ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

তারার ফুল

চট্টগ্রাম থেকে সোমেশ্বর অলি

চট্টগ্রামে চলে না আঞ্চলিক ও আধুনিক গান

সোমেশ্বর অলি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
চট্টগ্রামে চলে না আঞ্চলিক ও আধুনিক গান ছবি: নূর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম থেকে : ‘সিডি চলে না’, ‘মানুষ বাংলা গান শোনে না’, ‘ব্যবসা নাই’- অডিও গান নিয়ে ঢাকা ও সারাদেশে সবখানে একই চিত্র। আঞ্চলিক ও ব্যান্ড সংগীতের উর্বর ভূমি চট্টগ্রাম।

এখানেও লেগেছে সেই বৈরি হাওয়া। শহরটির সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী অডিও বাজার বলে খ্যাত রিয়াজউদ্দিন মার্কেট ঘুরে পাওয়া গেছে করুণ চিত্র। একই সঙ্গে শহরের অন্য খুচরো সিডি-ক্যাসেট বিক্রির দোকানিদেরও মাথায় হাত। এখানে একেবারেই চলছে না আঞ্চলিক, আধুনিক ও ব্যান্ডের অ্যালবাম।
 
ঐকতান, আমিন স্টোর, বিনিময় স্টোর, জাহেদ ইলেকট্রনিক্স, শাহ আমানত অডিও কমপ্লেক্স, ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক্স- এগুলো বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বনেদী ও ঐতিহ্যবাহী অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। একযুগ আগেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হতো বিভিন্ন রকম গানের অ্যালবাম। ক্যাসেটের যুগ পেরিয়ে কিছুদিন সিডির ব্যবসায়ও সক্রিয় ছিলো প্রতিষ্ঠানগুলো। এখনকার চিত্র পুরো পাল্টে গেছে। অডিও ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক। অ্যালবাম প্রকাশ নয়, অন্য উপায়ে অস্তিত্ব ও নামটাই টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ করছেন কেউ কেউ।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের এসব প্রতিষ্ঠান গত ৩০ বছরে আনুমানিক হাজার হাজার অ্যালবাম বের করেছে। একই সময়ে শুধু চট্টগ্রামের শিল্পীদের গান থেকে শত কোটি টাকার ক্যাসেট ব্যবসা হয়েছে। শুধু দুই ঈদ নয়, মাইজভাণ্ডার ও মোহছেন আউলিয়ার ওরশসহ নানা উপলক্ষে সারাবছরই শিল্পীদের অ্যালবাম প্রকাশিত হতো। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি অ্যালবাম প্রকাশিত হতো, একদশক আগেও প্রতি ঈদে বের হতো গড়ে দুই শতাধিক অ্যালবাম।

এই সংকটের কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা পাইরেসি, কম্পিউটার-ইন্টারেনেটের বিপ্লব, বলিউড গানের আগ্রাসন প্রভৃতি বিষয়কে দায়ী করেছেন। এখন একটি অ্যালবামের সিডি বের হলেই তা ইউটিউব, ফেসবুক ও মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ছে, হাজার হাজার কপি হলেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বা শিল্পী এক টাকাও পাচ্ছেন না। ফলে অডিও প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্পীদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের বিনিময় স্টোরে দু’বছর ধরে বিক্রি করা হচ্ছে ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র। পাশের ছোট্ট ঘরে কিছু ক্যাসেট ও সিডি রাখা হয়েছে স্মৃতি হিসেবে। সোমবার (১১ জানুয়ারি) কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবুল হাশেমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নিয়তিকে মেনে নিয়েছি। গানের প্রতি ভালোলাগা থেকে বাল্য বয়সে এ ব্যবসায় এসেছিলাম। এখন সেই দিন নেই। কতো নামি-দামি শিল্পীর অ্যালবাম বের করেছি আমি! সময় এভাবে বদলে যাবে বুঝতে পারিনি। ’ হাশেম আরও জানান, ক্যাসেট তৈরির যন্ত্র ছিলো তার। সে সময়ে এর দাম ছিলো সাড়ে তিন লাখ টাকা। এই তো কিছুদিন আগে তিনি সেটি কেজির দরে বিক্রি করেছেন।

একই মার্কেটে আছে জাহেদ ইলেকট্রনিক্সের দোকান। একই সুরে কথা বলেছেন জাহেদ ইলেকট্রনিক্সের কর্ণধার জাহেদুল ইসলাম। তিনি জানান, আস্তে ধীরে তিনিও দোকানে অন্য মালপত্র তুলছেন। সিডি প্রকাশ কিংবা বিক্রির বাস্তবতা এখন আর নেই।

