ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ধুঁকছে ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৬
ধুঁকছে ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক ছবি: বাদল-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক থেকে: শুক্রবার (৮ এপ্রিল)। সকাল সাড়ে ১০টা।

ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ভেতরে প্রবেশ করতে বেগ পেতে হয়নি।

অথচ নিকট অতীত বলছে, বছর কয়েক আগেও এখানকার চিত্র ছিলো ভিন্ন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকমুখর থাকতো এ পার্ক। বিশেষ দিনগুলোতে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ করতো মানুষ। এখন আর সে দৃশ্য নেই। তবুও অল্প-স্বল্প যারা আসছেন তারা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কেন? সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে সকাল-বিকেল পার্কটিতে অবস্থান করে এর উত্তরও খুঁজে পাওয়া যায়। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে পার্কটির অবস্থান। প্রায় নয়শ’ হেক্টর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কটি। ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক নামেই এটি বেশি পরিচিত। শুক্রবার এ সাফারি পার্কে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের সাইনবোর্ড। তবে কচ্ছপের জন্য নির্ধারিত কাঁচের গ্লাসের সামনে গিয়ে সাইনবোর্ডে দেওয়া তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। অনেক প্রজাতির কচ্ছপের তথ্য দেওয়া থাকলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব মেলেনি।
সাইনবোর্ডে বলা হচ্ছে, শিলা কচ্ছপ, বড় কড়ি কাইট্টা কচ্ছপ, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ, সুন্দি কাছিম, কালি কাইট্টা রয়েছে। বাস্তবে এ প্রজাতির একটি কচ্ছপও পাওয়া যায়নি। অযত্নে মরে গেছে এসব কচ্ছপ। তবে বোস্তামী কাছিম, ডিবা কচ্ছপসহ এরকম দু’তিনটি প্রজাতির কচ্ছপ দেখা গেলেও এগুলোরও যেনো শেষ অবস্থা! দেখারও যেনো কেউ নেই! আনন্দ আর অ্যাডভেঞ্চারের জন্য এ সাফারি পার্কে এলেও তা কারো কারো কালও হতে পারে। আসামি বানরের খাঁচার ভেতর থাকার কথা থাকলেও তা খাঁচার ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে মানুষের ওপর হামলে পড়ছে।

শুক্রবার দুপুরে দেখা গেলো, বাবা মায়ের সঙ্গে আসা এক শিশুর পিঠে এসে সওয়ার হলো একটি বানর। তখন শিশুটি ভয়ে-আতঙ্কে মুষড়ে পড়ে। এক পর্যায়ে শিশুটির হাতের আঙুলে বানরের আঁচড়ও লাগে। প্রায় প্রতিদিনই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেলো।

সাফারি পার্কে দায়িত্বরত কয়েকজন জানালেন ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার ঘটনাও। গত, ২৭ শে মার্চ সাফারি পার্কের বাঘশালা থেকে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার খাঁচার ফটক খোলা পেয়ে বের হয়ে যায়। এ  ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে পর্যটক ও স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করে। পরে অনেক কষ্টে বাঘটিকে খাঁচায় ফেরানো হয়। জানা গেলো, আগেও কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এমনকি সাফারি পার্কটিতে বিগত সময়ে পৃথক ঘটনায় বাঘের হিংস্র থাবা থেকে দু’টি তরতাজা জীবনও রেহাই পায়নি। এ ঘটনা বড় উদাহরণ হয়ে আছে পার্কটিতে।

পার্কে আসা অনেকেই ভয়ে আতঙ্কে চলাচল করছেন। এখানে আসা আগতরা বলছেন, পার্কটির সঠিক তত্ত্বাবধানে কেউ নেই। শুক্রবার সারা দিনেও সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক (রেঞ্জার) মো. নুরুল হুদার দেখা মেলেনি। এদিন তার সাপ্তাহিক ছুটি না থাকলেও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অবস্থান করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে দেখা করতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি আমার কাজে ব্যস্ত আছি। ’
তার সুবিধামতো দেখা করার সময় চাইলেও সাফারি পার্কের ভেতর ব্যস্ত আছেন বলে জানান রেঞ্জার।

সাফারি পার্কে দায়িত্বরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এদিন রেঞ্জার (নুরুল হুদা) আসেননি।

পার্কের ভেতর দেখা যায়, কেউ কেউ খাঁচার ভেতর থাকা প্রাণীর দিকে ঢিল ছুঁড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন।

সাফারি পার্ক দেখতে আসা শরাফত হোসেন বলেন, ঘুরে নানা অনিয়মই চোখে পড়লো। কোনো গাইড নেই। ভীতিকর কিছু জায়গায় লোকজন থাকা উচিত। কাউকে দেখা গেলো না। এছাড়া পার্কজুড়ে ময়লা আবর্জনা।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে রক্ষিত বন্যপ্রাণির মোট সংখ্যা ৩৬২। এর মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ১৪৯, সরীসৃপ ১৫২ ও পাখি প্রজাতির সংখ্যা রয়েছে ৬১। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে বাঘ, সিংহ, হাতি, মায়া হরিণ, প্যারা হরিণ, বন্য শূকর, খরগোশ, হনুমান, বাঁশ ভালুক, বনগরু বা গয়াল, বাঘডাসা, বনবিড়াল, মার্বেল বিড়াল, চিতাবিড়াল, বনরুই, সজারু, বাদুর, লজ্জাবতী বানর, আসামি বানর, উল্লুক, কালো ভালুক, সাম্বার, শিয়াল, মেছো বাঘ, জলহস্তীসহ আরও কিছু প্রজাতির পশু-পাখি। তবে প্রতিদিনই প্রাণীর সংখ্যা কমছে। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ, ঠিকসময়ে খাবার না দেওয়া এবং পরিচর্যার অভাবে এ সাফারি পার্কে পশু-পাখির সংখ্যা কমছে।

