ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

এভিয়াট্যুর

মেঘের ভেতর বসে আছি!

ফাহমিদা জেবিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১১ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৪
মেঘের ভেতর বসে আছি!

অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম কোথাও বেড়াতে যাবো। কোথায় যাওয়া যায়? শেষ পর্যন্ত ঠিক হল বান্দরবন যাবো।

আমি ছাড়া আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী ছিল আরও ৪ জন। ভাইয়া, আম্মা, জাফর ভাইয়া, মেরিনা আপু।

আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী রাঙামাটি, বান্দরবান আর কক্সবাজার হবে আমাদের যাত্রাপথ। যে বিষয়গুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে তাই লিখতে চেষ্টা করব এই লেখায়।

বান্দরবান পৌঁছেই মন ভালো হয়ে গেল, পাহাড় আর গাছ। সবুজ আর সবুজ। শান্ত একটা নীরবতা, মন ভালো হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

আমাদের ঘোরাঘুরি শুরু হলো স্বর্ণমন্দির থেকে। তারপর চিম্বুক পাহাড় আর নীলাচল। চাঁদের গাড়িতে যেতে যেতে দুইপাশের গাছ আর ফুল দেখছিলাম, কি রঙ আর বৈচিত্র্য!!
 
আকাশের নীল, মেঘের সাদা, গাছপালার সবুজ, নানা ধরনের হলুদ, লাল, বেগুনি, কমলা রঙের ফুল। মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়া আর কোমল একটা রোদেলা দিন। নিজেকে অসম্ভব মুক্ত আর বাস্তব মনে হচ্ছিল সেদিন। পাহাড়ের নিচের দিকে তাকালে কুয়াশার মতো হালকা মেঘ, কি অবিশ্বাস্য সুন্দর আর শান্তিময়! আরও দেখলাম প্রজাপতি আর মাকড়সা। নানা রঙের প্রজাপতি আর নানা নকশার জাল।

নীলাচলে সূর্যাস্ত দেখে আমরা প্রথম দিন শেষ করলাম। যে হোটেলে ছিলাম, তারা কোনো ভাবেই প্রফেশনাল না। হোটেলের বয় অনেকেই বাংলা বোঝে না, কোনো খাবারের অর্ডার দিলে না বুঝেই বলে সেটা আছে। এই বিষয়টা অন্যদের বিরক্তিকর মনে হলেও আমার কিন্তু ভালোই লেগেছে। যান্ত্রিকতা, মেকি হাসি এসব ওরা জানে না। অনেকটা আপন আর প্রাকৃতিক মনে হয় এ কারণেই।
 
পরদিন আমরা নীলগিরির উদ্দেশে রওনা হলাম। এবার সেই ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠা, অনেকটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পাহাড়ের উপর উঠতে হয় গাড়িগুলোকে।

নীলগিরি পৌঁছে মনে হচ্ছিল আমি মানুষের ক্ষুদ্রতা আর কুৎসিত জীবন থেকে অনেক ওপরে, স্বর্গের মতো প্রশান্তির জায়গায় আছি। ঠিক করলাম এখানেই রাতে থাকবো। মনে হচ্ছিল এখানে রাতে না থাকতে পারলে জীবনটাই বৃথা, তাই জোর চেষ্টা করতে লাগলাম, কিভাবে থাকা যায়। ওখানে থাকতে হলে প্রায় তিনমাস আগে থেকে নাকি বুকিং দিতে হয়। শুরু হলো ফোনের ওপর ফোন করা, চেনা অচেনা অনেককে ফোন করেও আমাদের থাকার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পারলাম না। কাজেই নীলগিরি আর আসা হবে না ধরে নিয়ে সারাদিন ওখানে কাটিয়ে দিলাম।
 
পরদিন খুব সকালে আমরা রাঙামাটির বাসে উঠে বসলাম। বাস যেখান থেকে ছাড়ে সেখানে একটা বৌদ্ধ আশ্রম আছে, আমি আর মেরিনা আপু সময় কাটাতে সেখানে ঢুকে পরলাম ( ঢুকে পরলাম না বলে উঠলাম বলা ভালো, কারণ ওটা ছোটো একটা টিলার ওপরে)। সেখানে পাঙ্খাইয়া নামে একজন শিক্ষকের সাথে কথা হলো। কি সহজ ব্যবহার আর হাসিখুসি ওরা! ওদের প্রার্থনার ঘরে ঢুকতে চাইলে আগ্রহ নিয়ে দেখাতে লাগলেন আমাদের, শুধু জুতা খুলে যেতে বললেন।
 
আমরা রাঙামাটি পৌঁছলাম প্রায় দুপুর ১২টায়,পর্যটনের মোটেলে জিনিসপত্র রেখে নৌকায় রওনা হলাম কাপ্তাই লেক ধরে, উদ্দেশ্য সুবলং ঝর্নায় গোসল করা। বান্দরবানের পাহাড় থেকে লেকে নেমে এলাম, কিন্তু সেটাও অন্যরকম এক প্রশান্তির জায়গা। শুধু নৌকার ইঞ্জিনের শব্দে বিরক্ত হচ্ছিলাম। ঝর্নার কাছে গিয়ে দেখা গেল খুব কম পানি, প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে আমারা ফিরলাম রাত ৮টায় , যদিও সন্ধ্যার পর নাকি জায়গাটা নিরাপদ নয়।

কাপ্তাই লেকে ফেরার সময় আকাশে পূর্ণ চাঁদ, আমারা ৫ মূর্তি গল্প বাদ দিয়ে হা করে এই সৌন্দর্য দেখলাম। কেউ কোনো কথা বলছিলাম না, মাঝে মাঝে অনুভূতি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না।
 
রাতে ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তারপর আবার গল্প। এর মধ্যেই খবর পেলাম, আমরা নীলগিরি থাকার অনুমতি পেয়েছি। তাই ঠিক করলাম পরদিন ভোরেই বান্দরবানে ফিরে যাবো। ঝুলন্ত ব্রিজের ওপর চাঁদের আলোয় গল্প করতে করতে আমরা একএক জন প্রায় দার্শনিক হয়ে যাচ্ছিলাম, রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। গার্ড গেটে তালা দিয়ে চলে গেলে আমাদের চোরের মতো দেয়াল টপকে ভেতর ঢুকতে হয়েছিল! তারপর রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলল গল্প আর গল্প। শেষে মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে বান্দরবানের দিকে রওনা দিলাম আমরা। তার আগে অবশ্য বনভান্তে মেমোরিয়াল হল দেখা হলো।
 
নীলগিরি পৌঁছলাম সেই অসম্ভব সুন্দর রাস্তা ধরে। নীলগিরিতে আমাদের সাথে দু’জন সর্বজন পরিচিত মানুষ ছিলেন। ঈদের দিনটি নীলগিরিতে অবস্থান করায় আমাদের ঈদ যেনো আরও বিশেষ হয়ে উঠল। ঈদ উপলক্ষে দুপুরে বিশেষ খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলে নতুন পোশাক পরে ঘুরছি, হঠাৎ চারদিকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া আর ভেজা ভেজা একটা অবস্থা তৈরি হলো! জীবনে এর চেয়ে বেশি বিস্মিত কখনও হইনি, আমি মেঘের ভেতর বসে আছি!!  মেঘ আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছি!!! 

অনেকের কাছেই এটা খুব একটা বিস্ময়কর কিছু মনে হবে না, জিনিশটা কুয়াশার মতোই। কিন্তু আমি অসম্ভব মজা পেলাম এটা ভেবে যে আমি এখন মেঘের ভেতর!!
 
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর, এক কাপ চা নিয়ে সেই মেঘের(!) ভেতর বসে অনেক গল্প করলাম। যে দু’জন বিশিষ্ট মানুষের কথা বললাম তাদের একজন এবার দেখি জোরে জোরে গান গাইতে শুরু করেছে! কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ চলে গেল (বন্ধ করে দেওয়া হল), সেই মুহূর্তে আমাদের কথাও বন্ধ হওয়ার যোগাড়, কি অসম্ভব সুন্দর!!

সারা রাত প্রচুর হাসাহাসি, গল্প, গান শোনা এই করে কাটালাম। আমরা সারারাত পাহাড়ের এক কোনায় পাটি আর কম্বল বিছিয়ে চাঁদের আলোয় নিচের মেঘ দেখলাম আর এক বাবা-মেয়ের গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুনলাম!! জীবনের সুন্দর একটা রাত শেষ হলো।

পরদিন আবার নেমে এলাম নিচে, এখনো কিছু বিস্ময় বাকি ছিল। নেমে আসতে আসতে দেখলাম দূরে মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে ঝরে পড়ছে!! পথে এক জায়গায় আমরা থামলাম যেটা ম্রো সম্প্রদায়ের গ্রাম। ওরা ভালো বাংলা বোঝে না। একজন ম্রো নারীকে দেখলাম ভারি একটা হামানদিস্তায় চাল কুটছিলেন। তার পিঠের সাথে কাপড় দিয়ে ছোটো বাচ্চাটা বাঁধা!

অনেক ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা যে বাচ্চাটার সাথেই কথা বলতে যাই না কেন সেই দৌঁড়ে পালায়। গ্রামের বেশ কিছু মানুষ আমাদের চারপাশে ভীর করলো। নিজেকে কেমন বিদেশি বিদেশি লাগছিলো!
 
অবশেষে আমরা আবার বান্দরব‍ান শহরে ফিরলাম, যে পথ ধরে আমরা বার বার উঠেছি এই কটা দিন, সেই পথটার জন্য মন খারাপ হলো। মনে হচ্ছিল এই রাস্তাটাকে আমি বহু দিন ধরে চিনি, সে যেন আমার জন্য এতদিন অপেক্ষা করে ছিল।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।