ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

খেলা

বিশ্বকাপ টিকিট ক্রেজ

অপেক্ষা, ভাঙচুর, লাঠিচার্জ, উল্লাস

আনোয়ারুল করিম/রহমান মাসুদ/তুহিন শূভ্র অধিকারী/মুহিবুব জামান/মহিউদ্দিন জুয়েল/তানিন মেহেদি/রিয়াজ রায়হান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১১
অপেক্ষা, ভাঙচুর, লাঠিচার্জ, উল্লাস

ঢাকা: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্ধারিত ব্যাংক থেকে রোববার সকালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে টিকিটের চেয়ে প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শোরগোল, ভাঙচুর, সড়ক অবরোধের খবর পাওয়া গেছে।

মিরপুর, বনানী, নিউমার্কেটে টিকিট না পেয়ে বিক্ষোভ শুরু করলে ক্রিকেটভক্তদের পুলিশ লাঠিপেটা করে। মিরপুরে পুলিশের লাঠিপেটায় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সানের একজন আলোকচিত্রী আহত হয়েছেন।

মিরপুর থেকে আমাদের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সেকান্দার আলী জানিয়েছেন, দুপুর ১২টার দিকে একদল টিকিটপ্রত্যাশী গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় বেশ কিছুক্ষণ তারা সড়ক অবরোধ করে রাস্তায় অবস্থান নেন। পরে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। পুলিশের লাঠিপেটায় আহত আলোকচিত্রীর নাম মিনহাজ।

এর আগে সেখানে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে একটি বুথ থেকে ৩/৪টি টিকিট বিক্রির পরপরই ‘টিকিট শেষ হয়ে গেছে’ জানানোর পর সেখানে দীর্ঘঅপেক্ষারত ক্রিকেটভক্তরা বিক্ষোভ শুরু করেন।

বনানীতেও টিকিট প্রত্যাশীদের পুলিশ লাঠিপেটা করেছে বলে জানিয়েছেন আমাদের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মুহিবুব জামান।

তিনি জানান, ভোরের দিকে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে হট্টগোল শুরু হলে এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। সকাল ১১টা পর্যন্ত মাত্র ৪/৫ জন টিকিট পেয়েছেন। বাংলাদেশ-ভারতের টিকিট শেষ হয়ে গেছে। প্রায় ৩ হাজার মানুষ লাইন ধরে টিকিটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

অবশ্য বনানী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অপূর্ব হাসান বলেন, ‘আমরা লাঠিচার্জ করিনি। এখন পর্যন্ত এখানে কোনো গণ্ডগোল হয়নি। ’

বনানী কেন্দ্রে অপেক্ষারত মনির হোসেন নামে এক টিকিট প্রত্যাশী জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় লাইনে দাঁড়ালেও এখনো টিকিট পাননি।

মিরপুর ১ নম্বরে সিটি ব্যাংকের সামনে আছেন আমাদের আরেক স্টাফ করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ। তিনি জানিয়েছেন, শনিবার বিকেল সাড়ে চারটা থেকে অপেক্ষার পর সাড়ে ১০টার দিকে প্রথম টিকিটটি পান পল্লবীর বাসিন্দা জামাল হোসেন ও দিলার হাসাপন পপি দম্পতি। ওই কেন্দ্রেই অন্তত ৬/৭ হাজার টিকিট প্রত্যাশী অপেক্ষা করছেন বলেও জানান তিনি। তবে টিকিটের চেয়ে প্রত্যাশীর সংখ্যা কয়েকগুণ হওয়ায় প্রাপ্তি নিয়ে দেখা দিয়েছে আশঙ্কা।

সকাল ১০টা ২৬ মিনিটে সৈয়দা দিলারা হাসান পপি ও জামাল হোসেন দম্পতি টিকিট নিয়ে বের হন।

তারা জানান, গতকাল বিকেল সাড়ে চারটা থেকে তারা দু’জন লাইনে অপেক্ষা করছিলেন।

‘এতো অপেক্ষার পরও টিকিট পেয়ে আমরা খুব খুশি। ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের দুটি করে চারটি টিকিট পেয়েছি’, বলেন দিলারা।

ওই কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক নারী টিকিট প্রত্যাশীও অপেক্ষায় ধৈর্য নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। নারী-পুরুষের অনুপাত অনুযায়ী দুইজন পুরুষের বিপরীতে একজন নারীকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে থেকে আমাদের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট তুহিন শূভ্র অধিকারী জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণভাবেই সেখানে টিকিট বিতরণ হচ্ছে। তবে প্রাপ্তি নিয়ে সেখানেও প্রত্যাশীদের মাঝে বিরাজ করছে শঙ্কা।

