ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মাহফুজ পারভেজের ভ্রমণসমীক্ষায় নেপালের সজীব প্রতিচ্ছবি

প্রফেসর ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫
মাহফুজ পারভেজের ভ্রমণসমীক্ষায় নেপালের সজীব প্রতিচ্ছবি

সাহিত্যের দরবারে ভ্রমণের কদর নিয়ে মত-পার্থক্য আছে। কিন্তু ভ্রমণ যখন নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের শক্তিতে অবলোকনের অতলস্পর্শী গভীরতায় পৌঁছে যায়, তখন সেটা মহার্ঘ্য সৃষ্টি হয়ে ওঠে মনন ও সৃজনের আলোয় আলোয়।

আবু রায়হান আল বিরুনি যে ধ্রুপদী ভারততত্ত্ব উপহার দিয়েছেন, সেটা তো ভ্রমণের হাত ধরেই। ধারাবাহিকভাবে আরও স্মরণ করতে পারি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, জলধর সেন, সৈয়দ মুজতবা আলী এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাও। তাঁদের কলমে ভ্রমণ মানে দেখা মাত্র নয়, বীক্ষণের বহুমাত্রিক উদ্ভাসও বটে। এটা ঠিক যে উচ্চাঙ্গের ভ্রমণ কাহিনী হালের বাংলা সাহিত্যে অনুপস্থিত। তবুও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত কিছু বই আমাদের সচকিত করে—গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক, গবেষক-লেখক-কবি ড. মাহফুজ পারভেজ রচিত রক্তাক্ত নৈসর্গিক নেপালে (মাহফুজ পারভেজ, রক্তাক্ত নৈসর্গিক নেপালে, ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, প্রচ্ছদ: হাবিবুর রহমান, মূল্য: ৩৫০ টাকা, পৃষ্ঠা: ৩০৪) তেমনই একটি উল্লেখযোগ্য ভ্রমণবৃত্তান্ত। কয়েকটি কারণে গ্রন্থটি আমার মনোযোগ আকষণ করেছে:

১. আমি ২৫ বার আমেরিকা-কানাডা, ইউরোপের প্রায়-প্রতিটি দেশ, জাপান-চিন-কোরিয়া-অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশ একাধিকবার ভ্রমণ ও বসবাস করলেও অতি কাছের নেপালে যাই নি। আমার নিজের কাছেও বিষয়টি অদ্ভুত মনে হয়। তথাপি এটাই বাস্তব। এজন্য নেপালের প্রতি একটি টান ও আগ্রহ আমার রয়েছে।

২. নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র নেপাল নামক দেশটি। কারণ সেখানে বহু জনজাতি ও বিচিত্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তাত্ত্বিকভাবে নেপাল সম্পর্কে বইপত্রের সুবাদে বহু কিছু আমার জানা আছে। যেহেতু সরাসরি যাই নি, তাই সুযোগ পেলেই নেপাল সংক্রান্ত কোনও লেখা বা রচনা পেলেই গুরুত্ব দিয়ে পড়তে চেষ্টা করি।

৩. নেপাল নিয়ে বাংলা ভাষায় বিশেষ কোনও বই আমার নজরে আসে নি। তাই ড. মাহফুজ পারভেজের বইটি পাওয়ায় বইটি আগাগোড়া পাঠের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছি।

৪. ড. মাহফুজ পারভেজ আমার সুদীর্ঘকালে পরিচিত, ছাত্রতুল্য ও প্রীতিভাজন। ছাত্রজীবন থেকেই তার লেখালেখি, সাংবাদিকতা, মৌলিক গল্প-কবিতা তথা সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীতে তার অধ্যাপনা-গবেষণা সম্পর্কেও আমি ওয়াকিফহাল। (মাহফুজ পারভেজ নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব বিষয়েও আগ্রহী। তার পিএইচডি গবেষণা কর্ম পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংঘাত নিরসন সংক্রান্ত বিষয়ে ২০০৬ সালে সম্পন্ন হয়। ২০০০ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ ও ইন্সটিটিউট অব অ্যাপ্লাইড এন্থ্রোপলজি (আইএএ) আয়োজিত সেমিনারে ‘জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার বিষয়ে ইংরেজিতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি ঢাকার অদূরে কাপাসিয়ায় অবস্থিত আইএএ ক্যাম্পাসের সেমিনার ও অনুষ্ঠানসমূহে নিয়মিতভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা, বিদ্রোহী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শান্তিচুক্তি: ঢাকা, সন্দেশ প্রকাশনী) রাজনীতি বিজ্ঞান পরিবারের মানুষ হয়েও তিনি মানবিক-সামাজিক বিজ্ঞানের নানা অঙ্গনে বিচরণ করেন, সে তথ্য আমার অজানা নয়। এ কারণেও তার বইটি আমার কাছে আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে।

অতএব ‘রক্তাক্ত নৈসর্গিক নেপালে’ আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পাঠ করেছি এবং মুগ্ধ হয়েছি। গ্রন্থটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য; একঘেয়েমি বর্ণনা পাঠককে ক্লান্ত করে না; বরঞ্চ একটির পর একটি বিষয়ের অবতারণা ও বিবরণ গ্রন্থটিকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। বইটি পড়ে আমি অপার আনন্দ লাভ করেছি। পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করার আমার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু কেন যেন আমাদের অতি নিকটের এই দেশটিতে এখনও আমি যেতে পারিনি। মাহফুজের বইটি পড়ে একদিকে যেমন অদেখা নেপালকে প্রায়—দেখা হয়ে গেল, অন্যদিকে এদেশটির ভ্রমণের বাসনাও বেড়ে গেল।

নেপালের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে আমার সরাসরি কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও পরোক্ষ তথ্যের ভিত্তিতে মোটামুটি পরিচয় ছিল; কিন্তু এ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে পারলাম এ গ্রন্থের মাধ্যমে। নেপালের ইতিহাস, ভৌগোলিক পরিবেশ, বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক জাতি-গোষ্ঠীর সমষ্টি নেপালী জনগণ এবং তাদের বহুমাত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতি অর্থাৎ জীবনাচরণ, নেপালের অর্থনীতি, নেপালের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নেপালের সমসাময়িককালের রাজনীতি, বিশেষ করে রাজা বীরেন্দ্র, রানী ঐশ্বর্যসহ রাজপরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড—গ্রন্থটির প্রধান বিষয়বস্তু তথা মূল উপজীব্য বিষয়। ফলে নৃ-সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়সমূহের সমন্বয়ে একটি বহুমাত্রিক সমীক্ষার প্রচেষ্টা গ্রন্থটিতে রয়েছে।