অন্যদিকে নগরীর সিনেমা প্যালেস এলাকার নবী মার্কেট রোডে ১৫-২০টি খুচরো সিডি দোকান ঘুরে পাওয়া গেছে করুণ চিত্র। টাইম ভিডিও নামের দোকানটির মালিক মো. আজগর। তিনি জানান, এখন মেমোরি কার্ডে গান দেওয়ার ব্যবসাই মূল। থ্রি-জিপি কিংবা এমপিফোর ফরম্যাটে হিন্দি ও বাংলা সিনেমাও দিচ্ছেন তারা।

চার জিবি মেমোরি কার্ডে গান ও সিনেমা ভরে দিয়ে তারা নিচ্ছেন ১৫ থেকে ২০ টাকা। এ অবস্থায় সদ্য প্রকাশিত আধুনিক গানের অডিও অ্যালবাম বিক্রির প্রশ্নই ওঠে না বলে তিনি জানান। একই পরিস্থিতি অন্য সব খুচরো দোকানেও। কীসের সিডি চলে তাহলে? এমন প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশ দোকানি জানান, পাইরেটেড হিন্দি সিনেমার সিডি কিছুটা চলে।

শুরুর দিকে রিয়াজউদ্দিন বাজারের বিনিময় স্টোর, আমিন স্টোর ও জাহেদ ইলেকট্রনিক্স, রাউজানের পথের হাটের শাহা আলম মাইক সার্ভিস এবং কক্সবাজারের আলাউদ্দিন রেকর্ডিং হাউজ ছিলো প্রতিনিধিত্বশীল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। স্মরণীয় বিষয় হলো আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’, আবদুল মান্নান রানার ‘যেখানে যাও ভালো থেকো’, সোলসের সাড়া জাগানো অ্যালবাম ‘কলেজের করিডোরে’ ও সাইফুদ্দীন মাহমুদ খানের প্রথম অ্যালবাম বের হয়েছিলো জাহেদ ইলেকট্রনিক্স থেকে।

শুধু চাটগাঁইয়া গান নয়, আধুনিক ও ব্যান্ড সংগীতের অনেক কালজয়ী গান সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের অডিও প্রতিষ্ঠান থেকে। এভাবে ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে চট্টগ্রামেও গড়ে উঠেছিলো সমৃদ্ধ এক অডিও শিল্প। শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, লক্ষীপদ আচার্য, সঞ্জিৎ আচার্য, কল্যাণী ঘোষ, শিল্পী রাণী, সন্ধ্যা রাণী, কান্তা নন্দী, আইয়ুব বাচ্চু, আবদুল মান্নান রানা, সাইফুদ্দীন মাহমুদ খান, সেলিম নিজামী, শিমুল শীল, ওয়াকিল কাওয়াল, সৈয়দ আমিনুল ইসলাম (ইসলাম কাওয়াল), আহমদ কবির আজাদ, বুলবুল আকতার, সিরাজুল ইসলাম আজাদ, দীপক আচার্য, আবদুল মান্নান, বাচ্চু কাওয়াল, পলি শারমীন, শরীফ উদ্দিন ও শাহজাহান আলীর মতো শিল্পীদের গান নিয়ে ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে চট্টগ্রামেও গড়ে উঠেছিল জমজমাট এক অডিও শিল্প।

অন্যদিকে চট্টগ্রামের অডিও বাজারে পাহাড়ি গানেরও বিপুল চাহিদা ছিলো। চাকমা, মারমাসহ আদিবাসী গানের শিল্পীদের অনেক অ্যালবাম বের হয়েছে রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে। বৈসাবি উপলক্ষে প্রতি বছর ১৮-২০টি অ্যালবাম বের হতো। আশির দশক থেকে পাহাড়ি গানের পরিচিত মুখ রণজিৎ দেওয়ান, অমর শান্তি চাকমা, রলি চাকমা, নেত্রী রায়, আল্পনা চাকমা, পটন চাকমা, সুরেশ ত্রিপুরা, উত্তমা খীসা, রূপায়ন দেওয়ান, উত্তম দেওয়ানসহ অনেকে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
এসও/জেএইচ

** নাম নয়, বদলে যাবে চেহারা
** চট্টগ্রামে ব্যান্ডসংগীতের চিত্র আশা জাগানিয়া
** শেফালী ঘোষের ভিটেমাটি ঘুরে
** চট্টগ্রামে ভেঙে ফেলা হচ্ছে আরও দুটি প্রেক্ষাগৃহ
** বন্দরনগরীতে এখনও মুনমুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