পুরো পার্কে দায়িত্বরতদের অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা ছিলো লক্ষণীয়। দুপুরে দেখা যায়, বন্দি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাঁচায় দু’জন কিশোর ঢিল ছুড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। পরে আরেক দর্শনার্থীর অনুরোধে তারা ঢিল ছোড়া বন্ধ করে। বাঘের খাঁচার দায়িত্বেও তখন কাউকে দেখা যায়নি।

দেশের অন্যতম পরিবেশবান্ধব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কটি উঁচু-নিচু টিলার চিরসবুজ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণির আবাসস্থল উন্নয়নের জন্য এবং শিক্ষা গবেষণা, ইকোটুরিজম ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ১৯৯৮-৯৯ সালে যাত্রা শুরু করে।

কক্সবাজার জেলার ডুলাহাজরা বনাঞ্চলের ডুলাহাজরা ও হারগাজা ব্লকের ৯শ’ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে এ সাফারি পার্কটি অবস্থিত। চট্টগ্রাম জেলা শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণে কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্বপাশে চকোরিয়া উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে সাফারি পার্কটি স্থাপন করা হয়েছে।
 
নানা কারণে পার্কটির গুরুত্ব থাকলেও অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় চলছে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক বছরে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে পার্কটিতে।

পার্কের ভেতরে কথা হচ্ছিল চট্টগ্রাম থেকে আসা যুবক আশরাফুল ইসলাম কফিলের সঙ্গে।  তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে আমার আত্মীয় এসেছিলো এখানে ঘুরতে। ভেতরে তার স্ত্রীসহ ঘুরছিলো। বেশি ভেতরে যাওয়ার পর কয়েকজন ছিনতাইকারী তার মোবাইল, মানিব্যাগ এবং স্ত্রীর পার্স নিয়ে সটকে পড়ে। জানা যায়, এক সময় গগনচুম্বী গর্জন, বৈলাম, তেলসুর, সিভিট, চাপালিশ, চম্পা ফুল, লতা-গুল্মরাজির চিরসবুজ এ বনাঞ্চলে দেখা মিলতো হাতি, বাঘ, হরিণ, ভল্লুক, বানরসহ অসংখ্য প্রজাতির। কিন্তু অনিয়ম, অযত্ন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এবং অবৈধ শিকারের ফলে এ বনাঞ্চলের অসংখ্য বন্যপ্রাণি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বন্যপ্রাণি প্রাকৃতিক পরিবেশ, খাদ্যচক্র ও জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

জীবজন্তুর চিকিৎসার জন্য রয়েছে পশু হাসপাতাল। শুক্রবার এ হাসপাতালটিতে গিয়ে কাউকে দেখা যায়নি।  

ঘুরে দেখা যায়, কুমির বেষ্টনীতে স্থাপন করা হয়েছে ওয়াচ স্টেজ। বিচরণরত পশুপাখির জন্য তৈরি করা হয়েছে এনিম্যাল ফিডিং স্পট। এছাড়া পাখিশালা নির্মাণ, বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় এশীয় ও আফ্রিকান গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণিও সংগ্রহ করা হয়েছে।

তৈরি করা হয়েছে পর্যটন টাওয়ার। ৬০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে বাঘ, ৪০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে সিংহ, ৫০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে সাম্বার, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, গয়াল ও অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর জন্য বেষ্টনীও তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বন্যপ্রাণির জন্য ৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে আটটি জলাধার, ২০ হেক্টর এলাকা নিয়ে ভল্লুকের বেষ্টনী, ১০ হেক্টর এলাকা নিয়ে কুমিরের বেষ্টনী, ৫ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে জলহস্তীর বেষ্টনী এবং ১৫০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে হাতির বেষ্টনী। এতো কিছু করা হলেও নেই সঠিক পর্যবেক্ষণ।

এখানে পর্যটকদের জন্য বন্যপ্রাণি দর্শনে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। তবে সে টাওয়ারে ওঠার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সিঁড়িতে গাছের কাঠ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা করে রাখা হয়েছে।

তানভীর হোসেন নামে এক পর্যটক পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের সামনে এসে বলেন, এটা করে লাভ কী হলো, যদি ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা দিয়ে রাখা হয়। দায়িত্বরত কাউকে না দেখে তিনি ক্ষোভও প্রকাশ করেন।

সাফারি পার্কটিতে আসা পর্যটকরা জানান, এতোবড় উদ্যানে চলার জন্য গাইড নেই। কারও সহযোগিতা নিয়ে চলারও উপায় নেই।

তিনি বলেন, এখানে বেশ কিছু রিস্কি জায়গা আছে, যেগুলো পর্যটকদের জন্য বিপজ্জনক। তাই গাইড বা সহায়ক থাকা প্রয়োজন।

সাফারি পার্ক থেকে বেরিয়ে ন্যারাচাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে গিয়ে দেখা যায় করুণ অবস্থা। দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান করলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ২ হাজার প্রাণীর দেহাবশেষ, স্পেসিমেন ও স্টাফিং সংগ্রহ করে মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। ৩শ’ প্রজাতির গাছপালার হারবেরিয়াম সিট তৈরি করে মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করা হয়েছে। এ মিউজিয়াম থেকে পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা বিপদাপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতেও সক্ষম হবেন। এমন গুরুত্ব থাকলেও তা পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৬
এডিএ/এমজেএফ

** রানওয়েতে কুকুর, বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা
** বিশ্বসেরা সার্ফিং ভিলেজ কক্সবাজার
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।