখি আসে। এটিই নীল সাগরের অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু হেমন্তের ভরদুপুরে কোনো অতিথি পাখির দেখা মিলল না।
 
তবে দেশজ পাখি দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়া, ফিঙ্গে, শালিক, কাকাতুয়াসহ নাম না জানা পাখিদের গানে যে কেউ হারিয়ে যেতে বাধ্য। দিঘির শান বাঁধানো ঘাটে বসে অথবা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে পাখিদের কল-কাকলি শোনার যে নৈসর্গিক আনন্দ তা বলে বোঝানো যাবে না।
 
বিশাল নীল সাগরের চারপাশ ভ্রমণ শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে চিন্তার কোনো কারণ নেই। দিঘির পাড়েই আছে নলকূপ। হাল্কা চাপ দিলেই সুপেয় পানি। আর্সেনিকমুক্ত খনিজ পানি পান করে সহজেই তৃষ্ণা মেটাতে পারেন যে কেউ।
 
নীল সাগরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য রয়েছে রেস্ট হাউস। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারেন। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সিঙ্গেল বেডরুম ২০০ টাকা, ডাবল বেডরুমের ভাড়া ৪০০ টাকা।
 
আর খাওয়া নিয়েও চিন্তার কোনো কারণ নেই। নীল সাগরে ঢোকার মুখেই পাবেন আলমগীর ভাইয়ের খাবারের দোকান। ঘরের মাছ-মুরগি-সবজি-ডিম-আলু ভর্তা দিয়ে পেট পুরে খেতে পারবেন অল্প টাকায়। যেকোনো তিনটি আইটেম খেলে ৩০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই হয়ে যাবে।
 
প্রার্থনার জন্যও নীল সাগরে রয়েছে আলাদা আলাদা উপাসনালয়। মুসলমানদের জন্য মসজিদ, হিন্দুদের জন্য মন্দির। আছেন ইমাম- মুয়াজ্জিন-পুরোহিত-সেবক।
 
নীলসাগরে ঢুকতে জনপ্রতি গুণতে হবে ৫ টাকা। বাইসাইকেল পার্কিংয়ে দিতে হবে ৫ টাকা, মোটরসাইকেলের জন্য ২০ টাকা, মাইক্রোবাস ৩০ টাকা আর বড় বাসের জন্য পার্কিং ফি ১০০ টাকা। এই দুর্মূল্যের বাজারে উল্লেখিত টাকার অংক বেশি কিছু না।
 
তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, স্থানীয় লোকজন যারা গোসল, সামান্য বিশ্রাম বা অন্য কোনো প্রয়োজনে নীল সাগরে আসেন তাদের কাছ থেকে কোনো পয়সা নেয় না কর্তৃপক্ষ।
 
নীল সাগর দেখতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে উঠে পড়ুন ‘নীল সাগরে’। আন্ত:নগর এই ট্রেন আপনাকে সোজা নিয়ে যাবে নীলফামারী জেলা শহরে। ভাড়া পড়বে এসি সাড়ে ৫০০ টাকা, নন এসি সাড়ে ৩০০ টাকা।
 
আর যদি সড়ক পথে যেতে চান তাহলে কল্যাণপুর থেকে উঠে পড়ুন এসআর ট্রাভেলস অথবা এসআর প্লাসে। এ কোম্পানির এসি/ননএসি দুই ধরনের বাসই আছে। এসিতে গেলে ভাড়া পড়বে ৮০০ টাকা, নন এসিতে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।  

এ ছাড়া হানিফ, শ্যামলী, নাবিল অথবা আগমনী পরিবহনে রংপুর পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নীলফামারী যেতে পারবেন।
আর নীলফামারী শহর থেকে পঞ্চগড়ের দেবিগঞ্জগামী বাস ছাড়াও অটোবাইক, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেলে করে ৩০ মিনিট ভ্রমণেই অনায়াসে পৌঁছে যাবেন নীল সাগর।
 
তো আর দেরি কেন?  আসছে শীতেই ঘুরে আসুন না নীলসাগরে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০২০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।