ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

প্রাণ যায় যায় প্রাণসায়রে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
প্রাণ যায় যায় প্রাণসায়রে প্রাণসায়রের পচা পানিতে রাজহাঁসের জলকেলী। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

সাতক্ষীরা ঘুরে: কামার পাড়ার কাছে বাঁশের সাঁকো। ওটাতে ঝুঁকি নিয়েই চলছে ওপাড়ের সুলতানপুরের সঙ্গে যোগাযোগ। পাড়া থেকে খালের বুকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে নর্দমার মুখ। পাশে রোদে শুকানোর জন্য ঘুটে মেলে রাখা।

দ‍ূষণে কালো হয়ে যাওয়া নোংরা পানিতে তবু জলকেলীতে মত্ত রাজহাঁসের দল। সব দূষণ শুষে নিয়ে বুঝি খালটাতে প্রাণ ফিরিয়ে আনবে ওরাই।

কিন্তু এ পানিতেও যে তারাও হুমকির মুখে সেটা কি করে বুঝবে অবুঝ হাঁসের দল?প্রাণসায়র খালের ওপরে বাঁশের সাঁকো।  ছবি: শুভ্রনীল সাগরতুফান কোম্পানি ব্রিজের ওপর রীতিমতো জমে উঠেছে কাঁচাবাজার। খালের বুকে ময়লার ভাগাড়টা যেনো দাঁত ভেংচাচ্ছে। একটু দূরেই বরফকল, শৌচাগার। বাণিজ্যিক দোকান, বসত ঘর আর মাছের বাজারও আছে খালের বুক জুড়ে। গড়ের কান্দায় পাড় থেকে খালের বুকে এগিয়ে দখলের দম্ভ ঘোষণা করছে প্রভাবশালীর পাকা দেওয়াল।

পাকা পুলের কাছে খালের ওপর ঝুঁকে যেনো উপহাস ছড়াচ্ছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের দ্বিতল দালান। বিপরীতে তবু খেয়াজালে জীবনের গান। এদিকটায় কচুরিপানার ছাড়া ছাড়া দঙ্গল ভাসছে বটে, কিন্তু পানির বর্ণ দূষণে কালোই হয়ে আছে।
 
অনেক আগেই মজে গেছে প্রাণসায়র। জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর উদ্যোগে ১৮৬৫ সালে কাটা এই খাল তাই এখন প্রাণহীন। বছরের পর বছর ধরে শহরের বর্জ্য মিশতে থাকায় ঐতিহাসিক এই খাল পরিণত হয়েছে খোলা স্যুয়ারেজ লাইনে। তাই একসময় যে খালের পানি মানুষ পান করতো, সে পানির কাছে আসতে এখন রুমাল চাপা দিতে হয় নাকে। প্রাণসায়র খালের ওপরে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিস।  ছবি: শুভ্রনীল সাগরশহরের মাঝ বরাবর অবস্থানের কারণে শহরবাসীকে নিত্যদিন এই খাল পাড়ি দিতেই হয়। শুনতে হয় প্রাণসায়রের প্রাণ হারানোর আর্তনাদ। কিন্তু সে আর্তনাদও চাপা পড়ে যায় প্রভাবশালীদের খাল দখলের মচ্ছবে। শহরের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠার বদলে এই খাল তাই এখন বিষের কাঁটা হয়ে ব্যথা ছড়ায় সাতক্ষীরাবাসীর বুকে।

জমিদার প্রাণনাথের খোঁড়া এই খালের সংযোগ দক্ষিণের মরিচ্চাপ নদী থেকে উত্তরের নৌখারী খালের সঙ্গে। প্রাণসায়ের আর সায়রের খাল নামেও পরিচিতি আছে এর।

খননের পর এই খালই হয়ে উঠেছিলো সাতক্ষীরা শহরের যোগাযোগের অন্যতম রুট। মাল আর যাত্রীবাহী বড় বড় নৌযান চলাচলে এক সময় দিনমান ব্যস্ত থাকতো প্রাণসায়র। খননকালে এর দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ১৩ কিলোমিটার। প্রস্থ ছিলো প্রায় ২শ’ ফুট। কিন্তু সেই প্রশস্ততা কমে এখন অনেক স্থানেই ২০ ফুটের নিচে নেমে গেছে। লঞ্চ-নৌকা তো দূরের কথা, ভেলা ভাসানোর মতো স্রোতও নেই প্রাণহীন প্রাণসায়রে। প্রাণ সায়র খালের একাংশ।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর
অথচ একসময় ইছামতির হাড়দাহ দিয়ে কলকাতা খাল হয়ে বড় বড় স্টিমারই ঢুকত প্রাণসায়র খালে। এই খাল খননের ফলে সাতক্ষীরার ব্যবসা-বাণিজ্য ‍আর শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। এ শহর তাই পরিণত হয সমৃদ্ধিশালী নগরে।

কিন্তু ১৯৬৫ সালের দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বেশ ক’টি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হলে প্রাণসায়রের মৃত্যুযাত্রা শুরু হয়। প্রাণসায়রের পচা পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর
স্লুইস গেট গড়া হয় ইছামতির হাড়দাহ খাল, কলকাতার খাল, বেতনা নদীর সংযোগ খাল, বালিথা, খেজুরডাঙি নারায়ণজোল ইত্যাদি স্থানে। এরই ধারাবাহিকতায় খোলপেটুয়া নদীর ব্যাংদহা খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণের  চেষ্টা শুরু হলে প্রাণসায়রের মরে যাওয়া নিশ্চিত হয়। নদীর স্রোত খালের মধ্যে ঢুকতে না পেরে পলি জমে ভরাট হতে থাকে প্রাণসায়র।

এরপর খালটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বন্ধ হয়ে যায় সরকারি সম্পদ চুরির মচ্ছবে। পাকা দালানের নিচে এ খালের চাপা পড়তে আর খুব বেশী সময় হয়তো লাগবেই না।

আরো পড়ুন
** কুমির ফোটে করমজলে
** সুন্দরী বেয়ে বাঘ-কুমিরের কটকায়
** হিরণ পয়েন্টে হৃৎকম্পন
** ঘুম সাগরে জল অভিযান
** চাঁদের সাথেই মাছের প্রেম
** দুবলার সৈকতে মৃতদের মিছিল!
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
**
দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad