ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

একাত্তর

আত্মসমর্পণেই হানাদারদের মুক্তি, আমাদের বিজয়

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
আত্মসমর্পণেই হানাদারদের মুক্তি, আমাদের বিজয়

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান বাহিনীর কমান্ডার নিয়াজিকে ও তার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানের অপারেশনের জন্য প্রশংসা করলেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান বাহিনীর কমান্ডার নিয়াজিকে ও তার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানের অপারেশনের জন্য প্রশংসা করলেন। সেই সঙ্গে বললেন, আপনি (নিয়াজি) এখন এমন একপর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া মনুষ্য ক্ষমতায় সম্ভব নয়।


 
জেনারেল রাও ফরমান আলী মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ’র কাছে এক বার্তা পাঠালেন। তিনি এ বার্তায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেন। তিনি এই যুদ্ধবিরতি বার্তায় আরো কয়েকটি বিষয় তুলে ধরলেন যেমন- পাকিস্তান সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা, মুক্তিবাহিনীর প্রতিশোধ পরায়ণতা থেকে বেসামরিক জনগণকে রক্ষা, অসুস্থ ও আহতদের চিকিৎসা এবং নিরাপত্তা দেওয়া।
 
জেনারেল নিয়াজি-ফরমান মানেকশ’কে ওই বার্তা পাঠিয়ে তার উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকলেন। কিন্তু রাত পর্যন্ত কোনো জবাব এলো না। কারণ যুদ্ধবিরতির বিষয়টি মধ্যস্থতা করতে নিয়াজি ও ফরমান আলী ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেল মি. স্পিভাককে বেছে নিলেন। স্পিভাক এই বার্তাটি জেনারেল মানেকশ’কে না পাঠিয়ে সোজা ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বার্তাটি পরে মানেকশ’কেও পাঠানো হলো। নিক্সন-কিসিঞ্জার-ইয়াহিয়ার হাত ঘুরে অবশেষে বার্তাটি মানেকশ’র হাতে এসে পৌঁছায়।
 
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। নিয়াজি-ফরমান আলীর অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। তারা জেনারেল মানেকশ’র কাছে পাঠানো বার্তাটির জবাব পেলেন। মানেকশ’ সাফ জানিয়ে দিলেন, যুদ্ধবিরতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে যদি পাকিস্তান বাহিনী তার অগ্রবর্তী সৈনিকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
 
মানেকশ’র এ বার্তাটি নিয়াজি সিদ্ধান্তের জন্য রাওয়ালপিন্ডি পাঠিয়ে দিলেন। ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়ই পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জানিয়ে দিলেন, শর্তগুলো যদি নিয়াজির প্রয়োজন মেটায়, সেক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতি করা যেতে পারে।  
 
১৫ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে পরের দিন সকাল নয়টা পর্যন্ত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলো। পরে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানো হলো। নিয়াজিকে শর্তগ্রহণের অনুমোদন দিলেন জেনারেল হামিদ। নিয়াজি তার চিফ অফ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকীকে বিভিন্ন স্থাপনায় এ যুদ্ধবিরতির এ বার্তাটি পাঠিয়ে দিতে বললেন।
 
জেনারেল মানেকশ’ নিয়াজিকে বার্তা পাঠিয়ে আরো জানিয়ে দিলেন যে আত্মসমর্পণ করলে পাকিস্তানী সব সেনা ও প্যারামিলিশিয়া বাহিনীকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক তারা যারাই হোক না কেন তাদেরও পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
 
মানেকশ’ তার ওই বার্তাটি সব কমান্ডারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানালেন। যাতে তারা যৌথবাহিনীর কাছে অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করে। মানেকশ’ বললেন, আমি নির্দ্বিধায় আপনাকে এই আশ্বাস দিতে পারি, যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের মর্যাদা, সম্মান জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী হবে। এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সম্মতি পেলে অবিলম্বে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল অরোরাকে নির্দেশ দেওয়া হবে। এই বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে ঢাকায় আজ পাঁচটা থেকে বিমান আক্রমণ বন্ধ থাকবে।
 
এদিকে, ১৫ ডিসেম্বরই ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, বাস্তব অবস্থা ও প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে পৃথিবীর মহান নেতৃবৃন্দ কার্যকর উদ্যোগ নিলে এই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া যেতো। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো জানিয়ে দিলেন, যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ এগিয়ে আসতো তাহলে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
 