এ গ্রন্থ পাঠ করে জানা যায় ৯/১১ এবং নেপালের রাজপ্রাসাদ হত্যাকাণ্ডের পর পর তীব্র মাওবাদী রক্তাক্ত আন্দোলনের সময়কালে কিছুটা আকস্মিকভাবেই লেখকের সে দেশটিতে ভ্রমণের সুযোগ হয়। কয়েক বছর আগে—সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠের (তিনি সেখানে আমেরিকার কালো মানুষদের মধ্যে বিরাজমান দারিদ্র্য নিয়ে ‘Racism and Poverty in USA’ শীর্ষক গবেষণাপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন) আমন্ত্রণে নেপালের পাহাড়ী শহর নাগরকোটের এক পাঁচতারা হোটেলে অবস্থানের মধ্য দিয়ে তাঁর স্বল্পকালীন নেপাল সফর শুরু হয়েছিল। সেমিনার শেষে রাজধানী কাঠমাণ্ডু শহর ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে এ সফরের সমাপ্তি; অথচ এর মধ্যে অনেকটা সাগর সেচে মুক্তা আহরণের মত লেখক-গবেষক মাহফুজ পারভেজ সংগ্রহ করেছেন দেশটি সম্পর্কে অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত, নানা অজানা কাহিনী, রাজা ও রাজ পরিবারের বিয়োগান্ত ঘটনার রহস্য, সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকদের তীর্থস্থান, বিশেষ করে তাদের হিমালয়প্রেম, মাওবাদী বিপ্লববাদ, যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে রচিত নেপালের ওপর বর্তমান প্রামাণ্য গ্রন্থ। ভ্রমণকালীন যাদের সাথে তাঁর মিথষ্ক্রিয়া হয়েছে যেমন—স্বদেশী সহযাত্রী,  বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সেমিনারে যোগদানকারী সহকর্মী, স্থানীয় লোকজন, নেপালে বসবাসকারী বাঙালি এবং অতিথি সেবকদের নানা চরিত্র সম্পর্কে লেখকের কৌতূহল, উপলদ্ধি এবং সে সকল মানব চরিত্রের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে লেখকের তীক্ষ্ণ অর্ন্তদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।

সচেতন মানুষ এবং রাজনীতির ছাত্র মাহফুজ পারভেজকে যে রাজনীতি আকৃষ্ট করবে—এটা সহজেই অনুমেয়। নেপালের রাজনীতির গভীরে প্রবেশ করে তিনি সে দেশের রাজনীতির দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের ইতিহাস, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে মাওবাদী কম্যুনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব; চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান এবং নেপালের রাজনীতিতে আধিপত্যবাদের প্রভাবের এক নিখুঁত চিত্র উপস্থাপন করেছেন। নেপালের সাধারণ মানুষ—হোক সে সমতলভূমির বাসিন্দা অথবা পাহাড়ী অঞ্চলের অধিবাসী, ক্ষমতা বলয়ের দূরে-বহুদূরে তাদের অবস্থান। নেপালের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ও পার্শ্ববর্তী আধিপত্যবাদী দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। মোট কথা নেপালের রাজনীতি, অর্থনীতি আজ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করেছে পার্শ্ববর্তী বিরাট প্রতিবেশী ভারতের বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী। এ গ্রন্থ  পাঠে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যে, নেপাল কি সত্যিই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র? পাঠকের মনে এই প্রশ্ন জাগ্রত করা—এ গ্রন্থের এক বড় সাফল্য, যা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির নিরিখে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তার সমস্যাটিকেও তুলে ধরে। ভ্রমণের পথে তথ্যপূর্ণ ও কাব্যিক বর্ণনায় নেপালের সজীব প্রতিচ্ছবি এ গ্রন্থ।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বইটি কয়েকটি বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, এটি নেপাল সম্পর্কে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত আলোচনার সূত্রপাতকারী প্রথম উদ্যোগ। দ্বিতীয়ত, ভ্রমণ, গবেষণা, ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিক-প্রত্নতাত্ত্বিক বর্ণনা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণের অপূর্ব সমন্বয়। তৃতীয়ত, ভাষা ও সাহিত্যের নিরিখে সুখপাঠ্য এবং নবতর শৈলীর প্রকাশ। চতুর্থত, বাংলাদেশ ও নেপালের ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতির তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের উন্মোচক। পঞ্চমত ও শেষত, সামগ্রিক নেপাল সমীক্ষার বহিঃপ্রকাশ। সুদীর্ঘ আঠারোটি অধ্যায়ে বইটিকে সাজিয়েছেন মাহফুজ পারভেজ এবং প্রতিটি অধ্যায়ের মূল বিষয়কে প্রতিনিধিত্বকারী চমৎকার একেকটি শিরোনাম দিয়েছেন রবীন্দ্র কাব্যের একেকটি চরণের সাহায্যে।

প্রথমেই তিনি ভ্রমণারম্ভ ও পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন ‘পথে চলা, সেই তো তোমায় পাওয়া’ শিরোনামে। তারপর ক্রমে ক্রমে তার ভ্রমণ এগিয়ে গেছে এবং বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পাঠকদের পরিভ্রমণ করিয়েছেন। যেমন, ‘যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে’ (চর্যাপদ ও বাংলা-নেপাল সাংর্স্কৃতিক সম্পর্ক, নেপালী জনগোষ্ঠীর বিবরণ), ‘জন্মজন্ম শতজন্ম উঠিল জাগিয়া’ (নাগরকোটের হিল স্টেশন প্রসঙ্গ), ‘অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে’ (আড়াই শ’ বছরের প্রাচীন রাজতন্ত্র ও রাজপ্রসাদ হত্যাকাণ্ড), ‘আঁধার বনের পথে চলি গেল ধীরে’ (কাঠমাণ্ডু নগর ও নিসর্গ), ‘তোমার পরশ আসে কখন কে জানে’ (অভিবাসী মনস্তত্ত্ব), ‘ডাকে কারে জনহীন অসীম প্রান্তরে’ (পাটান বা ললিতপুরের প্রত্নজগত), ‘তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া’ (ধূলিখেল-ভক্তপুর-জীবনযাত্রা-সংস্কৃতি), ‘প্রেমের জোয়ারে ভাসাব দোঁহারে বাঁধন খুঁলে দাও’ (বাংলাদেশ-নেপাল সম্পর্ক), ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে’ (ভারত-নেপাল সম্পর্ক), ‘হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে’ (মাওবাদের সাতকাহন), ‘বেদন বাঁশি উঠল বেজে বাতাসে বাতাসে’ (বৌদ্ধতীর্থ), ‘লঙ্ঘিয়া চলিয়া গেছে চির সুন্দরের সুরপুরে’ (হিমালয়: মিথ ও বাস্তবে), ‘প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে’ (এভারেস্ট অভিযাত্রা ও বিজয়ের বিবরণ), ‘পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ’ (পর্বতাভিযানের নানা কথা), ‘দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে’ (শৃঙ্গ বিজয়ের প্রণোদনা)। মাহফুজ পারভেজের অপরূপ লেখনী-সমন্বয়ে অধ্যায়গুলো বিচ্ছিন্ন বা যান্ত্রিক তো হয়ইনি, বরং একটি অখণ্ড নেপালচিত্র তুলে ধরেছে ভ্রমণের পায়ে পায়ে, কথায় কথায়। এছাড়াও পোস্টস্ক্রিপ্টে নেপালের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং পরিশিষ্টে চর্যাপদ প্রসঙ্গের সংযোজন নেপাল সংক্রান্ত প্রেক্ষাপটটিকে প্রসারিত করেছে। কবি আহসান হাবীব ও বিশ্বব্যাপী সংগ্রামীদের গ্রন্থটি উৎসর্গ করার পটভূমিও বিধৃত হয়েছে ‘উৎসর্গ প্রসঙ্গে’ অধ্যায়ে। উল্লেখিত হয়েছে বহুজন ও প্রতিষ্ঠানের কথাও। এবং সংক্ষিপ্তভাবে ‘প্রসঙ্গত’ অধ্যায়ে ফুটে উঠেছে গ্রন্থ সম্পর্কে লেখকের অভিব্যক্তি।

সন্দেহ নেই, নেপাল দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগার। সুপ্রাচীন রাজতন্ত্র পতনের পর অস্ত্র-সংবরণ করে কমিউনিস্টরা প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন মাওবাদী নেতা পুষ্পকুমরি ডাহাল ওরফে ‘প্রচণ্ড’র (‘প্রচণ্ড’ আত্মগোপনে থাকাকালে পুষ্পকুমারের ছদ্মনাম। এ নামেই এখন তিনি সমধিক পরিচিত) নেতৃত্বে। প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মাওবাদী সাবেক-গেরিলাদের সে দেশের মিলিটারিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেনাপ্রধান ও সামরিক কর্তারা এ বিষয়ে নিজেদের আপত্তি জানান এবং প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরে যেতে হয় প্রচণ্ডকে। এ সময় নেপালের আর্মি চিফ নিয়োগে ভারতের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে—এ অভিযোগে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মাওবাদীদের। এ সময় আরেক মাওবাদী শীর্ষনেতা ড. বাবুরাম ভট্টরাই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সচেষ্ট হন। প্রচণ্ডকে চীনপন্থী আর বাবুরামকে ভারতঘেঁষা মনে করা হয় এ কারণে যে, ভারতের বাম নেতাদের সঙ্গে বাবুরামের রয়েছে হৃদ্যিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক বেশ পুরাতন এবং জোরালো। বাবুরাম ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং এখানে পড়ার সময়ই তিনি মার্কসবাদে আকুষ্ট হন। সে সময় থেকেই ভারতীয় বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক উষ্ণ, যা কাজে লাগিয়ে নেপালের মাওবাদীরা ভারতকে আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করে থাকে। চীন ও ভারতের মাঝখানে ছোট্ট ও দুর্বল রাষ্ট্র নেপালকে তাই নিজস্ব আভ্যন্তরীণ সমস্যার মোকাবেলার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা উত্থান-পতন-চাপ সামলাতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার এরূপ বাস্তবতা এ অঞ্চলের  ক্ষুদ্ররাষ্ট্রসমূহের স্বকীয়তা ও স্বাধীন তৎপরতার জন্য ক্ষতিকর, এ ব্যাপারে নতুন করে বলার কিছু নেই। অন্তত বাংলাদেশের মানুষের কাছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কু-প্রবণতার বিষয়গুলো ঐতিহাসিকভাবেই স্পষ্ট।

প্রকৃত অর্থে মাহফুজ পারভেজের গ্রন্থটি নিছক ভ্রমণকাহিনী নয়, একালের এ অঞ্চলের এক রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসও বটে। নেপালের জনগণের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও এ গ্রন্থে ফুটে উঠেছে। একটি দেশ ও সমাজ সম্পর্কে বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং প্রাসঙ্গিক অসংখ্য প্রপঞ্চের সমাবেশ লেখকের অন্যতম বিশেষ কৃতিত্ব। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বক্ষে ধারণ করে নানা ভাষা ও সংস্কৃতিকে লালন করেই একদার হিন্দু রাষ্ট্র নেপালের সংঘাত-সঙ্কুল গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে, উত্থান-পতনের কাহিনী রচিত হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিমালয় কন্যা নেপালকে যারা চাক্ষুস দেখেননি—এ গ্রন্থটি তাঁদেরকে নেপাল ভ্রমনের জন্য হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। গ্রন্থের বর্ণনা, ভাষার মান ও সাহিত্যিক দ্যোতনা পাঠককে আপ্লুত করবে। বাংলা ভাষায় ভ্রমণ সাহিত্যের ভাণ্ডারে এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সমাজ ও মানুষ সম্পর্কিত গবেষণা-আলোচনায় ড. মাহফুজ পারভেজের গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য-মননঋদ্ধ-পরিশ্রমসাধ্য সংযোজন। বিশেষ করে নেপাল সম্পর্কে বাংলা ভাষায় এ গ্রন্থ পথিকৃতের ভূমিকা পালন করবে। বোদ্ধা ও পাঠক মহলে এ গ্রন্থ সমাদৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস। নেপাল প্রসঙ্গে যে কোনও আলোচনায়, চর্চায়, গবেষণায় এ বইয়ের কথা অবশ্যই উচ্চারিত হবে—এ আশাবাদ নির্দ্বিধায় করা যায়।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক রাষ্ট্রদূত, বাহরাইন

বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।