ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বৃষ্টিভেজা চন্দ্রনাথ পাহাড়ে-১

খাদের ওপর সরু সিঁড়িতে কলজে শুকিয়ে আসে

জাকারিয়া মন্ডল, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৫
খাদের ওপর সরু সিঁড়িতে কলজে শুকিয়ে আসে ছবি: সোহেল সরওয়ার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে: জামার নিচ থেকে পৈতেটা বের করে চাক্ষুস প্রমাণ দেখিয়ে দিলেন শম্ভুনাথ হোটেলের মালিক। বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ব্রাহ্মণ, তার হোটেলে খেলে জাত যাবে না।

তবে এখন খাবারের অর্ডার দিলে খেতে হবে কয়েক ঘণ্টা পরে, পাহাড় থেকে নেমে এলে।

অগত্যা বনরুটি-বিস্কুটে উদোর পূর্তি করে এগিয়ে চলা। অক্ষয় বটের নিচে এসে শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। গোড়ায় পূজার পসরা সাজিয়ে বসেছেন মাঝবয়সী এক নারী। তার কাছে পথের নির্দেশনা চেয়ে পড়তে হলো বিড়ম্বনায়। পথ বাতলানোর বদলে তার দোকানের উপকরণ কিনলে কি পূণ্য হবে সে বিষয়ে বয়ান দিলেন তিনি।

কিছু না কিনলে কি পাপ হবে তারও একটা ফিরিশতি দেওয়া শুরু করলেন। ওখান থেকে ছুটে অক্ষয় বটের পাশে রেলিং ঘেরা স্থানে প্রবেশ করতেই সুবিশাল এক পুকুর পাড়ে থমকাতে হলো। এ জায়গাটার নাম ব্যসকুণ্ড। পুকুরের পাড় জুড়ে শুধু  মন্দির আকৃতির সমাধি আর সমাধি। এক পাশে শশ্মান। বিভিন্ন বৃক্ষের নিচে পূজার নৈবেদ্য।

পুকুরের পাড় পেরিয়ে নজরে এলো ধোঁয়ার কুণ্ডলি। কাছে যেতে বোঝা গেলো, শব পোড়ানো হচ্ছে। সৎকার হচ্ছে বাবুল চন্দ্র শর্মা নামে ৫৫ বছর বয়সী এক সদ্য মৃতের।

চিতার আগুনে খড়ি দিচ্ছেন ক’জন। পাশে দাঁড়ানো মৃতের ভায়রা সাধন চন্দ্র শর্মা জানালেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখানেই মৃতের সৎকার করছেন তারা। শংকর মঠ ও ব্রহ্মানন্দ দাতব্য চিকিৎসালয় বাঁয়ে রেখে এবার সরু পিচঢালা পথ ধরে সামনে এগুনোর পালা। পিছু নিলেন টুপি পরা এক তরুণ। তিন জনের এই পরিব্রাজক দল সম্পর্কে অফুরন্ত জিজ্ঞাসা তার।

পাল্টা প্রশ্ন করে জানা গেলো, তিনি একজন পুলিশ সদস্য। নাম তার সাব্বির আহমেদ। বাড়ি চাঁদপুর। থাকেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মাথায়, মন্দিরের পেছনের পুলিশ ফাঁড়িতে। জুম্মার নামাজের জন্য নেমেছিলেন নিচে। অল্প অনুরোধেই বিনে পয়সার গাইড হতে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন তিনি।

কিছু দূর এগুতে হাতের বাঁয়ে পড়লো কেন্দ্রীয় মহাশশ্মান। এটিই বাংলাদেশের একমাত্র মহাশশ্মান যেখানে হিন্দু ও বৌদ্ধরা শেষ কৃত্য করে থাকে। তবে এখন আর বৌদ্ধদের শেষকৃত্য খুব একটা দেখা যায় না এখানে। শশ্মানের এক পাশে শিব, কালির মন্দির। ‍

