ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

হাতিয়ায় যাওয়া সহজ, আসা কঠিন

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৭
হাতিয়ায় যাওয়া সহজ, আসা কঠিন হাতিয়ায় যাওয়া সহজ, আসা কঠিন

হাতিয়া ঘুরে: চেয়ারম্যান ঘাট থেকে হাতিয়া যাওয়ার একটি মাত্র সি-ট্রাক। এটি হাতিয়া পৌঁছে ফিরতি যাত্রী নিয়ে এক ঘণ্টা বাদেই আবার হাতিয়া থেকে ছেড়ে আসে।

সি-ট্রাক একটি থাকলেও সকাল-বিকেল ট্রলার ও স্পিডবোট রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার যাত্রী হাতিয়া-চেয়ারম্যান ঘাট ব্যবহার করে।

যাদের অর্ধেকই পছন্দ করেন সি-ট্রাক আর বাকিরা ট্রলার ও স্পিডবোট।

সি-ট্রাকে ভাড়া ৯০ টাকা। ঘাটে টোল বাবদ দিতে হয় ৩ টাকা। মোট ৯৩ টাকার টিকিট নিয়ে সি-ট্রাকে উঠলাম।

চেয়ারম্যান ঘাট থেকে খুব সহজেই সি-ট্রাকে চড়লাম। কিন্তু সি-ট্রাক থেকে হাতিয়ায় নামা যে এতো কঠিন তা জানা ছিলো না! হাতিয়ায় সি-ট্রাক ভেড়ানোর জন্য কোনো পন্টুন নেই। ঘাটে ভেড়ানোর জন্য সি-ট্রাকটি একটু সামনে এগোয় তো আবার পেছিয়ে যায়। জোয়ার-ভাটা ও উত্তাল ঢেউয়ের জন্য এভাবেই সি-ট্রাকটিকে যুদ্ধ করে তীরে ভেড়াতে হয়।

হাতিয়া সি-ট্রাক ঘাট

নদীর খাড়া তীর ঘেঁষে কাদার মধ্যেই জাহাজটি ভিড়লো। সি-ট্রাকের তলা বেশ গভীর তাই তীর থেকে খানিকটা দূরেই ভেড়তে হয়। এদিকে নামার সিঁড়িটাও অতো বড় নয় যে যাত্রীরা একেবারে শুকনো মাটিতে গিয়ে নামবে। বাধ্য হয়েই পানির মধ্যে সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়‍া হলো। ঢেউয়ের জন্য জাহাজটি দুলছে ফলে সিঁড়িও ওঠানামা করছে, ছিটকে পড়লেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যাত্রীরা জুতা-স্যান্ডেল হাতে খালি পায়েই সিঁড়ি বেড়ে নেমে গেলো। আমিও তাদের পিছু নিলাম।

পরের দিন ফিরে আসার জন্য সকাল ১০টার মধ্যেই ঘাটে পৌঁছলাম। ভাবলাম বেশ আগেই এসে পৌঁছেছি। কিন্তু জাহাজে ওঠার টিকিট কিনতে গিয়েই সে ভুল ভাঙলো। কাউন্টারে আমার আগে আরো দুইশো যাত্রী দাঁড়িয়ে!


হাতিয়া ঘাটে টিকিট কাটার লাইন

ঘাটে পন্টুন নেই, তাই স্রোতের তোড়ে সি-ট্রাক ঘাটে ভিড়তে পারছে না। ফলে নদীর একটু গভীরে গিয়ে সে নোঙর করেছে।
সি-ট্রাক যেহেতু তীর থেকে দূরে, তাই যাত্রীদের ট্রলারে করে সি-ট্রাকে উঠতে হবে। এবার ট্রলারে ওঠার যুদ্ধ। নদীর খাড়া তীরে ট্রলার ভেড়ানো যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বড়-বড় ঢেউয়ের আঘাতে দুলছে ট্রলার। কোনো রকমে সিঁড়ি পাতা হলো ঘাটে। ঢেউয়ে ট্রলারের ওঠা-নামায় সিঁড়িও ওঠা-নামা করছে। তার ওপর যাত্রীরা হুড়মুড় করে পড়লো, কে-কার আগে ট্রলারে উঠবে তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি। পাঁচটি ট্রলারে করে এভাবে যাত্রীরা সি-ট্রাকে উঠলো।

হাতিয়া ঘাটে নামছে যাত্রীরা

নারী-শিশু-বৃদ্ধ, হাস-মুরগি-ছাগল-সাইকেল সবাই উঠবে ট্রলারে। কাদা পেরিয়ে সিঁড়িতে ওঠ‍ার ফলে কিছুক্ষণ পরেই সিঁড়ি ‘কর্দমাক্ত’ হয়ে গেলো। তা দিয়ে আর উপরে ‌ওঠা যায় না, সিঁড়িতে খাঁজ কাটা নেই। এক কদম এগুলে দু’কদম পিছিয়ে আসতে হয়। পানিতে পড়ে যাওয়ার শঙ্কাতো আছেই। এভাবে যাত্রীরা ট্রলারে উঠলো।

