ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

পর্যটন

এভারেস্টচূড়ায় পা রেখে মনে হলো আমি পৃথিবীর রাজা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৮
এভারেস্টচূড়ায় পা রেখে মনে হলো আমি পৃথিবীর রাজা এভারেস্টচূড়ায় পা রেখে মনে হলো আমি পৃথিবীর রাজা

২৭ এপ্রিল ২০১২। আমরা মানে আমি আর নিশাত মজুমদার চলেছি এভারেস্টের ক্যাম্প টু থেকে থ্রির পথে। নেপালের দিক থেকে এভারেস্ট আরোহনের পথে সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে এটি। আরোহণ করতে করতে আমরা পৌঁছালাম ওয়েস্টার্ন কুম-এ। এটি মোটামুটি সমতল মাঠের মতো একটি জায়গা। উপর থেকে গোলাকার থালার মতো দেখা যায়। এ জন্য এডমুন্ড হিলারি জায়গাটির নাম রেখেছিলেন ওয়েস্টার্ন কুম। চারপাশেই দেখা যাচ্ছে পৃথিবীখ্যাত সব পর্বতশৃঙ্গ। এভারেস্ট, লোৎসে ও নুপুৎসে। 

পড়ুন বাংলানিউজের বর্ষপূর্তির ই-ম্যাগ

আমরা পানি খাওয়ার জন্য একটু বিরতি দিলাম। আমার আগে আমার শেরপা।

পেছনে নিশাত, দলের অপর পর্বতারোহী নেপালি মান বাহাদুর। এমন সময় খেয়াল করলাম নুপুৎসের দিক থেকে ছোট ছোট বরফখ- ধসের আকারে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমরা অতোটা আমলে নিলাম না। ছবি তোলা ও পানি পানে ব্যস্ত রইলাম। হঠাৎ করে শেরপা ‘সেফটি সেফটি’ বলে চিৎকার করে উঠলো। ততক্ষণে ছোট সে ধস রূপ নিয়েছে রীতিমতো বড় অ্যাভালান্স (তুষারধস)। আমি দ্রুত আমার সেফটি ক্যারাবিনার ফিক্সড রোপে লাগিয়ে দিয়ে বসে পড়লাম। পূর্ব-অভিজ্ঞতা কাজে লাগলো। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ফিক্সড রোপের সঙ্গে নিজেকে আটকে রাখা একটি মৌলিক নিয়ম। সেই পরিস্থিতিতে ভুল হয়নি। ঝড়ের বেগে সেই অ্যাভালান্স আমাদের উপরে চলে এলো। আমাদের পেছনে নিশাত সেই অ্যাভালান্সের ছবি তুলছিল। সেফটি ক্যারাবিনার রোপে লাগানোর কথা সে খেয়াল করেনি। অ্যাভালান্স আমাদের উপর দিয়ে যেতে শুরু করলো। আমি নাকমুখ চেপে বসে আছি। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতে সফট স্নোর গুঁড়া নাকমুখ দিয়ে ফুসফুসে গিয়ে মারাত্মক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির তৈরি করতে পারে। অনেক আগে যখন পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ ছিল না, তখনই এটি শেখানো হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর অ্যাভালান্স থেমে গেলো। কাকতালীয়ভাবে আমি ছিলাম শেরপার পেছনে। আমার কোনো ধরনের আঘাত লাগেনি। আমি উঠে দাঁড়িয়ে নিশাতকে খুঁজতে লাগলাম। গোঙানির শব্দ কানে এলো।  ...দৌড়ে গিয়ে দেখি এক অতল খাদের কিনারে নিশাত পড়ে আছে। মূল ঘটনা হলো সেফটি রোপের সঙ্গে ক্যারাবিনার না লাগানোয় অ্যাভালান্স তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো তাকে পাওয়া গেছে ক্রেভাসের মাত্র কয়েক ফুট দূরে। নিশাতের কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে। আমরা তাকে নিয়ে গেলাম ক্যাম্প টু-তে। সেখানে তাকে ডাক্তারি পরীক্ষা করা হলো। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে তার ইন্টারনাল কোনো ইনজুরি পাওয়া যায়নি। সে ইচ্ছো করলে অভিযান চালিয়ে যেতে পারে। নিশাতও অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। এতো বড় একটি দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার পর নিশাত যে দৃঢ় মনেবলের পরিচয় দিয়েছে তা অনেক বড় ব্যাপার।  

