ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

লুরে ক্যাভার্নের বিস্ময় গুহায়

ফকির সেলিম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৫
লুরে ক্যাভার্নের বিস্ময় গুহায়

১৮৭৮ সালের ১৩ আগস্টের এক রাত। ভার্জিনিয়ার লুরে শহরের পশ্চিমে এক পাহাড়ের পাদদেশে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে অভিযানে নেমেছেন এন্ড্রিউ ক্যাম্পবেল।

সঙ্গে তিনজন পুরুষ আর তার ১৩ বছর বয়সী ভাতিজা কুইন্ট। স্থানীয় ফটোগ্রাফার বেনটন স্টেবিনস তাদেও সহায়তা করছেন। ওই পাহাড়ের গুহায় রহস্যের সন্ধানে তার সে অভিযান।

গুহায় ঢোকার পথ কোথায় তা খুঁজে বের করতে হবে। পাহাড়ের একটি স্থানে খনন শুরু করলো তারা। চার ঘণ্টা খুঁড়ে কিছু পাথর সরানোর পর তাদের মনে হলো একটা সুড়ঙ্গ। ভেতরে ফাঁপা মতো কিছু বোঝা যাচ্ছে। ক্যাম্পবেল ও কুইন্ট দড়ির সাহায্যে কিছুদূর নামলো। সেখানে যা দেখলো তা অবিশ্বাস্য। বিশাল গুহা। রহস্যে ভরা গুহা। একটি নয়, দুটি নয়, অসংখ্য। আর সেই গুহায় অপরূপ দর্শন অসংখ্য স্টেলেকটাইট ও স্টেলেগমাইট।

স্টেলেকটাইট হচ্ছে প্রকৃতি থেকে হাজার হাজার বছরের বিন্দু বিন্দু জল ও খনিজ পদার্থের সংমিশ্রণে জমাটবদ্ধ হয়ে গুহার উপরিভাগে সৃষ্ট চুনদণ্ড ও স্টেলেগমাইট হচ্ছে গুহার তলদেশে জমা চুনদণ্ড। এর প্রতি কিউবিক ইঞ্চি তৈরি হতে পানির ধারার ওপর নির্ভর করে ১২০ থেকে ৩০০ বছর সময় লাগে। ক্যাম্পবেল ও কুইন্টের সেদিনের সেই আবিষ্কারই ‘লুরে ক্যাভার্ন’। যুক্তরাস্ট্রের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানসমূহের একটি।

ওয়াশিংটনে বাস করছি আড়াই বছরের মতো। কেউ বেড়াতে এলে হোয়াইট হাউজ ওয়াশিংটন মনুমেন্ট বা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামগুলো দেখাই। দূরে যাওয়া হয় না তেমন একটা। লুরে ক্যাভার্ন বা শ্যানোনডোয়াহ যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম যাবোই। বউ-বাচ্চা নিয়ে রওয়ানা হলাম। রাস্তার দু’পাশে চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। ঘণ্টা আড়াইয়ের মতো ড্রাইভের পর বহুল প্রত্যাশিত লুরে ক্যাভার্নের গেট।

লম্বা লাইন। জনপ্রতি টিকেট ২৫ ডলার। কিন্তু লাইন আর কমে না। ঘণ্টাখানেক দাঁড়ানোর পর টিকেট কাটলাম। ৩০/৪০ জনের দল বেঁধে এক একজন গাইড গুহার ভেতরে দর্শনার্থীদের নিয়ে যাচ্ছে লেকচার দিতে দিতে। আমাদের গাইড মাঝবয়সী এক শ্বেতাঙ্গিনী। কে শোনে তার কথা। আমরা যে যার মতো ছবি তোলায় ব্যস্ত।

