ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ফুল-উপকারী-পরিশ্রমী ও সময়ানুবর্তী মানুষের দেশে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৭
ফুল-উপকারী-পরিশ্রমী ও সময়ানুবর্তী মানুষের দেশে নেদারল্যান্ডসে একটি ফুলের বাগান

নেদারল্যান্ডস দেশটি, দেশটির বাসিন্দা তথা ডাচদের জীবনযাত্রা এবং তারা মানুষ হিসেবে কেমন, তা নিয়ে আমার পরিচিতজনদের মধ্যে যাদের আগ্রহের শেষ নেই, তাদের জন্যই আজকের এ লেখা। ২ বছর ৪ মাসে আমি যতুটুকু দেখেছি, সে অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। স্বভাবত আমি একটু মিশুক বলে এখানে অনেক ডাচের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাদের দেখে আর তাদের থেকে এসব তথ্য নিয়েছি।

নেদারল্যান্ডসের আগের নাম হল্যান্ড। দেশটির স্থলভাগের উচ্চতা সমুদ্রের জলতলের থেকে অনেক নিচু।

তাই বাঁধ দিয়ে পুরো দেশটা ঘিরে রাখা হয়েছে। সে বাঁধ অবশ্য আমাদের দেশের মতো নয় যে, সামান্য জলোচ্ছ্বাসেই ভেঙে যাবে! নাগরিকরাও বাঁধ নিয়ে খুব সচেতন। এছাড়া জলতলকে সমান রাখার জন্য আরও একটি উপায় অবলম্বন করে তারা। গোটা দেশজুড়ে প্রচুর খাল কাটা আছে। সমুদ্রের সঙ্গে এই খালগুলির যোগাযোগ আছে নদীর মাধ্যমে। এভাবে ভৌগোলিক অসুবিধাগুলিকে এ দেশের মানুষ অনেকটা অতিক্রম করতে পেরেছে। খালগুলির উপর রীতিমতো নৌবিহার করা যায়। ফলে, সমগ্র দেশে একটা পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে ব্যবস্থা এমনই যে, গোটা দেশেই জলপথে ভ্রমণ করা যায়। কখনও খালের উপরে রাস্তা, কখনও বা সে রাস্তা খালের নিচে দিয়ে। ছোট্ট দেশ, অথচ কী সুন্দর সাজানো গোছানো! 

নেদারল্যান্ডস খুবই ছোট দেশ। ইউরোপের উত্তরাঞ্চলে উত্তর সাগর তীরের দেশটি আয়তনে ৪১ হাজার ৫৪৩ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখের কিছু বেশি। ইতিহাসের পাতায় আমরা যাদের ওলন্দাজ বলে চিনি, এরাই তারা। এরা ছিল প্রধানত নাবিক। প্রত্যেকে বেশ লম্বা, ফর্সা গায়ের রঙ।

নেদারল্যান্ডসের একটি পর্যটন স্পট
নেদারল্যান্ডসের মাতৃভাষা ডাচ। বর্ণমালাগুলো ইংরেজি বর্ণমালার মতো দেখতে হলেও এর প্রতিটি অক্ষরের উচ্চারণ সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের কাছে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনেক। ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজি ভাষার প্রচলন আছে। তবে খুব কম। সেজন্য হাইস্কুলে এখন ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

নেদারল্যান্ডসের প্রতিটি শহরের বাড়ি এবং ভবনের অবকাঠামো অনেকটা একইরকম। শহর কর্তৃপক্ষ ডিজাইন এবং ভবন তৈরি করে দেয়। সেজন্যই আসলে একইরকম। আর এ কাঠামো শহরের শোভা বৃদ্ধি করেছে নিঃসন্দেহে। শহরের বাইরে গ্রামে গেলেও এর কাঠামোর পরিবর্তন দেখা মেলে না। বাড়ি তৈরি করতে কাঠের ব্যবহার হয় সর্বাধিক।

নেদারল্যান্ডসের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। সারাবছরই তারা কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখে। গ্রীষ্মকালে বাইরে এবং শীতকালে তারা গ্রিন হাউস পদ্ধতিতে উৎপাদন করে। গ্রিন হাউস হলো কাচ বা তেমন স্বচ্ছ বস্তু দিয়ে বানানো এক ধরনের ঘর। সূর্যের আলো এই কাচ দিয়ে ঢুকে ঘরের ভেতরের তাপ বাড়িয়ে তোলে এবং তা ঘর থেকে আর বের হতে পারে না। শীতপ্রধান দেশে এভাবে গ্রিন হাউস বানিয়ে সবজি ও অন্যান্য চাষবাস করা হয়। নেদারল্যান্ডসের কৃষকরা দেশের প্রথম শ্রেণীর ধনী।

ডাচদের প্রধান খাদ্য ব্রেড, আলু ও সালাদ। এই ব্রেডের সঙ্গে অন্তত হাজার রকমের উপকরণ আছে, যা মিলিয়ে তারা খেতে পছন্দ করে। মাসে একবার কিংবা দু’বার ভাত খায় বললেই চলে। ডাচরা খুব অবাক হয়, যখন শুনে বাংলাদেশে আমরা তিনবেলা ভাত খাই। তাদের খাবার সময়সূচি সাধারণত সকাল ৮টায় প্রাতঃরাশ, দুপুর ১টায় মধ্যাহ্ন ভোজ এবং সন্ধ্যে ৬টায় নৈশভোজ।  সাজানো-গোছানো নেদারল্যান্ডসএপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, এই সময়টায় এখানে গরমকাল। রাত ১০টা পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকে। সম্পূর্ণ অন্ধকার নামতে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা বেজে যায়। সূর্যোদয়ও হয় খুব ভোরে। শীতকাল যত এগিয়ে আসে, ততই দিনের ব্যাপ্তি কমতে থাকে। তারপরও তারা ঘড়ির কাঁটা মেপে চলে। ডিনারে তারা ভারী গরম খাবার খেতে পছন্দ করে। তাই দিনে একবার রান্না করে। আর দম্পতির দু’জনেই কর্মজীবী হলে ছুটির দিনে (শনি-রোববার) বিশেষ রান্না করে অথবা বাইরে খেতে বের হয়।
 
ডাচরা খুব পরিশ্রমী। শত শত বছরের পরিশ্রমের ফসল আজকের এই নেদারল্যান্ডস। সেজন্যই আজ তারা বিশ্বে একটা উন্নত দেশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আইন যেমন আছে, তেমনি তার যথাযথ প্রয়োগও আছে। অতিরিক্ত জরিমানা দেওয়ার ভয়ে কেউ আইন অমান্য করে না, আর সেটা ছোট হোক বড় হোক। এ দেশের কারাগারগুলো কয়েদির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, সে সম্পর্কে প্রতিবেদনও আমরা অনেক দেখেছি। আর কয়েদির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না করে রয়েছে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংশোধনের ব্যবস্থাও।

ডাচরা বিশেষত খ্রিস্টান ঘরের হলেও এদেশের বেশিরভাগ মানুষের এখন ধর্ম নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। সব ধর্মই সমান তাদের কাছে, সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করে ডাচরা। এ দেশে চার্চের সংখ্যা ৪২শ’র মতো। প্রতিটি চার্চ ৫০০-৬০০ লোক ধারণের উপযোগী করে বানানো। তবে এদেশের মানুষের কাছে বিশেষ ধর্ম মানবসেবা। তাদের বিশ্বাস, প্রার্থনায় বসে থাকার চেয়ে সে সময়টায় কারও উপকার করলে তারও ভাল হবে, নিজের শরীরও ভাল থাকবে, ঈশ্বরও খুশি হবেন, সর্বোপরি দেশেরও উপকার হবে। সেজন্য এদেশের বেশিরভাগ মানুষই কোনো কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে জড়িত। কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান বা নিজে বিজ্ঞাপন দিয়েও স্বেচ্ছায় সামাজিক কাজে অংশ নেয়। এমনকি বয়স্করাও ঘরে বসে থাকতে পছন্দ করে না।

একটি পর্যটন কেন্দ্রে প্রকৃতির নিসর্গে লেখক
ডাচদের মধ্যে আরও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সময় সচেতনতা বা সময়ানুবর্তিতা। ডাচদের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট (সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ)। কারও সঙ্গে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তারা হাজির হয়, কোনো কারণে ৫ মিনিট দেরি হলেও সেটা আগেই টেলিফোন বা ইমেইল এ জানিয়ে দেবে। দৈনন্দিন জীবনের কর্মসূচি আখেন্দা নামক ছোট ডায়েরি ব্যাবহার করতে তারা অভ্যস্ত। তারা সেটাই মেনে চলে।

নেদারল্যান্ডস ফুলের দেশ। বছরের শীতের সময়টা বাদে অন্য সময়টা ফুলে ভরপুর থাকে এই দেশ। আর তাই সবাই ব্যস্ত হয়ে যায় নিজের বাড়ির সামনে আর পেছনের জায়গায় বাগান সাজাতে।

বেশির ভাগ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলেও তারা সাইকেল ব্যবহার করে। এমনকি নেদারল্যান্ডসের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীও মাঝেমধ্যে সাইকেলে গিয়ে অফিস করেন।

লেখক
ফারজানা পুষ্পিতা, নেদারল্যান্ডপ্রবাসী

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।