কিন্তু এবার দরকার লাঠি। এমনিতেই আজ (শুক্রবার) আকাশের মন খারাপ। সকাল থেকে ঝির ঝির বৃষ্টি, ঝরছে তো ঝরছেই। পাহাড় বেয়ে ওঠার পায়ে চলা সরু পথ আর সিঁড়িগুলো বিপদজনক রকম পিচ্ছিল হয়ে আছে। লাঠি হাতে থাকলে সেটা যেমন পাহাড় বাওয়ার সুবিধে দেবে, তেমনি পতন ঠেকাতেও কাজে আসবে।

তাই পথের ধারে কাঠ কাটতে দেখে উৎসাহী হয়েই এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু ব্যস্ত কাঠুরে কোনো অনুরোধই কানে তুললেন না। এমনকি লাঠি বিক্রি করতেও রাজি হলেন না তিনি। খামাল দেওয়া সরু লাঠিগুলোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফের এগিয়ে চলা।  

এবার আর এক দোকানির কাছে লাঠি চেয়ে রীতিমতো ধমকই খেতে হলো। কিন্তু কপাল খুললো এর পরের বার। প্রথমে এক জনের কাছে একটি বাঁশের লাঠি জোটালেন সাব্বির। সেটি তুলে দিলেন বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মবিনুল ইসলামের হাতে। এরপর ৫২ বছর বয়সী সৌদি ফেরত আলাউদ্দিন চাওয়া মাত্রই আরো দু’টো লাঠি দিতে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। বলে দিলেন, টাকা তো নেবেনই না, লাঠিও ফেরত নেবেন না তিনি।

ফুরফুরে মেজাজে একটু সামনে এগুতেই বাঁয়ে পড়লো পাহাড়ি ছড়া। দূরে কোথাও থেকে আসছে ঝরনা চুয়ানো জলের ক্ষিণ একটা প্রবাহ। আর একটা প্রবাহ ডান থেকে এসে মিশেছে মূল প্রবাহে। পাহাড়ি নীরবতাকে যেনো স্বর্গীয় ছন্দে বাঁধছে কাঁকর-কাদা ধুয়ে বয়ে চলা জলের কুল কুল শব্দ।

ছড়ার ওপরের কংক্রিটের সেতু পেরিয়ে এবার শুরু হয় চন্দ্রনাথ পাহাড় বাওয়া। পিচঢালা সরু রাস্তা নাক বরাবর এগিয়ে গেছে উঁচু চড়াইয়ে। চড়াই ডিঙ্গিয়ে পাহাড়ের একটা সমতল ঘাড়ে আসতেই পথের পাশে হনুমান মন্দির।

রামায়নের সেই হনুমান বাবাজির মন্দির ঘিরে আগাছা গজিয়েছে। কাছে না গেলে ভেতরে কি আছে ঠাহর করা মুশকিল। কিন্তু হনুমান থাকলে রাম-সীতা থাকবে না তা কি হয়? হনুমান মন্দিরের উল্টো দিকে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের কোলের ভেতর কিছু দূর নামলে সীতা মন্দির, সীতা কুণ্ড। এই কুণ্ড থেকেই সীতাকুণ্ড নামের জন্ম বলে বিশ্বাস প্রচলিত আছে।

মিথ বলছে, বনবাসের সময়ে শরভঙ্গ মুনির আশ্রমে যান রাম, সীতা ও লক্ষণ। মুনি তাদের দেন পূর্বদেশ ভ্রমণের পরামর্শ। মহামুনি ভার্গব ধ্যানযোগে জানতে পারেন এ খবর। তাদের স্নানের জন্য তিনি ৩টি উষ্ণ পানির কুণ্ড সৃষ্টি করেন। এই পাহাড় ভ্রমণের সময়ে এসব কুণ্ডে স্নান করেন রাম-সীতা-লক্ষণ।

সব ক’টি কুণ্ডেই এখন শুকিয়ে গেছে। তবে সীতার কুণ্ডের স্থানটিতে গড়া হয়েছে মন্দির। একটু দূরে চৌবাচ্চা আকৃতির রামকুণ্ড ও লক্ষণ কুণ্ড।

সীতাকুণ্ড নামের জন্ম নিয়ে অবশ্য আর একটি জনপ্রিয় মিথ চালু আছে। এ মিথে বলা হচ্ছে, একবার এক মহাযজ্ঞ আয়োজন করেন দক্ষ রাজা। সেই যজ্ঞে শিব ছাড়া ত্রিভূবনের সবাইকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। শিবের মূর্তি বানিয়ে রাখা হয় প্রাসাদ ফটকে প্রহরী হিসেবে।