সমতল থেক গুহায় ঢোকার পর ১০ তলার সমান নীচে নামলাম সিঁড়ি বেয়ে। অসম্ভব সুন্দর সব নিদর্শন। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে বাড়তি যা যুক্ত হয়েছ তা হচ্ছে অপূর্ব লাইটিং। গুহার মাঝখান দিয়ে ৩/৪ ফুট চওড়া করে হাঁটার রাস্তা। সেখান দিয়েই দর্শনার্থীদের হাঁটতে হয় লাইন ধরে।

ছোটবেলায় কতো গুহার কথা পড়েছি। কতো গুহার ছবি দেখেছি। সিনেমা দেখেছি গুহা নিয়ে। অথচ সেসব কোনোটির সঙ্গে মিল নেই এই লুরে ক্যাভার্নের। কি আশ্চর্য সুন্দর এই গুহা। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পানি চুঁইয়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে কি অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক স্থাপত্য।

গুহায় ঢুকতেই প্রথম স্ট্যালেগমাইটটির নাম ওয়াশিংটন; একজোড়া পিলারসদৃশ স্টালেগমাইট যার সঙ্গে স্ট্যালেকটাইট মিলে গিয়ে একাকার। এই জায়গাটি নিয়ে রয়েছে একটি কিংবদন্তি। এখানে অনেকে বিয়ে করতে আসেন। কারণ এখানে বিয়ে করলে নাকি বিয়ে এই পিলারের মতো মজবুত হয়।

সামনেই দেখা মিললো একটি সরোবর। যেখানে লোকজন মানত করে পয়সা ছুড়ে গুহামালিকের সম্পদ বাড়িয়ে চলছে। গুহার এক যায়গায় রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের তালিকা।

গুহার তাপমাত্রা ছিলো এদিন ৬৫/৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো। দারুণ আরামদায়ক। গুহায় যে কতরকম স্ট্যালেগমাইট আর স্ট্যালেকটাইট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তার হিসাব নেই। গাইড একটি স্থানে থেমে বললেন, এই গুহার বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে। একটি মেয়ের মরদেহও নাকি পাওয়া যায়। মেয়েটিকে সম্ভবত তার আত্মীয়-স্বজন কবর দিয়ে চলে যায়; পরে মাটি ধসে পড়লে সে সরাসরি গুহায় পড়ে যায়। রেড ইন্ডিয়ান মেয়েটির সম্মানে ওরা স্থানটির নাম দিয়েছে দ্য প্রিন্সেস চেম্বার। জীবিত থাকলে সে এই সম্মান পেত কিনা কে জানে?

একটি জায়গায় চুঁইয়ে পড়া পানি জমা হয়ে একটি সরোবরের মতো সৃষ্টি করেছে। ওখানে স্ট্যালেকটাইটের ছায়া এতো স্পষ্ট দেখা যায় যে মনে হয় সব পানির নীচে স্ট্যালেগমাইট! অসাধারণ সুন্দর এই প্রতিচ্ছায়া কাচের ওপর প্রতিফলনের চেয়েও বাস্তব!

এক স্ট্যালেকটাইট অন্তত তিনতলার সমান উঁচু। এক জায়গায় কর্মচারীরা ভুলে দু'টি মিনি সাইজের স্ট্যালেগমাইট ভেঙে ফেলেছিলো। ফলে দেখার সুযোগ হয় এই পাথরগুলোর ভেতরটা দেখতে কেমন। দেখতে তা হুবহু ডিম ভাজির মতো, মধ্যখানে একটা খনিজ কুসুম আর বাইরে ডিমের শ্বেতাংশের মতো জমা হওয়া পাথর।

পর্যটকদের সুবিধা ও আকর্ষণ করা মতো সব ব্যবস্থাই রয়েছে এখানে। তিন একর জায়গায় সমতল থেকে শ’দেড়েক ফুট মাটির নীচ পর্যন্ত এক বিস্ময়কর রহস্যময় জগৎ এই লুরে ক্যাভার্ন। কেউ স্বচক্ষে না দেখলে এর বর্ণনা শুনে সঠিক সৌন্দর্য অনুধাবন করা সত্যিই কঠিন।

বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০১৫
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।