ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ঝরনা রানী জাদিপাই পেখম মেলে বসে...

রিয়াসাদ সানভী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫
ঝরনা রানী জাদিপাই পেখম মেলে বসে... ছবি: শামীমা মিতু

বান্দরবান থেকে ফিরে: কেওক্রাডংয়ে সকালটা শুরু হলো আকাশটার গোমড়ামুখ দেখে। তবে পুব আকাশের রক্তচ্ছটা বলছে সূর্য উঠলেও উঠতে পারে! এমনই থাকুক, তাই ভালো।

আজ পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। যাদের টানে গহীন পাহাড়ে ছুটে আসা, আজ দেখা হবে তাদের সঙ্গে।

অনেক সকালে মানে ছটার মধ্যেই রওয়ানা দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ঘড়ির কাটা শত্রুতা করতে শুরু করেছে। ছোট খাট কাজগুলো সেরে নিতেই গড়ালো সকাল আটটা। এর মধ্যে চূড়া থেকে কিছু ভিডিও করা হলো। বোকা বাক্স কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে অভিজ্ঞতা বলে এ থেকে ভালো কিছু হলেও হতে পারে!

এরপর সকালের খাবার। সব মিলে সাড়ে আটটার আগে বেরোনো গেলো না। কেওক্রাডং থেকে পাসিং পাড়া যেতে বড়জোড় সাত কি আট মিনিট লাগে। মেঘের রাজ্যে জীবনের কোলাহল শুরু হয়ে গেছে। দূরে আবছা দেখা যাচ্ছে চিম্বুকের পাহাড় সারি। এর বহু নীচে মেঘেদের আনাগোনা। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পটভূমিতে কে নায়ক এ জীবন ছবির?

মেঘ, আকাশ না পাসিং পাড়ার আঙিনায় ছোটাছুটি করা শূকর ছানাটি। কাঁধের ব্যাগপ্যাকগুলো পাড়ার এক ঘরে জমা রাখলাম। ওঠার সময় যতটুকু নামবো ততটুকুই উঠতে হবে। পিঠ তাই যতটুকু হালকা রাখা যায়। পাসিং পাড়া থেকে উঁকি দিলেই চোখে পড়বে জাদিপাই পাড়া। কনান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি নেমে গেছে সেটি ধরে এগোলেই এ পাড়া। এ রাস্তায় নামার সময় পায়ের ব্রেক চাপতে হয় মাঝে মধ্যে। ব্রেকফেল হলে একেবারে জাদিপাই পাড়ার ঘরগুলোর চালের উপর পড়তে হবে।

ফ্রি ফলের মতো করে নামতে লাগলাম। মিনিট পঁচিশেক বোধহয় লাগলো জাদিপাই পাড়ায় নামতে। মিতু বারবার পিছিয়ে পড়ায় দেরিটুকু হলো। পাড়া থেকে জাদিপাই ঝরনায় যাওয়ার দু’টি রাস্তা রয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে পিচ্ছিল থাকায় পশ্চিমমুখী রাস্তাটায় গেলাম না। এটি বেশ খাঁড়া, একবার পা পিছলে গেলে হাড়গোড় ভাঙা, এমনকি জীবন সংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে। উপর থেকে দেখলে জাদিপাই পাড়াকে ছোট্ট মনে হয়। বাস্তবে আসলে এতটা ছোট না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িগুলো নিয়ে এটি মোটামুটি জমজমাট পাড়া।

জাদিপাই পাড়া ছাড়িয়ে উৎরাই ভেঙে আবারও নামতে লাগলাম। পাড়ার পাশে ঝিরির আওয়াজ অনেক কোলাহল ছাপিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির কল্যাণে ঝিরির আশপাশে জমজমাট অবস্থা। যেখানটায় নেমে এলাম সেটি সমতল এক বিশাল মাঠ। চারপাশে পাহাড় ঘেরা এ উপত্যাকায় হরেক ফসলের সমাহার। পুরো মাঠ কাদা পানিতে একাকার। তৌহিদ বললো এখানে কখনো পানি থাকে না। কিন্তু এবারের বৃষ্টিতে সব ওলট পালট করে দিয়েছে। জাদিপাই ঝরনায় যারা গিয়েছেন তারা জানেন জায়গাটি জোঁকের স্বর্গ। একটু দাঁড়ালেই এদের আক্রমণের মুখে পড়তে হবে।

পা চালিয়ে যতদ্রুত সম্ভব পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। পাহাড়ে প্রথমবারের মতো চোখ পড়লো তামাকের খেত। দূর থেকে ভেসে আসছিলো তীব্র গতিতে পানি পড়ার গর্জন। জায়গাটিই যে জাদিপাই ঝরনা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ঝরনাকে বলা হয় ঝরনার রানী। দেখা যাক রানী আমাদের জন্য তার কেমন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে।

সমতলে হাঁটার পর আবার নীচের দিকে নামতে লাগলাম। ঝরনার আগে আমরা শেষ খাঁড়াটুকু নামতে শুরু করেছি। জাদিপাইয়ের এই শেষ নামাটুকু নিয়ে বেশ বদনাম আছে। পা হড়কালে কিন্তু আর আস্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। জায়গায় জায়গায় গাছ পড়ে ট্রেইল বন্ধ হয়ে আছে। সেসব এড়াতে বেশ কসরত করতে হলো। যত আগাচ্ছিলাম ঝরনার গর্জন বাড়তে লাগলো। ভাই ব্রাদারদের তোলা ছবির কল্যাণে জাদিপাইয়ের বিশালতা সম্পর্কে আগেই ধারণা ছিলো। এবারের অতি বর্ষণ এর ব্যাপ্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন।

বেশ দূরে থাকতেই গাছপালার ফাঁকে হঠাৎ এক ঝলক চোখে ঝিলিক মারলো বিশাল এক দুধ ধবল জলধারা। চমকে উঠলাম। যেখান থেকে যে গর্জন ভেসে আসছে তার সঙ্গে মিলে এ দৃশ্য কল্প যেন জাদু বাস্তবতার কোনো ক্যানভাস।   ক্যানভাসের পুরোটা যখন চোখের সামনে এলো এক কথায় বলতে গেলে চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমি ধপ করে সেখানেই বসে পড়লাম। সংজ্ঞা ফিরলো আরও মিনিট খানেক পর পেছনের অন্যরা সামনের যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে।

কিন্তু কোথায় যাবো আর তো পা বাড়ানোর জায়গা নেই। সামনের পুরো জায়গা একেবারে ধসে গিয়েছে। এর আগে যতগুলো ছবিতে জাদিপাইকে দেখেছি সবগুলোই সামনে থেকে তোলা। কিন্তু এখন সামনে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। পাহাড়ি ঢলের কারণে বিশাল অংশজুড়ে একেবারের ধসে গিয়েছে। বেশ উপরে থেকে আমরা ছ’জন পলকহীন দৃষ্টিতে গিলতে লাগলাম রানী জাদিপাইকে। আমরা যে রূপে জাদিপাইকে দেখেছি সে মুহূর্তের বর্ণনা দেওয়া আসলেই কঠিন।

গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে পানির বেগ নিয়েছে বজ্রের শক্তি। নীচে পানি পড়ে বাষ্পাকারে উড়ে যাচ্ছে। বেশ দূরে থেকেও ক্যামেরায় ছবি নেওয়া কঠিন। হঠাৎ এতক্ষণের বাকরুদ্ধ বাস্তবতা ভেঙে কীভাবে যেন চিৎকার করে উঠলাম। রংধনু!!! শহুরে আকাশে রংধনু দেখি কদাচিৎ সেখানে জাদিপাইয়ের নীচে বসেছে রংধনুর সাত রংয়ের বাহারি মেলা। স্বচ্ছ পানিতে রোদের ঝিলিকে সৃষ্টি হচ্ছে সাত রঙের সুষমা। আমার চিৎকারে ক্যামেরা হাতে মিতু সচকিত হলো। কিন্তু চর্ম চোখে যা দেখলাম তা কি ক্যামেরার লেন্সে ধরা সম্ভব। না হোক আমরা জাদিপাইয়ের সৌন্দর্যেই মজে থাকি।

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ০০১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৫
এএ/এটি

** গা-ভর্তি জোঁক নিয়ে আকাশছোঁয়‍া কেওক্রাডংয়ে
** এভারেস্ট জয়ের ক্লান্তি নিয়ে যৌবনবতী বগালেকে
** ভরাযৌবনা শঙ্খ নদী হয়ে বগা লেকের পথে
** ২১ কিমি হেঁটে অবশেষে রুমায়!
** পাহাড়ের আড়ে বিধ্বস্ত বান্দরবানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে



বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।