খবর পেয়ে ছুটে আসেন দক্ষ রাজারই কন্যা শিবপত্নী সতী। শিবের দারোয়ান মূর্তি দেখে লজ্জায় দেহত্যাগ করেন তিনি। উন্মত্ত শিব সতীর মরদেহ কাঁধে নিয়ে শুরু করেন প্রলয়নৃত্য। কাঁপতে থাকে পৃথিবী। নিরুপায় হয়ে বিষ্ণু তখন তার চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করতে থাকেন।

সতীর শরীরের মোট ৫১টি খণ্ড পতিত হয় ভারতের বর্ষের ৫১টি স্থানে। সেই স্থানগুলো পরিচিতি পায় শক্তিপিঠ হিসেবে। এমনই এক শক্তিপিঠ এই চন্দ্রনাথ পাহাড়।  

এখানে তার ডান হাত পতিত হয়। আর সতীর নাম থেকেই এ স্থানের নাম হয় সীতাকুণ্ড। সতীর ডান হাত চন্দ্রনাথ পাহাড়ের যে স্থানটিতে এসে পড়ে সেখানে এখন ভবানি মন্দির।

সীতাকুণ্ড নামকরণের গোলকধাঁধাঁ কিছু সময় চক্কর খাওয়ার পর ফের শুরু হয় পাহাড় বাওয়া। সরু পাকা রাস্তা শেষ হয় ভবানি মন্দিরের নিচে এসে। এই মন্দির  থেকে কিছু দূর উপরে উঠলে সয়ম্ভুনাথের মন্দির। এখানকার সয়ম্ভু মন্দিরটি নেপালে সম্ভুনাথ মন্দিরের মতো অতোটা বিশাল নয়। শিব চতুর্দশীতে বিশেষ পূজা হয় এখানে।

সয়ম্ভু মন্দিরের উত্তর পাশে অন্নপূর্ণা ও বিষ্ণু মন্দির। এই উপমহাদেশে তুর্কী আক্রমণের পর বিষ্ণু যুগের অবসান ঘটলেও এখানে এখনো নিয়মিত পূজা হয় বিষ্ণুর। আছে বিষ্ণু মূর্তিও। এমন মন্দির এখন বাংলাদেশে বিরলই বটে। পাশেই দেবি অন্নপূর্ণার মন্দির। আরো আছে জগন্নাথ মন্দির।

সম্ভুনাথ মন্দির পেরিয়ে আরো উপরের দিকে উঠতে থাকলে বাম পাশে প্রায় একশ’ ফুট নিচে গয়াকুণ্ড। এই কুণ্ডের মধ্য দিয়ে মন্থন নদী পূর্ব থেকে পশ্চিমের বয়ে গেছে বলে বিশ্বাস প্রচলিত আছে। এখানে পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করা হয়।

এই মন্দির পুঞ্জ পেরিয়ে আর একটু এগুতেই রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গেছে। বাঁয়ের রাস্তাটি মাটির। পাহাড় বাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু সারাদিনের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ওই রাস্তা এখন বিপদজনক। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এখন ওই পথে কেইবা যেতে চাইবে।

এখান থেকে খাড়া পাহাড়ের গায়ের সমৃণ শৈলশিরা যেনো সারি সারি মন্দিরের রূপ নিয়েছে। ওখানে ঝুপ করে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে শত শত ফুট। পাহাড়ের চূড়ায় আকাশের গায়ে চন্দ্রনাথ মন্দিরটাকে খেলনা ঘরের মতো ছোটো দেখায় এখান থেকে।

কাছেই কোথাও থেকে পাহাড়ি ঝরণার কুলকুল শব্দ ভেসে আসছে। বেশি কষ্টকর হলেও ডানের খাড়া সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় বাংলানিউজ টিম। কিন্তু সামনে গভীর খাদের ওপরে ঝুলন্ত রেলিংহীন সরু সিঁড়িটাকে দেখে কলজে শুকিয়ে আসে। এবার উপায়! (চলবে)।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।