তিনি ওই চিঠিতে আরো বলেন, বাংলাদেশের মূল ফ্যাক্টর শেখ মুজিবের সঙ্গে সমঝোতায় আসা অনিবার্য ছিল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রকৃত সমস্যা সমাধানে এগিয়ে না এসে কেবলমাত্র ‘ঠোঁট নাড়াতে’ ব্যস্ত ছিল। পাকিস্তানী শাসকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবতা ও স্বাধীনতার চেয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেবে। পাকিস্তান যদি সর্বাত্মক আক্রমণ না চালাতো তবে যুদ্ধ এড়ানো যেতো। বাংলাদেশের কোনো ভূখণ্ড বা পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো এলাকা দখল আমাদের লক্ষ্য ছিল না। এ সময়ে সোভিয়েত রাশিয়া খুব দ্রুত বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের ওপর চাপ দিয়ে আসছিল। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল,Liberate Bangladesh in the shortest possible time. 

সোভিয়েতের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত ছিল, ভারত মহাসাগরে আসা সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করলে রাশিয়ার নৌবহর ইন্টারভেন করতো। যা ভারত মহাসাগরেই ছিল। যদি চীন লাদাখ এলাকায় এগিয়ে আসতো তবে চীনের সিনকিয়াং এলাকায় যেতো সোভিয়েত। উল্লেখ্য, সোভিয়েত এ  সময় ৪০ ডিভিশন সৈন্য চীন সীমান্তে মোতায়েন করে।
 
ইন্দিরা গান্ধীর চিঠির জবাবে বিজয়ের দুই দিন পরে (১৮ ডিসেম্বর) নিক্সন যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তা ছিল দুর্বল ও ডিফেন্সিভ। এতে কৌশলে শেখ মুজিবের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর চিঠির মূল বিষয় ছিল শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে সমঝোতা করলে এই ভয়াবহ যুদ্ধ এড়ানো যেতো। চিঠিতে নিক্সন সেদিকে না গিয়ে বলেন, এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য ভবিষ্যতে দু’দেশ পুনরায় একত্রে কাজ করবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বিগত কয়েক মাসের ঘটনায় তিনি গভীরভাবে মর্মাহত।
  
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি শেষ বারের মতো বিবেচনা করার জন্য আবেদন জানালেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় ইয়াহিয়া খানও এটাকে উপেক্ষা করলেন।
 
এদিকে নিয়াজির অবস্থা শোচনীয়। আকাশ তাদের দখলে নেই, মাটিও বেদখল। বিমান ঘাঁটিগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। সৈন্যেরা মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। নতুন করে সৈন্য সমাবেশ সম্ভব না। সব অবস্থা বিবেচনা করে প্রেসিডেন্ট গভর্নরকে জানালেন যে আন্তর্জাতিকভাবে যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার (গভর্নরের) কাছেই দিলেন এবং আরো জানালেন যে নিয়াজিকে তিনি তার (গভর্নরের) নির্দেশ মেনে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। জেনারেল হামিদও নিয়াজিকে গভর্নরের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আদেশ দিলেন।

গভর্নর একটি বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধবিরতির আবেদন জানিয়ে বলেন, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি দিতে, সম্মানের সঙ্গে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরতে, পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে ইচ্ছুক সব পশ্চিম পাকিস্তানী লোকজনের ফেরার ব্যবস্থা করতে এবং ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।  

তিনি আরো বলেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে এটি একটি নিদির্ষ্ট প্রস্তাব।  
তিনি শেষবারের মতো ফাঁকা হুমকি দিয়ে বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। যদি এ প্রস্তাবটি গ্রহণ করা না হয় তবে সশস্ত্র বাহিনীর শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
 
নিয়াজি চেয়েছিলেন শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণ। কিন্তু তার বার্তা থেকে মনে হলো এটি যুদ্ধবিরতি, আত্মসমর্পণ নয়। যৌথবাহিনী চেয়েছিল বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ। তাই নিয়াজির প্রস্তাবে যৌথবাহিনী রাজি হয়নি। তবে যৌথবাহিনী এ নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হবে।  

মানেকশ’র ওই বার্তায় নিয়াজি সম্মত না হওয়ায় ১৬ ডিসেম্বর থেকে সর্বাত্মক আক্রমণের হুশিয়ারি দেওয়া হয়। ফলে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। বাস্তবতা তখন-আত্মসমর্পণেই ওদের মু্ক্তি, আমাদের বিজয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
এসআই 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।