ট্রলার থেকে জাহাজে ওঠার জন্য আবার সেই একই যুদ্ধ। এবার বিপদ আরো বেশি! কারণ, সি-ট্রাক এবার মাঝ দরিয়ায়। একবার পড়লে ওঠানোর কেউ নেই। এ এক দুর্বিষহ অবস্থা।

ঘাটে পন্টুন নেই কেন, একটা পন্টুন থাকলেই তো এতো কষ্ট হতো না- কেউ এর সদুত্তর দিতে পারলো না। কেউ কেউ বললো, স্রোত ও ঢেউয়ের জন্য পন্টুন রাখা যায় না। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি সে রকম মনে হয়নি। কারণ, এর চেয়েও বেশি স্রোত ও ঢেউ আছে এমন ঘাটেও পন্টুন থাকে। কিন্তু এখানে কেন নেই তার কোনো উত্তর নেই। মনে হচ্ছে, বিষয়টি স্রেফ একটি অবহেলা ছাড়া আর কিছুই না। দেশের প্রান্তিক এলাকা ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলেই এসব দেখার কেউ নেই।

হাতিয়া ঘাটে দূরে ‍অপেক্ষমান সি-ট্রাক

বিষয়টির সঙ্গে যে গুরুতর অবহেলা জড়িত সেটি আরো পরিষ্কার হলো সি-ট্রাকটির অবস্থা দেখে। পুরনো লক্কর-ঝক্কর মার্কা একটি সি-ট্রাক। দেখে মনে হয়, যেনো অন্য কোনো ঘাটের বাতিল হওয়া সি-ট্রাক নামিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রমত্তা মেঘনার বুকে। যাত্রীদের কেউ কেউ বলেছে, সি-ট্রাকের কোনো কাগজপত্র-মানে ফিটনেস নেই। সত্য মিথ্যা জানি না, তবে জাহাজের অবস্থা দেখে আমারও তাই মনে হলো। হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপবাসীদের প্রতি এই গুরুত্বহীনতার কারণ স্পষ্ট নয়।

ট্রলারে করে সি-ট্রাকে উঠতে যাচ্ছে যাত্রীরা

যাত্রীদের সঙ্গে আরো আলাপ করে জানা গেলো, এখানে যে ট্রলার ও স্পিডবোট চলে তারাও সি-ট্রাক ওয়ালাদের টাকা দিয়ে চলে। সেটি কীভাবে? জিজ্ঞেস করতে এক যাত্রী বললেন, ট্রলারের ভাড়া ১৫০ টাকা আর সি-ট্রাকের ভাড়া ৯০ টাকা। ট্রলারগ‍ুলো যাত্রী প্রতি ১৫০ টাকা রাখে ঠিকই কিন্তু সেখান থেকে ৯০ টাকা সি-ট্রাক ওয়ালাদের দিয়ে দিতে হয়। বাকি ৬০ টাকা ট্রলারের থাকে।

স্পিডবোটগুলোর কাছ থেকেও সি-ট্রাক এভাবে যাত্রী প্রতি টাকা তোলে। স্পিডবোটের ভাড়া ৪০০ টাকা। সেখান থেকে ৯০ টাকা সি-ট্রাককে দিলে ‍বাকি ৩১০ টাকা তাদের থাকে। তার মানে সি-ট্রাক কোনো দিন না চললে বসে বসেও টাকা নিতে পারে। ট্রলার ও স্পিডবোটে করে যতো যাত্রী যাবে মাথাপিছু ততো টাকা। বরং চলাচল করলে তো খরচ আছে। তার চেয়ে বরং বসে বসে ট্রলার ও স্পিডবোট মালিকদের কাছে থেকে টাকা তোলাই ভালো। ঢাকায় ফেরার পর একবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কয়েকদিন সি-ট্রাক চলেনি। কিন্তু তারা ট্রলার ও স্পিডবোটের কাছ থেকে ঠিকই যাত্রী-প্রতি টাকা গুনেছে।

মাঝ নদীতে ট্রলার থেকে সি-ট্রাকে উঠছে যাত্রীরা

যাই হোক। যাত্রীদের এসব দুর্ভোগের সাক্ষী হতে হতে জাহাজ চেয়ারম্যান ঘাটের কাছে চলে আসলো। নদীতে পানি কম। তাই জাহাজ এবার চেয়ারম্যান ঘাটের দিকে (মূল নদী থেকে ভেতরে শাখা নদীর দিকে) না গিয়ে আরেকটু সামনে গিয়ে চটলা ঘাটে ভিড়লো। এ ঘাটেও কোনো পন্টুন নেই। তাই নামার সময় যাত্রীদের সেই একই বিপত্তি- যা আর পুনরাবৃত্তির দাবি রাখে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৭
এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।