ঢাকা: উঁচু প্রাচীরে ঘেরা আবাসিক ক্যাম্পাস। সুবিন্যাস্ত খেলার মাঠ।
শৃঙ্খলা ছুটি নিয়েছে। ইচ্ছে হলেই দেওয়াল টপকে ছাত্ররা বাইরে চলে যাচ্ছেন। প্রয়োজন মিটিয়ে হোস্টেলে ফিরে আসছেন সেই গোপন স্থান দিয়ে। প্রতি রাতেই এই দৃশ্য দেখেন স্থানীয় মানুষজন। বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার রাতে ছাত্রদের দেওয়াল টপকানোর প্রবণতা একটু বেশিই থাকে। ছাত্র হোস্টেলের উত্তর পাশে প্রাচীরের বাইরে সেজন্য গড়ে উঠেছে দোকানপাট। সেখানে সিগারেট তো পাওয়া যায়ই, কেউ ইচ্ছে প্রকাশ করলে গঞ্জিকা নিয়েও হোস্টেলে ফিরতে পারেন। ফেরেনও। জিরানী বাজার এবং ছাত্র হোস্টেলের উত্তর পাশে দুই রাত পর্যক্ষেণ করে এই দৃশ্য দেখা গেছে।
বিকেএসপি‘র মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এম সালেহীন নির্দ্বিধায় স্বীকারও করেছেন ছাত্ররা দেওয়াল টপকে বাইরে যাতায়াত করে। পাহাড়া দাঁড় করিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছেন না তিনি। বলছিলেন,“আমি স্বীকার করি ছেলেরা বাইরে যায়। কিন্তু আগের চেয়ে সেটা অনেক কমে এসেছে। এখন হয় তো দিনে পাঁচ থেকে সাতজন যাচ্ছে। একসময় তো অনেক বেশি যাতায়াত করতো। আমি কঠোর নিয়মে বিশ্বাসী নই। ছেলেদের বলেছি তোমরা নিয়ম ভাঙ্গলে শাস্তি পাবে। তাদেরকে বুঝিয়ে বাইরে যাওয়া রোধ করার চেষ্টা করছি। ”
শৃঙ্খলা আছে দাবি করে বিকেএসপি মহাপরিচালক জানান,“এখানে শৃঙ্খলার কোন ঘাটতি নেই। এই তো কয়েকদিন আগে আমি ১১ জন ছেলেকে বের করে দিয়েছি। প্রত্যেকেই দেওয়াল টপকে বাইরে গিয়েছিলো। ”
সত্যিটা হলো হকি বিভাগের চারজন প্রশিক্ষণার্থী অনুমতি ছাড়াই রাজশাহী লিগে খেলতে গিয়েছেন দেওয়াল টপকে। বিকেএসপির হাউজ মাস্টার বা নিরাপত্তা কর্মীরা কোন খোঁজই রাখেননি। শেষে রাজশাহী থেকে ফোন করে হকির কোচকে বিষয়টি জানানো হয়। এরপর হকি বিভাগ থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হয় ছেলেগুলোকে বের করে দেওয়ার। পলায়নের ঘটনা ফুটবলেও ঘটেছে এবং প্রশিক্ষণার্থীরা হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। মহাপরিচালক ঘটনা অবহিত হওয়ার পরেও শাস্তি দেননি। এই ঘটনা বিকেএসপিতে এখন নিয়মিত।
প্রশিক্ষণার্থীদের উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ আবাসিক হোস্টেলে ছাত্র-ছাত্রীদের সেলফোন ব্যবহারের অনুমতি প্রদান। বিকেএসপির বর্তমান মহাপরিচালক এম এম সালেহীন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেলফোন ব্যবহারের অনুমতি দেন। সেলফোনে যোগাযোগ করে ছাত্ররা বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করছেন। মেয়েবন্ধুরাও চলে আসেন দেখা করতে। দুইদিনের পর্যবেক্ষণে এই দৃশ্যও দেখা গেছে। চিত্রনাট্য পাল্টে যাওয়ার পেছনে সেলফোন অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন কোচ এবং শিক্ষকরা। কিন্তু তারা কেউ প্রতিবাদ করতে পারেন না মহাপরিচালকের ভয়ে। ঝুটঝামেলা মুক্ত থাকতে বিকেএসপি প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাত্রদের শৃঙ্খলার বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। মহাপরিচালকের চোখ এড়িয়ে ওই কর্মকর্তারা দুঃখ প্রকাশ করলেও সামনে কিছু বলতে রাজি হননি। এমনকি নাম প্রকাশ করতেও ভয় পান চাকরির ক্ষতি হবে বলে।
সেলফোন বিষয়ে মহাপরিচালকের ব্যাখ্যা হলো,“আমি একদিন ক্রিকেট মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। পাশ থেকে কয়েকজন মেয়ে আমাকে ‘হ্যাপি ফাদারস ডে’ উৎসর্গ করেন। আমি তাদের কাছে জানতে চাই, তাদের বাবাকে উইশ করেছে কি না। তারা আমাকে জানায় ফোন না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এরপর আমি তাদেরকে ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেই। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে কেউ দূরে থাকতে পারে না। আমার ছেলের মোবাইল আছে। বিকেএসপির ছাত্রদের থাকবে না কেন?”
যাদের সামর্থ্য আছে তারাই মোবাইল ব্যবহার করেন। ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ দরিদ্র পরিবার থেকে আসায় সেলফোন ব্যবহারের সুবিধা পায় না। এথেকেও একধরণের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। শুধু তাই না কোচরা অভিযোগ করেছেন রাতভর সেলফোনে কথা বলে প্রশিক্ষণার্থীরা সকালে অনুশীলন করতে পারে না। অসুস্থ বোধ করে। খেলোয়াড় তৈরিতে সেলফোন এখন একটা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে বিকেএসপিতে। অথচ বিকেএসপি মহাপরিচালক শৃঙ্খলবাহিনীর মানুষ হয়েও বিশৃঙ্খলা মেনে নিচ্ছেন!
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১১