ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

শনিবারের স্পেশাল রিপোর্ট

আমহাটীর চামড়ায় সারাদেশে বাজে ঢাক-ঢোল

আসিফ আজিজ ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৬
আমহাটীর চামড়ায় সারাদেশে বাজে ঢাক-ঢোল ছবি: শুভ্রনীল সাগর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চক আমহাটী, নাটোর থেকে ফিরে: রাস্তার পাশ কিংবা বাড়ির সামনের এক চিলতে খালি জায়গায়ও খালি নেই। ছোট ছোট কাঠি দিয়ে আটকানো সাদাটে ঘিয়ে রঙের বিভিন্ন আকৃতির চামড়ায় ঢাকা।

দেখতে বেশ নান্দনিক। পাশের সরিষা খেতের পাশের খালি জায়গাটিরও একই হাল। গোলপাতা-খড়চালা ঘরগুলোর বারান্দায় ঝুলছে বড় বড় লোমশ চামড়া। কেউ ব্যস্ত শিল-পাটায় হরিতকি পিষতে।

সবার লক্ষ্য একটাই- সারাদেশকে মাতাতে হবে সুর-তাল-লয়ে। ঢোল, ডুগি, তবলার চামড়া বানান তারা। এটাই তাদের পেশা। কয়েক পুরুষ ধরে এ পেশা এখন পরিণত হয়েছে নেশায়। অন্য কোনো কাজের কথা ভাবতে পারেন না তারা। যদিও এ পেশায় থেকে পেট চালানো খুব সহজ নেই এখন।

নাটোর শহর থেকে কিলোমিটারখানেক দূরত্বের গ্রাম আমহাটী। ডুগি, তবলা, একতারা, ঢোলের গ্রাম হিসেবেই চেনে গ্রামটিকে। রোদ এ গ্রামের প্রাণ। সবুজে রোদ মিশলেই চকচক করে ওঠে এ গ্রামের মানুষের চোখ। ঢোলের জন্য বিশেষভাবে প্রসেসিং করা চামড়া তৈরি হতে রোদের বিকল্প নেই।

শেষ বিকেলে অটোরিকশাযোগে আমহাটী পৌঁছেই শুকাতে দেওয়া চামড়ার দেখা। একটু এগিয়ে যেতেই এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। বেশ বদমেজাজি! মিডিয়া দেখে কোনো কথা তো বলতে চাইলেনই না, বরং অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করলেন। তার কথা একটাই, আমাদের কথা বলে কি লাভ। অনেকেই তো আসে। আমাদের তো উন্নতি হয় না।

কথা বেশি না বাড়িয়ে সামনে গিয়ে দেখা গেলো সরিষা খেতের পাশের খালি জায়গায় শুকাতে দেওয়া হয়েছে চামড়া। এটা মোটামুটি শেষ ধাপের কাজ বলা যায়। প্রতিটি চামড়াই পাঠা ও খাসির। কিনারজুড়ে ছিদ্র করে টান টান করে তাতে কাঠি দিয়ে মাটিতে পোতা। দেখতে চমৎকার।

চারপাশে এতো চামড়া থাকার পরও নাকি রোদ ওঠেনি বলে কম দেখা যাচ্ছে! মনে মনে ভাবলাম রোদ থাকলে তো এটা চামড়ার রাজ্য হয়ে ওঠে।

ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলাম প্রবীণ চামড়ার কারিগর কমল চন্দ্র দাসের বাড়িতে। ইনি অবশ্য মোটামুটি স্বচ্ছল মনে হলো। পাকা বাড়ি। সামনে সবজি বাগান। বাইরের উঠানজুড়ে চামড়া শুকাতে দেওয়া হয়েছে। তার ছেলে অমল চন্দ্র দাসও কাজ করে ১৬ বছর থেকে। এখন তার ২১ বছর।

কথা বলতে বলতে নিয়ে গেলেন বাড়ির পাঁচিলের ভিতরে। স্তূপ করা চামড়া দেখিয়ে জানান, এখানে ২-৩শ চামড়া আছে। নাটোর স্টেশন আড়ত থেকে কেনা। পাড়ার সবাই এখান থেকে চামড়া কেনে। পাঠা ও খাসির চামড়াই বেশি। তবে গরু-মহিষের চামড়াও আছে। ভেড়ার আছে কম। লবণ দিয়ে এভাবে কাঁচা অবস্থায় ৫-৬ মাস রাখা যায়।

পাশের আরেকটি ঘরে চামড়া থেকে মাংস ও লোম ছাড়িয়ে লবণ দিয়ে স্তূপ করে রাখা। রোদ হলে এগুলো টান টান করে শুকানোর অপেক্ষায়।

ঢোল, খোল, তবলা, ডুগি, দোতারা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বানাতে এ চামড়াই ব্যবহার করা হয়। তবে বাইরে টাঙানো গরু, মহিষের চামড়া ঢোল-তবলার বেল্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খোল তৈরিতে কিছু গরুর চামড়া লাগে। আর রং করতে ব্যবহার হয় হরিতকির রস। জানালেন কমল।

পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই যে লবণ মাখানো সাদা চামড়া দেখে এলেন, ওটা রোদ হলেই এভাবে কাঠি দিয়ে আটকে টান টান করে শুকাতে দেওয়া হবে। প্রথমে চামড়াগুলো পাথর চুন দিয়ে পানিতে ৫-৭ দিন বড় মাটির চাড়িতে ভিজিয়ে রাখা হয় ভাঁজ করে। লোম নরম করার জন্যই মূলত এ ব্যবস্থা। এরপর ৭ দিন পর তুলে ছুরি দিয়ে ঘষে ঘষে লোম তোলা হয়। লেগে থাকা সামান্য মাংসও ছাড়ানো হয় এসময়।

চূড়ান্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, লোম তুলে ফেলে রোদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। রোদ হলে চামড়াগুলো টান টান করে সাইজ করে খোটা মারা হয়। ভালো রোদ হলে একদিনেও অনেক সময় শুকিয়ে যায়। আবার ৩ থেকে ৫ দিনও লাগে। শুকানোর পর শিরিস কাগজ দিয়ে ঘষে একটু উল্টে-পাল্টে বিক্রির উপযোগী করা হয়।

এ কাজে যুক্ত মূলত পরিবারের ছেলে সদস্যরা। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে রঙের জন্য হরিতকির রস বানিয়ে দেয়। পাশের বাড়ির বিকাশ, সুরেশও একই কাজে যুক্ত। বিকাশের স্ত্রী কাজলী জানালেন, বিকাশ বাড়ি নেই। হাটে গেছেন চামড়া কিনতে। তিনি হরিতকির রস বানাচ্ছেন।

কমল চন্দ্র দাস জানান, তিনি এ কাজ করছেন প্রায় ৪৫ বছর। তার ছেলেও এখন কাজ করে। তার পূর্বপুরুষরাও এ কাজে যুক্ত ছিলো। আগের তুলনা চাহিদা খুব কমেনি। তবে সে তুলনায় বাড়েনি দাম।

বিক্রি করে কেমন দাম পান, কারা কেনে- এসব প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রক্রিয়াজাতকরণের পর চামড়া বিক্রি হয় প্রতি ইঞ্চি হিসেবে। ২২ ইঞ্চি থেকে শুরু হয় মাপ। একটি ২২ ইঞ্চির চামড়া (গোলাকৃতির) বিক্রি হয় ১শ টাকা। এছাড়া ৩৪ কিংবা তার চেয়ে বড় চামড়া বিক্রি হয় মানভেদে ২শ থেকে সাড়ে তিনশ টাকায়। একশো টাকা বিক্রি করতে পারলে লাভ হয় ২০-২৫ টাকা।

মাসে ২শ বা তার কিছু বেশি চামড়া প্রস্তুত করতে পারেন তারা। এরমধ্যে প্রায় সবই বিক্রি হয়ে যায়। দেশের প্রায় সব জেলায়ই যায় তাদের চামড়া। সবচেয়ে বেশি যায় ঢাকা ও কুষ্টিয়া। লালনের আখড়ার অধিকাংশ দোতারা, ঢোল, ডুগি, তবলার চামড়া যায় আমহাটী থেকেই। পাইকার কিংবা ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে এসেই চামড়া কেনেন সবাই। ভালো বাদ্যের জন্য এ পাড়ার চামড়ার চাহিদা বেশি বলেও জানান তিনি।

পাড়া থেকে বেরিয়ে এবার ঢোল-তবলার কারিগরদের কাছে যাওয়ার পালা, যারা এ পাড়ার চামড়া নিয়ে বাদ্য বাজানোর ব্যবস্থা করেন। লালবাজার গিয়ে হাজির গনেশ সুর ভান্ডারে। কথা হলো কারিগর পলাশ কুমারের সঙ্গে। তবলা তৈরির কাজে ব্যস্ত তিনি। কাজ করতে করতেই কথা বললেন।

আমহাটী ঘুরে এখানে এসেছি শুনেই বলেন, আমরা তো ওখান থেকেই সব চামড়া কিনি। শুধু আমরা না, সারা দেশের লোক। এই যে দেখছেন, সব চামড়াই ওখানকার।

তিনি জানান, চামড়ার ভালো-মন্দ নির্ভর করে উপরের দানার উপর। মানে হাত বোলালে যে খস খস বাধে সেটা। দানা ভালো হলে বুঝতে হবে চামড়া ভালো।

পলাশ জানান, তবলা, ঢোল ও একতারা-দোতারার জন্য পাঠার চামড়া ভালো। ডুগি তৈরিতে ব্যবহার হয় ভেড়ার চামড়া। আর খোলের জন্য লাগে গরুর চামড়া।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৬
এসএস/এএ/এটি

** ডুবো সড়কে ডুবছে চলনবিল
** ঝাড়ফুঁক-সাপ ছেড়ে  ইমারতের পেটে!
** বিলের মাছ নেই চলনবিলের বাজারে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলে হাঁস পুষে লাখপতি (ভিডিওসহ)
** হালতি বিলে দাগ কেটে ক্রিকেট, ধুমছে খেলা (ভিডিওসহ)

** ভাসমান স্কুলে হাতেখড়ি, দ্বীপস্কুলে পড়াশোনা
** দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে
** একফসলি জমিতেই ভাত-কাপড়
** লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad