ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বিভীষিকাময় সুন্দরে-১

পাহাড়ের আড়ে বিধ্বস্ত বান্দরবানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে

রিয়াসাদ সানভী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৫
পাহাড়ের আড়ে বিধ্বস্ত বান্দরবানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে ছবি: শামীমা মিতু

বান্দরবান থেকে ফিরে: ঈদের ছুটিতে সবার লাফাতে লাফাতে বান্দরবান যাওয়া দেখে আমার কিন্তু একটুও আফসোস হয়নি। ততদিনে আমাদের প্ল্যানটাও ফাইনাল কিনা! এইতো আর কয়েকটা দিন, সান্ত্বনার বুলিটুকু জপতে জপতে ঢাকার ছাড়ার দিনটিও এগিয়ে আসতে লাগলো।

কিন্তু মাঝের সময়গুলি নির্ভাবনায় কাটতে দিলো না বেরসিক বৃষ্টি। থানচি রোড বিধ্বস্ত, ভেঙে গেছে রুমা সড়ক।

বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবর ততক্ষণে সবার জানান। উ‍চু উঁচু পাহাড়ের উপর দিয়ে নাকি নৌকা চলছে!

ক্রমাগত আসতে লাগলো মায়ের ফোন। ‘হায় হায় বাবা কীভাবে যাবা? তার উপর আবার ছোট ভাইরেও সাথে নিতেছো। ‘ চোখ মুখ বুজে প্রিয় মানুষগুলোর আশঙ্কা উপেক্ষা করতে লাগলাম। টিকিট কাটা হলো। কিন্তু শেষ মেষ সত্যিই গোল বাঁধালো দরিয়া থেকে উঠে আসা এক শয়তান। তার আবার বাহারি নাম কোমেন!!
দফায় দফায় জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে ফোনালাপ। বিষয় একটাই যাবো কি যাবো না। মনের কোণে যদিও আশার সূর্য উঁকি দিচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত খবর এলো, কোমেন বাবাজি দিক পরিবর্তন করে বরিশাল নোয়াখালীর দিকে রওয়ানা হয়েছে। আমাদের ব্যাগ বোজকা রেডিই ছিলো। ৩০ জুলাই রাতে টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই শুরু করলাম আরেকটি যাত্রা।

ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো বাস তখন সাতকানিয়ার সীমানায়, কেরানীহাটের কাছাকাছি। ভারী বৃষ্টি না হলেও চারপাশের মেঘ গুড়গুড় থমথমে আবহাওয়া আর পথের পাশে টাইটুম্বুর জলাশয়। নদী জানান দিচ্ছিলো উপরে বান্দরবানের পরিস্থিতি সুবিধের নয়। হলোও তাই। বান্দরবান শহর থেকে বারো কিলিমিটার আগেই বাস নামিয়ে দিলো। প্রবল পাহাড়ি স্রোতে ব্রিজ ভেঙে গেছে। আশঙ্কার কালো মেঘ সঙ্গী করেই বাস থেকে নামলাম।

ওইপাশে পূরবী পরিবহনের বাস বান্দরবান শহর পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত। এতে চড়ে বসেই খেয়াল হলো ভুল হয়ে গেছে। ভাব গতিক বলছিলো বাস দুই ঘণ্টায়ও ছাড়বে না। আমাদের সঙ্গে একই বাসে এসেছে আরও ছয় জনের আরেকদল। সবাই মিলে এগারশো টাকার চুক্তিতে ঠিক করা গেলো এক জিপ। সে আমাদের নিয়ে যাবে বান্দরবান রুমা সড়কের নয় মাইল পর্যন্ত। হালকা বৃষ্টিতে ভেজা পাহাড়ি সড়কে জিপ ছুটলো ঝড়ের বেগে। মনও হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো আশার পাল। এই তো গাড়ি চলছে। রুমা আর কতদূর! পথে এক জায়গায় থেমে সেরে নেওয়া হলো নাস্তা। এরপর একটানা ছুটে চলা। কিন্তু আশার বেলুন টুপ করে ফেটে গেলো নয় মাইলে এসে। জিপ যেখানে থেমেছে তার পর অনেক দূর পর্যন্ত কোনো রাস্তার অস্তিত্ব নেই। হালকা মেঘের ফাঁকে সে দৃশ্য দেখে হলো কোনো দানব প্রবল আক্রোশে পিচ ঢালা রাস্তার ক্ষানিকটা একেবারে খুবলে খেয়ে ফেলেছে। ওপারে যেতে হবে, জানি না সেখান থেকে রাস্তার পরবর্তী অংশটুকুর কি অবস্থা।

এমন ভাবতে ভাবতেই মূল সড়ক থেকে ভেঙে যাওয়া অংশের উপর দিলাম লাফ। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম পা কোনো শক্ত মাটিতে পড়েনি। চোরাবালির কথা শুনেছিলাম, এবার আমিই এর শিকার। ব্যাপক কসরতের পর থিকথিকে পাহাড়ি লালমাটির চোরাবালি থেকে উদ্ধার পাওয়া গেলো। কিন্তু সাধের অ্যাপেক্স প্লাস্টিক স্যান্ডেল জোড়াকে আর ফিরে পেলাম না। অনেক অভিযানের সঙ্গী ছিলো, বেচারা ঘুমাক চোরাবালির তলে।

ওপারে এক চাঁদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার নড়াচড়ার নাম নেই। টিপটিপ বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হলো মেঘের আনাগোনা। আদিভৌতিক আবহে মোড়ানো খালি রাস্তায় দাড়িয়ে রুমায় পৌঁছার আশা মনে হয় সুদূর পরাহত। এরমধ্যে চিম্বুকের দিক থেকে আরেকটি চাঁদের গাড়ির আগমন। জিজ্ঞেস করলাম রুমা যাবে কিনা। সবার আগে তার উত্তর ‘যাব দাদা টাকা লাগবে তিন হাজার। ’ পনেরো মিনিট ধরে চললো তার সঙ্গে দরাদরি। শেষে ২৫০০ টাকায় রাজি হলেন। গাড়ি যাবে রুমার আগে সদরঘাট পর্যন্ত। আমরা তাতেই খুশি।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগ মুহূর্তে জানা গেলো তিনি যাবেন না, গাড়ি চালাবে তার সহকারী এক কিশোর। তাকে জিজ্ঞেস করতে জবাব এলো ‘চিন্তা করবেন না দাদা ওকে সব শিখিয়ে দেবো। ’ যাই হোক চাঁদের গাড়ির পেটে বসে আবার রুমার পানে চলা শুরু করলাম। পথের পাশে শূন্যতায় মেঘের আনাগোনা থাকায় প্রথম পনেরো মিনিট রুমা রুটের সেই বিখ্যাত দিগন্ত বিস্তৃত স্কাই ভিউর দেখা পেলাম না। কিন্তু এরপর মেঘের আড়াল থেকে যা উদয় হলো এক কথায় তা অবিশ্বাস্য। সুন্দরেরও এক ধরনের সীমা থাকে। সেটি যখন ছাড়িয়ে যায় স্বর্গের শুরু বোধহয় সেখান থেকে। চোখের সামনে সবুজ পাহাড়ের উপত্যাকায় মেঘ নেচে গেয়ে ধরনিপাত করছে। চোখে ক্লান্তি আনা সবুজ।

‘সবুজ শ্যামল’ আমার এ দেশের তকমাটি দেওয়া কবি মহাশয় কি কখনো বান্দরবানে এসেছিলেন? আমাদের এবারের চলা বিখ্যাত কয়েকটি ঝরনার আঙিনায়। খেয়াল করলাম আরে কই চলেছি !! ঢালু পিচঢালা পথ গড়িয়ে নামছে পানির ধারা,পাশের খাঁড়া ঝিরি রূপ নিয়েছে ঝরনায় এমনকি পথের পাশের ক্ষুদ্র নালা যেখানে অন্য সময় হয়তো পানির অস্তিত্বও থাকে না সেটিও রীতিমতো ঝরনা। ঝরনা রাজ্যের পথে প্রান্তরের সবুজে ভিরমি খেতে থেতে চলছিলাম। হঠাৎ গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো।   সামনে বিশাল এক গাছ মাটি উপড়ে রাস্তা আটকেছে। চলেছি পাহাড় ডিঙাতে, এক গাছের বাধাতে হার মানলে চলে?

হেইয়ো বলে সবাই মিলে হাত লাগানোতে আপাত অসম্ভব ঠাওরানো কাজটি সহজেই সারা গেলো। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। দশ মিনিট গাড়ি চললো ভালোই। এরপর আবারও থামলো। প্রবল বৃষ্টির তোড়ে পথের পাশের বিশাল পাহাড়ের সামনের অংশটুকু এমনভাবে পথ আটকেছে যে আর সামনে এগোনোই সম্ভব না...

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৫
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।