ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৩০
কুচার মহল (মৌলভীবাজার)-বাহুবল (হবিগঞ্জ)-মিরপুর বাজার (হবিগঞ্জ)= ৪২.৭৫ কিমি

শ্রীলেদার্সের স্পোর্টস স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়েছিলাম এই পদযাত্রার চতুর্থদিনে। সেই থেকে এতগুলো দিন সেটাই সঙ্গী ছিল।

এতদিনের টানা ব্যবহারে তলা ক্ষয়ে মাটির সঙ্গে জুতার বদলে পায়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল কিছু জায়গায়। ছোট ভাই আবীর দুই জোড়া স্পোর্টস স্যান্ডেল পাঠিয়ে দিয়েছিল ফরহান ভাইকে দিয়ে। কাল হাতে পেয়ে আজ এর এক জোড়া পায়ে গলিয়ে নিলাম। তীর্থদা আগের রাতেই আমার খাটের পাশের টেবিলে সকালের নাশতার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। পাউরুটি দিয়ে জমিয়ে পিনাট বাটার খেয়ে কুচার মহল থেকে দিনের পদযাত্রা শুরু।

মহাসড়ক ছেড়ে গ্রামের ছোট রাস্তা ধরে পথ। আজকের গন্তব্য বাহুবল দু’ভাবে যাওয়া যায়। মহাসড়ক ধরে শ্রীমঙ্গল হয়ে গেলে দূরত্ব বেশি। আর তাছাড়া ওই রাস্তায় আমি আগেও বেশ ক'বার যাতায়াত করেছি দেখে কাগাবলার এই ছোট রাস্তাই ধরলাম। রাস্তার প্রথম দিকের কিছু অংশ সিমেন্ট-খোয়া দিয়ে পাকা করা। সেটা শেষ হতেই শুরু ঘড়ুয়া গ্রাম। এই গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িই বাংলো টাইপ আর বিশাল। কয়েকটা বাড়ি এমনই সুন্দর যে চোখ ফেরানো দায়।  

টিলা কেটে বানানো রাস্তা।  ছবি: বাংলানিউজঘড়ুয়া গ্রামের পরেই প্রচুর ইটভাটা। আশপাশের গাছগুলো ছাড়িয়ে মাথায় সাদা ধোঁয়ার মুকুট নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে ইটভাটার চিমনিগুলো। এসবে চোখ রাখতে রাখতেই দীঘিরপার বাজার। বাজারচোখে পড়লেও দীঘির দেখা মিললো না। কাগাবলার রাস্তা ধরে এগিয়েই আটগাঁও। খুব একটা ঘনবসতি নেই এদিকে। বাড়িঘরের অবস্থান বেশ দূরে দূরে।

এই রাস্তাটার কিছু অংশ দারুণ ভালো আবার কিছু অংশ নিদারুণ খারাপ। অলহাবাজার ছাড়িয়ে সামনে যেতেই ধানক্ষেত কমে গেলো, বেড়ে গেলো ইটভাটা। অনেক শ্রমিকের দেখা মিলছে রাস্তার পাশে। রাস্তার দু'পাশ সম্প্রসারণের কাজ চলছে। মোটামুটি বেশিরভাগ শ্রমিকই চায়নিজ মোবাইলে উচ্চৈঃস্বরে বাংলা সিনেমার গান বাজিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। খুশহালপুর বাজারে ধান কেটে মাথায় বয়ে নিয়ে যাওয়া ক’জন শ্রমিকের দেখা। ধানের বোঝার উপর বেশ কায়দা করে কাস্তেটা গোঁজা। জাজুয়া হয়ে ধনদাস বাজারের দিকে যেতে রাস্তায় খড়ের আধিক্য দেখে মনে হচ্ছিল, এই রাস্তায় খড় শুকানোই মুখ্য। গাড়ি চলাচলের ব্যাপারটা এখানে গৌন। এর মাঝেই এক তরুণের সঙ্গ জুটে গেলো। একথা-ওকথায় আমার হাঁটাহাঁটির ব্যাপার-স্যাপার শুনে তার বাড়িতে চা খাওয়ার কঠিন অনুরোধ করলো। তার বাড়ি রাস্তা থেকে বেশ ভেতরে বলে সেটা আর এযাত্রা হলো না।

কাগাবলা বাজারে এসে চায়ের ফরমায়েশ দিতেই চায়ের দোকানের পিচ্চিটা জিজ্ঞেস করলো আমি সাইক্লিস্ট কিনা। 'এমনিতে আমি সাইকেল চালালেও এবার সাইকেল আনতে ভুলে গেছি৷ পা দুটো নিয়েই এসে পড়েছি'- ওকে এই উত্তর দিতেই ফোকলা দাঁতে হেসে দিল ফিক করে। বাজারের শেষ মাথাতেই বিজনা নদী। নদীকে হাতের বামে রেখে মোড় নিলাম ডানদিকে। কিছুটা পথ ইটের সলিংয়ের রাস্তা। খানিক বাদেই লাল মাটির রাস্তা। হাঁটা শুরু করার কিছুক্ষণ বাদেও বুঝতে পারিনি কি দারুণ একটা রাস্তায় হাঁটার অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে আজ। দু'পাশে দারুণ ঘন বাঁশবাগান। অল্প-স্বল্প সূর্যের আলো বাঁশবাগান ভেদ করে মাটিতে জায়গা করে নিতে পারছে।