এই কেন্দ্রটির সামনে ভোর চারটার দিকে ‘বাংলা ব্রিগেড’ ব্যানারে একদল যুবক  অবস্থান নিয়ে লাইনে অপেক্ষারত অন্যদের উত্ত্যক্ত করতে থাকে। এক পর্যায়ে বাধার মুখে তারা অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যা ৬ পর্যন্ত টিকেট বিক্রি চলবে বলে বিকেল ৫টার পরও সেখানে হাজার দেড়েক টিকিট প্রত্যাশীকে  অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

আজহার হোসেন নামে এক টিকিট প্রত্যাশী বলেন, ‘লাইনে আমার অবস্থান ৪২০ নম্বর। শুনেছি এই কেন্দ্র থেকে ৪৮০টি টিকিট দেওয়া হবে। অনেকেই একাধিক টিকিট কিনছেন। সেক্ষেত্রে পাব কিনা আল্লাহই জানেন!’

মতিঝিল আমিন কোর্ট থেকে স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মহিউদ্দিন জুয়েল জানিয়েছেন, বিপুল সংখ্যক মানুষ সেখানে টিকিটের জন্য ভিড় করেছেন। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইন দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

নিউমার্কেট থেকে ইউনিভার্সিটি তানিন মেহেদি জানিয়েছেন, সেখানে টিকিট প্রত্যাশীরা বিক্ষোভ শুরু করলে তাদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে।

কাওরান বাজার থেকে স্টাফ করেসপন্ডেন্ট রিয়াজ রায়হান জানান, প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ সিটি ব্যাংকের এই শাখায় শনিবার দুপুর থেকে অপেক্ষা করছে। অপারেটিং সিস্টেমে বিঘœ ঘটায় সকাল ১১টা থেকে এ ব্যাংকে টিকিট দেওয়া শুরু হয়। ব্যবসায়ী ইয়াবার সাইদ এই শাখা থেকে প্রথম টিকিট হাতে পান।

সিটি ব্যাংকের উত্তরা শাখায়ও টিকিটের জন্য বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।

ওদিকে, রাজধানীতে যেসব কেন্দ্র থেকে টিকিট বিতরণ করা হচ্ছে তার প্রতিটির সামনেই বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত আছেন।

রাজধানীর সিটি ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের নির্ধারিত রোববার সকাল থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হয়।

এর আগে শনিবার রাত দশটা থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত রাজধানীর সিটি ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের ৬টি শাখা ঘুরে দেখা গেছে বিপুল সংখ্যক ক্রিকেটভক্ত সেখানে অপেক্ষা করছেন।

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আনোয়ারুল করিম জানান, সায়েন্স ল্যাবরেটরির পাশে সিটি কলেজের উল্টোদিকের সিটি ব্যাংকের সামনেও শনিবার সকাল থেকেই টিকিটের জন্য অপেক্ষা করছেন অনেকেই। সেখানে রাত সাড়ে তিনটার দিকে গিয়ে দেখা যায় লাইন ঠিক রেখে অনেকে ফুটপাতের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে শুয়ে আছেন।

কারওয়ানবাজারের ইউটিসি ভবনের সিটি ব্যাংকের সামনে অপেক্ষমানদের রাত সাড়ে চারটা পর্যন্ত লম্বা কোনো লাইন দেখা যায়নি। কারণ তারা ভবনের প্রবেশপথের সিড়িতে জটলা করে বসে থাকেন। ইউটিসি ভবনের নিরাপত্তারক্ষী মাজেদ রাত সাড়ে চারটায় বাংলানিউজকে বলেন, ‘শনিবার সকাল দশটার দিকে এখানে লাইন দাঁড়ানো শুরু হয়। সন্ধ্যার মধ্যেই অন্তত পাঁচশ’ মানুষ জড়ো হয়েছেন। ’

রাজধানীর মালিবাগ মোড়ের বাপেক্স ভবনের সিটি ব্যাংকের প্রধান ফটকের দু’দিকে দু’টি লাইনে ক্রিকেট ভক্তরা দাঁড়িয়েছেন। এদের মধ্যে একটি লাইনের মানুষের হাতে শনিবার সন্ধ্যার দিকে কেউ একজন টোকেন বিক্রি করেন। নিজেদের স্বার্থেই তিন টাকা দিয়ে ওই টোকেন কেনেন অপেক্ষমানরা।

