ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বয়সটা কম, তবুও কাঁধটা ‘বড়’ তাদের..

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৬
বয়সটা কম, তবুও কাঁধটা ‘বড়’ তাদের.. ছবি:বাদল- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পর্যটন মোটেল শৈবাল থেকে: রিকশা চালক আব্দুল মালেক। টমটমের দৌরাত্ম্যের এই শহরে সেই রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে দিনে ক’ টাকাই বা আসে তার? বড়জোর ২০০ টাকা।

এই টাকায় সংসার চালাতে যেখানে হিমশিম খান, সেখানে আবার সন্তানের পড়াশোনা!

বাবা আব্দুল মালেকের এই অন্ধকার সংসারে যেনো ‘আলো’ নিয়ে হাজির হলেন ছোট্ট মেয়ে তানিয়া। বয়স কত? টেনেটুনে আট হবে হয়তো। স্থানীয় ব্রাক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সে। তবে, তার জীবন শুধুমাত্র ‘ছাত্রী’ শব্দে বেঁধে নেই। এই বয়সেই পড়াশোনার পাশাপাশি টানছেন সংসারের ‘হাল’।

সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা। প্রতিদিন এই সময়টাতে ক্লাসরুমের মনোযোগী ছাত্রী সে। তবে স্কুল ছুটিশেষে বিকেল বেলায় তার সমবয়সী অন্য বন্ধুরা যখন খেলাধুলায় মেতে থাকে কিংবা ঘুমের ঘোরে আরামের আয়েশ খোঁজে, তখন তার গন্তব্য সমুদ্র সৈকত। সঙ্গে অবশ্যই পিঠে ছোট্ট একটি থলে। সেই থলে ঠাসা থাকে শামুকের তৈরি মালা আর ঘরসজ্জ্বার নানা জিনিসে।

মঙ্গলবার (০৫ এপ্রিল) সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার আশেপাশে সময়। লাবনী পয়েন্ট এলাকায় ছোট্ট তানিয়া পর্যটকদের কাছে ধরণা দিচ্ছে আর বলছেন ‘একটা মালা কিনুন না প্লিজ’। তার মায়াময় মুখটার দিকে তাকিয়ে কেউ কিনছেন, আবার কেউবা ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

এর এক ফাঁকে কথা হয় তানিয়ার সঙ্গে।

সে বাংলানিউজকে বলে, ‘প্রতিদিন একদম সকালে এসে সৈকতে ভেসে ওঠা বিভিন্ন শামুক কুড়িয়ে নিয়ে যাই। এরপর বাসায় গিয়ে সেই শামুকগুলো রেখে স্কুলে চলে যাই। এই সময়টাতে আমার মা শামুকগুলো দিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও ঘরসজ্জ্বার জিনিসপত্র বানায়। আমি স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের ভাত খাওয়ার পরেই সৈকতে চলে আসি। ’

দিনে কত টাকা বিক্রি হয় এমন প্রশ্নে তানিয়া বলে, ‘দিনে ১৫০-২০০টাকা বিক্রি হয়। তবে, মাঝে মাঝে আরও বেশি বিক্রি হয়। যা বিক্রি হয় তার মধ্যে তিনভাগের দুই ভাগ লাভ থাকে। ’

তানিয়া বলে, ‘বাবা রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে পারে না। আমরা তিন ভাইবোন। আমার এই সামান্য টাকাও ঘরের অনেক কাজে আসে। ’

তানিয়াকে বিদায় দিয়ে সুগন্ধা পয়েন্টের দিকে এগুতেই দেখা মিলল আরেক শামুক বিক্রেতা শিশুর সঙ্গে। নাম তার নুর হোসেন। সুকনাছড়ি শিখন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সে। এখনও ঠোঁটে ওপর একেবারেই অদৃশ্য গোঁফের রেখা। বোঝাই যায় বয়স ১০ এর চেয়ে বেশি হবে না।

নুর হোসেন বলে, ‘বাবা এজহার হোসেন উত্তাল সমুদ্রে অন্যের নৌকায় মাছ ধরে বেড়ান। তবে, তেমন বেতন পান না। কি আর করা আমিও নেমে পড়লাম টুকটাক ব্যবসায়। আমার দিনে ৫০০-৬০০টাকা বিক্রি হয়। এর মধ্যে অনেক টাকায় লাভ হয়। আমার টাকায় সংসার ভালোই চলছে। ’

নুর হোসেনরা চার ভাইবোন। তার গল্পটাও প্রায়ই তানিয়ার মতো। মা রশিদা বেগম দিনভর মালা আর নানা ঘর সজ্জ্বার জিনিস বানান। আর সেগুলো সৈকতে বিক্রি করে বেড়ায় নুর হোসেন।

‘আগে স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের ভাত খেয়ে দুইটার মধ্যে সৈকতে চলে আসতাম। এখন একটু দেরি করে আসি। এখন আসি চারটা বাজে। ’

এখন দেরি করা আসার কারণ জানতে চাইলে নুর হোসেনের নিচু গলায় উত্তর, ‘সামনে প্রাইমারি স্কুল সার্টফিকেট (পিএসসি) পরীক্ষা। তাই স্কুল থেকে ফিরেও বাসায় পড়াশোনা করছি। ’

‘রেজাল্ট ভালো করতে হবে। যত কিছুই হোক পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে চাই। ’ সাহসী জবাব নুর হোসেনের।

সৈকতে এমন আরও অনেক শিশুর দেখা মেলে। সংখ্যাটাও কম না। ৩০ থেকে ৪০ তো হবেই।

পড়াশোনার অবসরে শামুক আর নানা খাবারের জিনিসপত্র বিক্রি করা। সূর্য যখন ঢুবে যায়, নেমে আসে অন্ধকার, কমে যায় পর্যটকদের আনাগোনা, তারাও তখন ফিরে যায় ঘরে। এরপর পিঠের সেই থলেটা তুলে রেখে পড়ালেখায় ডুব। সকাল হলেই স্কুলে দৌঁড়।

এদের কারও নাম তানিয়া, কারও নাম নুর হোসেন, কারওবা তামিম-মরিয়ম।
তারা সবাই অনেক ছোট্ট। প্রায় সবার বয়সই ৬ থেকে ১০ এর ঘরে। তবে, ছোট্ট এসব শিশুর কাঁধটা যেনো একটু ‘বড়ই’।

না হলে পড়ালেখা আর ফেরিওয়ালা জীবন একসঙ্গে চালানোর এত আলো কোথায় পায় তারা?



বাংলাদেশ সময়: ২২২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৬
টিএইচ/এমজেএফ/পিসি

** প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চলছে ঝুঁকিপূর্ণ ‘জেট স্কি’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।