ক্ষীণ ধারার করাংগী।  ছবি: বাংলানিউজপুরো রাস্তাটাই বানানো হয়েছে টিলা কেটে। বিশাল দুটো কাপড়ের গাট্টি নিয়ে দু’জন কাপড় বিক্রেতা আমার সামনে। প্রত্যেক বাড়ির কাছাকাছি এসে সে বাড়ি লক্ষ্য করে হাঁক-ডাক দিচ্ছে ওরা। বেশ কিছু ছোট ছোট টিলা পড়ছে হাতের বাম দিকটায়। দুটো চা বাগানও দেখা হল পথিমধ্যে। পুরো পরিবেশটাই দারুণ এক অনুভূতি জোগাচ্ছিল।

কয়েক জায়গায় কাদা পেরিয়ে চা শ্রমিকদের ছোট্ট একটা বসতি। রাস্তার পাশেই বসা ছিল জনাতিনেক লোক। এরমধ্যেই একজন আমাকে এমনভাবে হাতের ইশারায় ডাকলেন যেন আমি তার অধীনস্থ কর্মচারী। আমি তার সঙ্গে কোনো বাক্য ব্যয় না করে নিজের পথ ধরলাম। বাঁশের বাম্পার ফলন হওয়ায় লোকে প্রচুর বাঁশও কাটছে। একটা মোড় ঘুরতেই পেয়ে গেলাম দারুণ একটা চড়াই। ওই চড়াই ধরে উপরে উঠতে কতদিন পর পাহাড়ে ওঠার মতো শান্তি পেলাম।  

চড়াইয়ের ওপারেই লাল মাটির রাস্তা শেষ। এবার পাকা রাস্তা ধরেই চলা। দুটো ছোট ছড়া পেরিয়ে পূর্বপাড়া। এখান থেকেই শুরু হবিগঞ্জ জেলা। উপজেলার নাম নবীগঞ্জ। মোকাম বাজার হয়ে পানিউমদা বাসস্ট্যান্ডে এসে পড়লাম মহাসড়কে। আজকের দিনের বাকিটুকু পথ এই মহাসড়ক ধরেই। বড়গাঁও বাজার, রোকনপুর বাজার হয়ে বড়চর বাজার। এই মহাসড়ক খুব আহামরি ব্যস্ত নয়। খানিক পর পরবাস-ট্রাকের দেখা মিলছে। সঙ্গে প্রচুর সিএনজি।

বাহুবল উপজেলায় ঢুকে পড়লাম কল্যাণপুর বাজার থেকে। খানিক এগিয়ে দিগাম্বর বাজার। রাস্তায় এক ফোঁটা ছায়া নেই। গাছই নেই খুব একটা, ছায়ার আশা দূর অস্ত৷ গাছ না থাকলেও আছে সবুজ-হলুদের সীমাহীন ধানক্ষেতের বিস্তৃতি। যার শেষটা গিয়ে মিশেছে একেবারে দিগন্তে। দ্যা প্যালেস নামক বিলাসবহুল এক রিসোর্টের বিশাল ফটক দেখলাম পুঁটিজুরীর কাছেই৷ ওই বাজার হয়ে পৌঁছে গেলাম চলিতাতলা বাজার। বাহুবলের বাইপাস ছেড়ে খানিক যেতেই ক্ষীণ ধারার করাঙ্গী নদী। মৌচাক পয়েন্টের কাছে আসতেই মাহফুজের ফোন। মাহফুজ আমার মেডিক্যালের জুনিয়র। বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে কর্মরত। ওর কোয়ার্টারেই থাকবো আজ।

সড়ক।  ছবি: বাংলানিউজহাতে সময় থাকায় আরো খানিকটা পথ এগিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। পথের পাশে আজ গাছ না থাকলেও প্রচুর ঘাস আছে৷ এই ঘাস হাঁটার সময় কিছুটা হলেও শান্তি দিচ্ছে। আরো বেশকিছু ইটভাটা পেরিয়ে মিরপুর বাজারে এসেই আজকের মতো হাঁটার ইতি টানলাম। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে পৌঁছে গেলাম বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এই জায়গার নাম আমি প্রথম শুনেছিলাম প্রিয়াংকাদি'র মুখে। তীর্থ দা তখন এখানে কর্মরত ছিলেন। এই নাম শুনলেই এখন তামিল সিনেমার কথাই আগে মাথায় আসে। মিনিটখানেকের মধ্যেই চলে এলো মাহফুজ। কতদিন পর দেখা ওর সঙ্গে। কোয়ার্টারে ঢুকেই পরিচয় হল ওর কলিগ ইন্তেখাবের সঙ্গে। দুজনেই একই সঙ্গে চাকরি শুরু করেছে এখানে। সান্ধ্য আহারটা হলো আজ ভোরেই চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসা পিঠার সঙ্গে গ্রিন টি সমেত।

চলবে...

আরও পড়ুন...​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।