সেই অভিযানেই আমরা আরেকবার আরেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাই। ক্যাম্প থ্রি জায়গাটা একটি ঝুলন্ত হিমবাহের নিচে। একে ইংরেজিতে হ্যাঙ্গিং গ্লেসিয়ার (ঝুলন্ত হিমবাহ) বলে। বিশাল তার আকার। দেখেই মনে হয় যে কোনো সময় গড়িয়ে পড়তে পারে। আমরা রাতে তাঁবুতে শুয়ে আছি। এমন সময় ছোট ছোট বরফের টুকরো এসে তাঁবুর গায়ে আঘাত করতে শুরু করলো। শেরপা তাঁবুর চেইন খুলে একবার বাইরে তাকিয়েই আবার বন্ধ করে দিলো। সেই হিমাবহের একটি অংশ গোলাকার বলের মতো গড়িয়ে ক্যাম্প এলাকায় আমাদের তাঁবুর দিকেই আসছে। আমরা তাড়াতাড়ি মাথায় হেলমেট চাপিয়ে নিয়ে ব্যাকপ্যাক সামনে রেখে গুটিশুটি মেরে বসলাম। বরফ গড়িয়ে আসার শব্দ শুনছি। কিন্তু কোথাও দৌড়ে পালানোর উপায় নেই। বস্তুত সেদিনই আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলাম। কয়েকটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, নিশ্চিত মৃত্যুর দূত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাদের তাঁবুর আগে অসমতল অংশে ক্রিকেট বলের মতো বাউন্স করে আমাদের নিচের একটি তাঁবুতে আঘাত করে। সেখানে একজন শেরপা ছিলেন। তিনি গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। তাকে ক্যাম্প টু-তে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সরাসরি হেলিকপ্টারে করে কাঠমা-ুর হাসপাতালে।  

২০ মে ২০১১ রাত সাড়ে ৮টায় আমরা প্রায় ২৭ হাজার ২৩০ ফুট উঁচুতে তিব্বতের দিকের তিন নম্বর ক্যাম্পের তাঁবু থেকে বের হয়ে আইসবুটের নিচে ক্রাম্পন লাগাই এবং রাত ৯টায় হেডলাইটের আলোতে সামিটের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত আরোহণ শুরু করি। তখন তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নিচে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাত যতো বাড়তে থাকে তাপমাত্রা ততো কমতে থাকে। রাতের আঁধারে পর্বতারোহীদের মাথার হেডলাইটগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এভারেস্টের গায়ে সারি বেঁধে জোনাকপোকা চলছে। প্রায় ঘণ্টাদেড়েক পরে ইয়োলো ব্যান্ডের কাছে পৌঁছি। রাত ১২টার দিকে প্রায় ২৮ হাজার ৯৭ ফুট (৮,৫৬৪ মি.) উচ্চতায় ফার্স্ট-স্টেপ নামের ভয়ঙ্কর এক জায়গায় পৌঁছাই। কালো রঙের ২৫-৩০ ফুট উঁচু বিশাল এক পাথরের খাড়া দেয়াল উপরে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে বেশকিছু পর্বতারোহী নিচে ফেরত যান। জুমারের সাহায্যে দড়ি বেয়ে হেডলাইটের আলোতে সে দেয়ালে উঠছি। এক পাশে হাজার হাজার ফুট গিরিখাদ। মুহূর্তের অসাবধানতায় হারিয়ে যেতে হবে চিরতরে। ফার্স্ট-স্টেপ পার হয়ে হেডলাইটের আলোতে প্রথমবার এভারেস্টের গায়ে পড়ে থাকা মরদেহ দেখতে পাই। রাত একটার দিকে ‘মাশরুম-রক’-এর কাছে আমার প্রথম অক্সিজেন সিলিন্ডার পরিবর্তন করা হয়। মাশরুম রক থেকেই প্রথম বিশ্বের পঞ্চম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মাকালু দেখতে পাই। তখন আকাশে ছিল বেশ বড় একটি চাঁদ। চাঁদের আলোয় মাকালুকে ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছিল।  ...রাত ৩টার দিকে প্রায় ২৮ হাজার ২৪৮ ফুট (৮,৬১০ মি.) উচ্চতায় সেকেন্ড-স্টেপ নামের দ্বিতীয় বাধার কাছে এসে পৌঁছি। তিব্বতের দিক দিয়ে ক্যাম্প থ্রির পরে যেসব পর্বতারোহী ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন তাদের বেশিরভাগ এখান থেকে ফেরত যান। যেখানে প্রায় ৪০ ফুট খাঁড়া একটি পাথরের দেয়াল আছে। দু’টি মই দিয়ে সেই দেয়াল পার হতে হয়। প্রথম মইটি ছিল ৫/৬ ফুট উঁচু আর দ্বিতীয়টি ছিল প্রায় ৩০ ফুটের মতো। সেকেন্ড-স্টেপ পার হওয়ার পর শেরপা গাইড পেম্বা দর্জির হাতের বিশেষ ঘড়িতে দেখলাম তাপমাত্রা তখন মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানেও কয়েকটা মরদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। হঠাৎ করেই একটু জোরে বাতাস বইতে লাগলো। ঠাণ্ডা বাতাস চোখে লাগা মাত্রই ঝাপসা দেখতে লাগলাম। তখন কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমার মনোবল ছিল অটুট। চোখে ঝাপসা দেখায় কিছুটা ধীরে  গোতে লাগলাম। এই সময় পেম্বা দর্জি শেরপাসহ বাকি চারজন অনেকটা এগিয়ে গেলো। ভোর ৫টার দিকে আমি যখন প্রায় ২৮ হাজার ৫৭৬ ফুট (৮,৭১০ মি.) উঁচুতে তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্টে আরোহণের তৃতীয় বড় বাধা থার্ড-স্টেপে পৌঁছাই তখন কানে এলো কে যেন ‘হেলপ হেলপ’ বলে চিৎকার করছে।  

আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি থার্ড-স্টেপের কাছে পৌঁছাতেই দেখলাম উচ্চতাজনিত অসুস্থতা ও অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে আয়ারল্যান্ডের একজন পর্বতারোহী মারা গেছেন। ৮ হাজার মিটার (২৬,২৫০ ফুট) উচ্চতা থেকে শুরু হয় ‘ডেথ জোন’ বা মৃত্যুপুরী। কেননা এই উচ্চতায় অক্সিজেনের পরিমাণ এতোই কম যে এখানে কোনো প্রাণীই বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না। একে তো চোখে ঝাপসা দেখছি, তার ওপর ওই লোকটাকে চোখের সামনে মারা যেতে দেখে অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখন সামনের দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছিল, এই তো একেবারে কাছেই চূড়া দেখা যাচ্ছে। এখনই বুঝি চূড়ায় উঠে যাবো। কিন্তু না, তখনও আমাকে আরও প্রায় সাড়ে চারশ ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। সামনের রাস্তাটা সোজা নয়, এঁকেবেঁকে গেছে। তখন পায়ের গোঁড়ালিতে ভীষণ ব্যথা হচ্ছিল। চূড়ার প্রায় কাছাকাছি যখন চলে এলাম, দেখলাম চূড়ার শীর্ষে দাঁড়িয়ে পেম্বাসহ দলের অপর দু’জন আমাকে দ্রুত আসার জন্য হাত-ইশারায় ডাকছেন।  ...২০১১ সালের ২১ মে নেপাল সময় সকাল ৭টায় আমি এভারেস্টের শীর্ষে উঠে দাঁড়াই। তখন মনে মনে ভাবছিলাম সত্যিই কি আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানে উঠেছি! চূড়ায় উঠে মিংমা চিরিং শেরপা ও দা কিপা শেরপাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলি। এভারেস্টের চূড়ায় আমি প্রায় ৩০ মিনিট থাকি। প্রথম ১০ মিনিট অক্সিজেন-মাক্স পরে, তারপর ২০ মিনিট অক্সিজেন-মাস্ক ছাড়াই ছিলাম। এভারেস্টচূড়ায় পা রেখে মনে হলো, আমি পৃথিবীর রাজা এবং প্রিয় বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানে। এভারেস্টশীর্ষে দেশের লালসবুজ পতাকা ওড়াতে পেরে মনে হলো আমি ষোল কোটি মানুষকে গর্বিত করতে পেরেছি।

বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই মানুষটি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি ২০১২ সালের ১৯ মে নেপালের দিক দিয়ে আবার এভারেস্টে আরোহণ করি। আমার কাছে দু’বার এভারেস্ট আরোহণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইনাম আল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়া। তিনি আমার মেনটর, আমাদের সত্যিকারের হিরো।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০১ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৮

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।