সাড়ে তিনশ’ টোকেন সেখানে বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অপর একটি লাইনে দাঁড়ানোদের হাতে কোনো টোকেন নেই। তাদের দাবি, টোকেন তো ব্যাংকের কেউ দেয়নি। তবে কেন তা নিয়ে লাইনে দাঁড়াবো।

রাত পৌনে তিনটার দিকে এখানে অপেক্ষমানদের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হলে কিছুটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পাশের সড়কে অবস্থান করা টহল পুলিশের একটি দল থেকে পুলিশের দু’জন সদস্য ভিড় ঠেলে বাপেক্স ভবনের ফটকে অবস্থান নেন। তবে তারাও বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে ওই স্থান ত্যাগ করে পিকআপে গিয়ে বসে পড়েন। এভাবেই ভোর পর্যন্ত সবাই দাঁড়িয়ে থেকে ঠেলাঠেলি করতে থাকে।

মতিঝিলের আমিন কোটের অগ্রণী ব্যাংকেও একই অবস্থা। সেখানে ব্যাংকের ফটকের পাশে প্রথম কয়েকজনের মধ্যে দাঁড়ানো শফিকুল ইসলাম জানান, তিনি শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় এখানে এসেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া তার পুত্রের জন্যই মূলত তিনি টিকিট কিনতে এসেছেন।

যাত্রাবাড়ীতে বসবাসকারী শফিকুল আরো বলেন, ‘টিকিট ছাড়া তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। ’ ব্যাংকটির পাশের সড়কের চা বিক্রেতা রহিম জানান, শনিবার সন্ধ্যার মধ্যেই তিন-চারশ’ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে যায়।

ব্যাংকগুলোর সামনে অপেক্ষমানদের এভাবে লাইনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন অনেকেই । এদের কেউ কেউ টেলিটকের সিম বিক্রির মতো অব্যবস্থাপনার কথাও স্মরণ করেন। প্রযুক্তিজ্ঞান রয়েছে এমন কয়েকজন বলেন, ‘শেয়ার বাজারের আইপিও ছাড়ার মতো অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে লটারি করে টিকিটের ব্যবস্থা করার বিকল্প কিছু ছিলনা। ’

ব্যাংকগুলোর সামনে ক্রিকেটভক্তদের ভিড়ের ব্যাপারে শনিবার রাত চারটায় টহলরত অবস্থায় মতিঝিল থানার এসআই রফিকুল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আমরা কন্ট্রোল রুমকে সার্বক্ষণিক অবহিত করছি। সকালের দিকে আরো ফোর্স পাঠানোর জন্য বলেছি। ’ তিনি আরও বলেন, ‘টিকিট প্রত্যাশীরা শান্তিপূর্ণভাবে লাইনে থাকলে আমরা খুশি। ’    

আইসিসির স্পন্সর মানিগ্রামের বাংলাদেশে অন্যতম অপারেটিং পার্টনার হচ্ছে সিটি ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংক দুটি সারা দেশে ৮০টি শাখার মাধ্যমে রবিবার থেকে একযোগে শুরু করছে টিকিট বিক্রি। সিটি ব্যাংকের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাশরুর আরেফিন জানিয়েছেন, ‘প্রতিটি শাখা থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৪৮০টি টিকিট ইস্যু করতে পারবেন তারা। ’

এদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল শনিবার জানান, নতুন হিসাবে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ধারণমতা ২৫ হাজার ১৬৭। এর মধ্যে ১৫ হাজার ১২৭ টিকিট ব্যাংক থেকেই বিক্রি হবে। প্রতি ম্যাচের বাকি টিকিটের মধ্যে সৌজন্য এবং বিশেষ ব্যবস্থায় বিক্রি হবে ৭হাজার ৪৪১টি।

তিনি বলেন, ‘মিরপুর স্টেডিয়ামের ১হাজার ৯০০টি আসনে দর্শকদের বসানো হবে না সাইটস্ক্রিনের জন্য। এছাড়া আইসিসিকে দিতে হবে ৩ হাজার ২৭০টি টিকিট। এর বাইরে ১ হাজার ২৭০টি সৌজন্য টিকিট হিসেবে, বাকি ২হাজারটি তারা (আইসিসি) কিনে নেবে।

বিশেষ সুবিধায় ঢাকার ৭২টি কাব কিনবে ১ হাজার ৭৪০টি টিকিট এবং ৬৪টি জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও ৭টি বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাকে একই সুবিধায় দেওয়া হবে আরও ২ হাজার ১৩০টি টিকিট। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ও ২৪ জন পরিচালকও অবশ্য বিশেষ কোটায় ১৬টি করে টিকিট পাবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad