ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ডালিয়ার পথে ।। কাকলী প্রধান

ভ্রমণ/ ট্রাভেলার্স নোটবুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৫
ডালিয়ার পথে ।। কাকলী প্রধান ছবি: লেখক

ঢাকা থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেলাম। আর যাই হোক বের হওয়ার মুহূর্তে মেজাজটা বিগড়াতে চাই না।

ঢাকাকে জ্যামমুক্ত অবস্থায় বিদায় দিয়ে ভালো মুড নিয়ে যাত্রা করলাম। গন্তব্য ডালিয়া।

বহুদনি থেকে নাম শুনে শুনে ভাবি-পুরো এলাকায় বুঝি শুধু ডালিয়া ফুলের ছড়াছড়ি। আর তিস্তা ব্যারেজ! ওহ সে বলার নয়, নদীর রাজনীতি, ভারত-বাংলাদেশ নদী সম্পর্ক, পানি বণ্টন, অর্থনীতি এবং কৃষি—কতোকিছু যে জড়িয়ে আছে ওই শব্দ দুটোর মধ্যে। অথচ শোনার সঙ্গে দেখার সংযোগ ঘটলো না এতোগুলো বছরেও।

বরাবরের মতো গন্তব্য একটা হলেও, উদ্দেশ্যে ডালপালা ছড়ানো। পৌঁছতে যতো সময় লাগে লাগুক—আমি বাবা হাজারে বিজারে মাঠে-ঘাটে-ময়দানে ছবি তুলতে তুলতে যাবো। তাই হলো। ভালো লাগে পুরোনো দৃশ্যগুলোই। ভালো লাগে হলুদ শরষে ক্ষেত। ভালো লাগে শতবর্ষের বটগাছ। ভালো লাগে মাছ ধরা জেলে নৌকা। সবই পুরোনো তবু আমার কাছে পুরোনো নয়। কেন আমি জানি না।

বেরিয়েছিলাম সেই সকালে। কখন যে বেলা গড়িয়ে গেলো সন্ধ্যার কোলে, বোঝা হলো না। যমুনাসেতু পার হতেই অসম্ভব ক্ষুধা। অ্যারিস্টোক্রেটে সামান্য খাওয়া সেরে নিলাম। পাশের গামছার দোকান থেকে চার পাঁচটা গামছাও কেনা হল। রংপুর থেকে সাংবাদিকরা বারবার ফোন দিচ্ছে। পথে যেন আর দেরি না করি। তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর তাগিদ। উত্তরবঙ্গের কুয়াশা! সত্যি সত্যি গাড়ি চলতেই টের পেলাম চলাটা বিপজ্জনক। সামনে কিছুই দেখা যায় না। কি বিপদ! কবির দক্ষ ড্রাইভার। খুব ধীরে চালিয়ে এগোতে শুরু করলো। শীতের ভয়ে কম্বল কাঁথা নিয়ে এসেছি।

সফরসঙ্গীরা সব কম্বলের ভেতর পুরুত করে ঢুকে গেলো। কিন্নরীর বয়স অল্প। টগবগে রক্ত। ও কুয়াশা ধরবে বলে মাঝে মাঝেই জানালার গ্লাস নামিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুভ্র বললো— তুই বরং মুখটা বাড়িয়ে কুয়াশা খেতে খেতে যা। যেই কথা সেই কাজ। আর আমরা মাঝখান থেকে ঠাণ্ডায় বুঝি কুয়াশাই হয়ে যাচ্ছি।

বগুড়ায় পৌঁছে গাড়ির চাকা বসে গেলো। চাকায় ভালো মতো সমস্যা হয়ে গেছে। ঝামেলা শেষ করতে লেগে গেলো প্রায় ঘণ্টাখানেক। চাকা সারানোর দোকানে ওরা বেশ আয়েশ করে বসে গেলো আড্ডা পেটাতে। সঙ্গে চা-বিস্কিট আর চানাচুর। আমার এসব চলে না। অগতির গতি ছবি তোলা।

রংপুরকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি চলে যাবো ডালিয়া, নাকি শহর হয়ে যাবো! সাড়ে ১১টা বাজে। কিছু খেয়ে নেয়া উচিত। এতো রাতে ডালিয়ায় পৌঁছে খাবার কিছু পাওয়া যাবে না। তাই গাড়ি শহরমুখী হলো। পরিচিত রেস্তোরাঁয় উষ্ণ আতিথিয়তা। আসার আগাম সংবাদে মাছ ভাজা, মাছের ঝোল, মুরগী ভুনা, করলা ভাজি, বেগুন ভাজি, মলা ঢেলার চচ্চরি¬¬—আরো? আরো ছিলো, কিন্তু এতো খাওয়া সম্ভব নয়। দলের মধ্যে বিশাল বপুধারী একা শুভ্র। ও সাপ্টে দিল মোটামুটি সব। গরম ডালটাও এমন চেটেপুটে খেলো। কিন্নরী হতবাক— ‘মামা তুমি এতো খাও কিভাবে!’ শুভ্র— হি হি হি পেটে হাত দিয়ে, ‘এই টুকুতেই!’

রংপুর থেকে পাগলাপীর হয়ে জলঢাকা, তারপর ডালিয়ার পথ। চলছি তো চলছি। চলছি তো চলছি। ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে পয়ঁতাল্লিশ। পথের শেষ কোথায়? গা ছমছম রাত্রি। দূরে কোথাও সামান্য আলোর চিহ্নও নেই। কালে-ভদ্রে স্থল-সীমান্তের উদ্দেশ্যে ট্রাকগুলো ভুষ ভুষ করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ওগুলোই আত্মার মধ্যে সামান্য শান্তির হাওয়া বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে কয়েক মাইল এলাকা শুনশান জনশূন্য।

সীমান্ত প্রহরীদের একটা গাড়ি লাল সবুজ আলো জ্বালাতে জ্বালাতে নিভাতে নিভাতে চললো। আমরা তার পিছু পিছু। ওমা! ওটাও ভুষ কর কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। সত্যি সত্যি উধাও! আবার অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলা। এই গা ছমছমে রাত আর নিকষ কালো পথ বুঝি আর শেষ হবার নয়। রংপুর থেকে ৪৫ মিনিটের পথ। পুরো দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে হঠাৎ করেই পথের মধ্যে একটা দরজা এসে হাজির। খোলা। দরজা গলে গাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলো। ডানে বাঁয়ে কিছু দেখছি না। কিছুদূর যাবার পর একটা বাংলো মতোন দেখতে পেয়ে আমরা ঠিকানা ভেবে ধূপধাপ নেমে পড়লাম। শুভ্র, তুষার সব যে যার মতো হাঁক ডাক শুরু করে দিলো। কেউ আছেন ভাই, প্লিজ দরজাটা একটু খুলবেন? কারো কোনো শব্দ নেই। কিরে বাবা কোথায় এলাম! এটাইতো  কাঙ্ক্ষিত রেস্ট হাউজ, নাকি?

অনেকক্ষণ ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি—একজন টিংটিং মতো মানুষ সামনে এসে দাঁড়ালো, রেস্ট হাউজ ওই দিকে। মানে পিছনে ফেলে এসেছি। আজব, দেখতেই পেলাম না! আবার পেছনের পথ। বিশাল এক ফটকের সামনে শুরু হলো ডাকাডাকি। কোথাও কেউ নেই। গাড়ির তীব্র হর্নে খানখান হয়ে গেলো কুয়াশাচ্ছন্ন ধোঁয়াটে নিস্তব্ধ রাত্রি। একজন নৈশ প্রহরী এগিয়ে এলেন। দরজা খুলতে বলতেই তিনি জানালেন— কেয়ার টেকার কাম সুপারভাইজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থেকে থেকে চলে গেছেন। তার বাসস্থান দূরে। মাথায় বাজ। এই ঠাণ্ডায় বাইরে রাত কাটাতে হবে। এও কি সম্ভব! কান্না পাচ্ছে। রোমাঞ্চও হচ্ছে। মনে হচ্ছে থাক কারো আসার দরকার নেই। বারান্দায় কম্বল বিছিয়ে চেয়ে দেখি অদ্ভুত, বড় অদ্ভু এই রাত্রি! যোগাযোগের পর যোগাযোগ। রক্ষা হলো। আমাদের গাড়ি দিয়ে তাকে আমরা আনতে গেলাম। সুপারভাইজার ভাই এলেন। এলেন!

খুলে গেলো গভীর রাতে তিস্তা পাড়ে ডালিয়ার মূল দরজা। দেখলাম। কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা হীম শীতল বিশাল অট্টালিকা। বখাটে অতিথিদের সম্ভাষণ জানালো যেন সামান্য তিরষ্কারের হাসি হেসে। এই সেই বহু গল্পময় ডালিয়া!

বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে আমরা সত্যি ক্লান্ত। নরম বিছানা আমাদের ডাকছে। যে যার বিছানায় ঝাপ এবং ঘুম।
ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। মনে হয় অনেক পাখি। আমাকে ডাকছে।

আমাকে ডাকছে ভোরের পাখি
ডাকছে ভোরের আকাশ, ভোরের বাতাস
ভোরের শিশির, চিকচিকে আলো
ডাকছে নদী-হ্যাঁ তিস্তা নদীর পাড়
সামনেই তিস্তা! হাত বাড়ালেই নীল জল।
এতো সুন্দর কেন? ভোরের আলোয় কর্মমুখর
তিস্তা পাড়ের মানুষ। আমার চোখ পড়ে না।
চোখের পাতা ফেললেই বুঝি হারিয়ে যাবে।
কেন যে এতো সুন্দর আমার এই দেশ!
এতো সুন্দর তাই বুঝি অনাদরে অবহেলায়
স্তব্ধ আমার বাংলাদেশ। আমরা যার খবরও রাখি না।
          
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।