ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র! হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। ছবি: ডিএইচ বাদল ও মানজারুল ইসলাম

কে যেনো বলে উঠলো, মুড়ি ছড়াও, সব সামনে চলে আসবে! মুড়ি আনতে ছুট পড়লো কিন্তু তার আর দরকার পড়লো না- ক্যামেরা দেখেই কুপোকাত। গোলপাতার আর সুন্দরী গাছের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো গোটাছয়েক বানরছানা।

সুন্দরবন থেকে: কে যেনো বলে উঠলো, মুড়ি ছড়াও, সব সামনে চলে আসবে! মুড়ি আনতে ছুট পড়লো কিন্তু তার আর দরকার পড়লো না- ক্যামেরা দেখেই কুপোকাত। গোলপাতার আর সুন্দরী গাছের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো গোটাছয়েক বানরছানা।


হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রএর মধ্যে একজন একটু বেশিই ফটোপ্রেমী। কায়দা করে দল থেকে আলাদা হয়ে বসলো গোলপাতার ডালে। পাতার ডগা হাতে নিয়ে পোজ দিয়ে আটখানা। ভাবটা এমন- এই দেখো কী দারুণ পোজ দিয়েছি, এবার ছবি তোলো।
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। লোক জুটে গেলো। সমানে ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। ওদের উৎসাহও যেনো চারগুণ! মাটি থেকে তিড়িং করে লাফিয়ে গাছে, ডাল থেকে অন্য গাছ- নেচে-কুঁদে ভেংচি কেটে একেবারে একশেষ।

হঠাৎ যে যেদিক পারে ছুট। কী হলো, কী হলো? বেশ ডাটের সঙ্গে গোলাপাতার হেলানো ডাল বেয়ে হেঁটে এলো বড়-সড়োগোছের এক বানর। মেজাজ আর চলনে-বলনে বুঝিয়ে দিলেন, মহোদয় এই মহলে হোমরা-চোমরা ও নেতাগোছের কেউ। এসেই আশির দশকের রুপালি পর্দার ট্রেডমার্ক ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান লুক’। যার অর্থ, আমি থাকতে অন্য কারও ছবি! স্রেফ চলবে না! তোলা হলো তার ছবিও।
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র।  ততোক্ষণে মুড়িও এসে গেলো। একটু পরিষ্কার জায়গা দেখে ছড়িয়ে দিতেই যে যেদিক থেকে পারে ছুটে এলো খেতে।

খুলনা লঞ্চঘাট থেকে ছয় ঘণ্টা এবং মংলা থেকে লঞ্চে দুই ঘণ্টার দূরত্বে পশুর নদীর কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে ঢুকতে অনুমতি নিতে হবে দুই জায়গা থেকে। এক, এই ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ থেকে। এখানে জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ৭০ টাকা। দ্বিতীয় কর্তৃপক্ষ, ঢোকার মুখে ডানদিকে সুন্দরী-গোলপাতার ঝোপে থাকা ওই বানর দল। এক্ষেত্রে পাস, কিছু মুড়ি-বিস্কুট। তাও ভালোবেসে!

ঢুকে নাক বরাবর হাঁটা লাগালে হাতের ডানে পড়বে হাড়বাড়িয়া রেঞ্জ ফাঁড়ির দফতর, বামদিকের পথ মিশেছে পশুরে। কোল ঘেঁষে যতোদূর চোখ যায় সুন্দরী-গোলপাতার ঝোপ।

গোটা ইকো কেন্দ্র ঘুরে চোখে-মুখে সীমাহীন মুগ্ধতা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহ শিক্ষক সমিতির (উচ্চ বিদ্যালয়) ৮৫ জনের একটি দল। তিনদিনের সুন্দরবন ভ্রমণে তারা এসেছেন। এরপর ঘুরবেন হিরণ পয়েন্ট ও কটকা।
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। সবার হয়ে ঘোরার অনুভূতি জানালেন নারিকেলবাড়িয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতিকুল ইসলাম, দারুণ লেগেছে!
 
তার কথাকে পুঁজি করে পা এগোয়। ভুল বলেননি। ডানদিক দিয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকে গেছে বুনো খাল, জলে গোলপাতার শ্যামল ছায়া। পেরোতে হয় কাঠের সাঁকো।

দু’দিকে সুন্দরী গাছের সারি যেনো মুচকি হেসে বলে, ইয়ে তো ট্রেলার হ্যায়, পুরি পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। মুগ্ধতার টিকিট বুকপকেটে নিয়ে একটু হেঁটে এগুলে ডানদিকে লাল শাপলাভর্তি পানীয় জলের পুকুর। বন বিভাগের অপারেশনাল দক্ষতাবৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্মরণে ১৯৯৭-৯৮ সালে এটি খনন করা। সারাবছর পুকুরজুড়ে ফুটে থাকা শাপলার দল এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের হাতছানি দেয়।
 
একটু এগিয়ে শুরু কাঠের দীর্ঘ ওয়াক ওয়ে। ফাঁড়ির তথ্যমতে, প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটারের এ ওয়াক ওয়ে এক হাজার বর্গ হেক্টরের হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রকে ঘুরিয়ে আনে।
 
এটি সুন্দরবনেরই অংশ। পড়েছে চারটি রেঞ্জে ভাগ হওয়া সুন্দরবনের চাঁদিপাইয়ে।
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। কাঠের তক্তার দীর্ঘ পথ ঢুকে গেছে সুন্দরী, গরান, গেওয়ার ভিড়ে। একটু পরপর দীর্ঘ কয়েক পুরুষের পরম্পরা নিয়ে গেড়ে বসেছে গোলপাতা পরিবার। তবে ইকো কেন্দ্রজুড়ে আকাশমুখী শ্বাসমূলের দাপট বলে দেয়, এ অংশে সুন্দরী গাছের আধিক্যই বেশি। শ্বাসমূলের সঙ্গে লাল কাঁকড়ার আবার দারুণ বন্ধুতা। বন্ধুকে চোখছাড়া করবে না বলেই ঘর বেঁধেছে আশেপাশেই। এমনিতে নিজ পাড়ার পালোয়ানের মতো বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়, তবে পায়ের আওয়াজ পেলেই সুড়ুৎ করে সোজা গর্ত। চুপিচুপি চোখ রাখলে দেখা মিলবে, মানুষের পায়ের ছাপে জল জমে তৈরি হওয়া ছোট্ট পুকুরে ওদের ডুবসাঁতার!
 
পত্রপল্লভের ফাঁক-ফোকর দিয়ে চোখে-মুখে এসে লাগে পৌষের মিঠেরোদ। মাথার উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বৃক্ষশাখা আকাশ ঢেকে দেয়। কখনও ঘাড়ে এসে চুপিসারে নিঃশ্বাস ফেলে। মন হারিয়ে যায়!
 
ওয়াক ওয়ে বাঁক নেয়। দেখা হয় সম্মেলনের দেশ সুইজারল্যান্ডের মেয়ে সুজানার সঙ্গে। বন্ধু আর গাইডসহ ঘুরতে এসেছে বাংলাদেশ। কেমন লাগছে? তার উত্তর, ‘ইটস বিউটিফুল’!
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। আমলে নিতেই হয়, যখন বলিউডি গানের সত্তর ভাগ শ্যুটিং হওয়া দেশের মেয়ে এরকম বলে।
 
ভাগ্য ভালো হলে দেখা মিলবে বাঘমামার পায়ের ছাপ। এদিনও দেখা মিললো। তবে এর বেশি ভাগ্য কেউ বোধহয় চাইবেন না!
 
সব বনেরই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য প্রায় একরকম। বনের নিজস্ব একটা ভাষা থাকে। কিন্তু সুন্দরবনের ব্যক্তিত্ব একটু অন্যরকম। সেটি ভৌগলিক ও গঠনগত কারণে তো বটেই, এছাড়াও এর উপস্থাপন ও আলিঙ্গনের ধরন অন্যদের চেয়ে আলাদা। সেই আলাদা বিষয়টি কী? এটা রহস্যই থাক। তবে এটুকু বলা যায়, এর অনেকটা অনুভূত হবে হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে।
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। ওয়াক ওয়ে শেষ হয় কাঠের ওয়াচ টাওয়ারের  গোড়ায়। এটিও দেখার মতো। নান্দনিক এ টাওয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বনের রসায়ন খানিকটা অনুভব করা যাবে। তবে একসঙ্গে ছয়জনের বেশি উঠতে মানা। না হলে একেবারে হুড়মুড়িয়ে…
 
হাঁটা যেখান থেকে শুরু সেখানে ফেরার দু’টি পথ- ওয়াক ওয়ে ধরে আবার পিছনে যাওয়া, নতুবা ওয়াচ টাওয়ার বামদিকে রেখে পথ ধরে এগিয়ে গেলে আবারও দেখা হবে শাপলাদলের সঙ্গে। বাকিপথ আপনার চেনা।
 
ঢুকতে বা বেরুতে- দুই সময়ই চোখে পড়বে বিশাল বোর্ডে টাঙানো বনবিভাগের নির্দেশমালা। বন ও বন্যপ্রাণীর স্বার্থে অক্ষরে অক্ষরে সেটি মেনেই চলাই উভয়ের জন্য মঙ্গল।
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। দু’ধারে সুন্দরবন রেখে পশুর নদী এঁকে-বেঁকে একেবারে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এর ঠিক শেষ মাথার একদিকে হিরণ পয়েন্ট, অন্যদিকে কটকা, দুবলার চরসহ অনেক দর্শনীয় জায়গা। সবাই এ জায়গাগুলো ধরেই সুন্দরবন ঘুরতে আসেন। অনেকে হয়তো জানেনই না যাওয়ার পথে ঘণ্টাখানেক সময় ব্যয়ে মিলবে হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র।
 
যখন বেরোচ্ছি তখন ঢুকছে ৩০-৩৫ জনের আরেকটি দল। তাদের মধ্যে রবিউল এখানে আগেও ঘুরে গেছেন। তিনিই বাকিদের এখানে নিয়ে এসেছেন। তার ভাষ্যে, ভাই এ জায়গা কী না দেখে যাওয়া যায়!

আরো পড়ুন...

** এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে


বাংলাদেশ সময়: ১২১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
এসএনএস সহযোগিতায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।