ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

সেদিনের কথা মনে হলে এখনও আঁতকে ওঠেন শহীদ শিহাবের মা-ভাই

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৫, জুলাই ২১, ২০২৫
সেদিনের কথা মনে হলে এখনও আঁতকে ওঠেন শহীদ শিহাবের মা-ভাই ওয়াকিল আহমেদ শিহাব।

ফেনী: ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে দেশ যখন স্বৈরাচার মুক্তির দ্বারপ্রান্তে, ঠিক আগের দিন ফেনীর মহিপালে ঘটে যায় ভয়ঙ্কর এক অধ্যায়। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নিরীহ ছাত্রদের ওপর চালানো হয় পৈশাচিক গুলিবর্ষণ।

ঝরে যায় আটটি তাজা প্রাণ। সব মিলিয়ে ফেনীতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ জনে। বছর ঘুরলেও মিলছে না সান্ত্বনা, গ্রেপ্তার হয়নি হামলার মূল হোতারা, শুরু হয়নি বিচার প্রক্রিয়া, উদ্ধার হয়নি হামলায় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রও।

সেদিন পিঠে, মাথায় ও পায়ে গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে যায় শহীদ ওয়াকিল আহমেদ শিহাবের (২০) শরীর। সহযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনেই পড়ে থাকে তার লাশ।

সবদিক খোঁজাখুঁজির পর জরুরি বিভাগের সামনে পড়ে থাকা লাশগুলো দেখছিলেন নিহতের ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম। প্রথম লাশটির মুখের কাপড় সরিয়ে দ্বিতীয়টির মুখ ঢাকা কাপড় সরাতেই ভাইয়ের লাশ দেখে আঁতকে ওঠে সে।  

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাই হত্যার ভয়াবহ স্মৃতি তুলে ধরেন ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামের আফতাব ভুঞা বাড়ির সৌদিপ্রবাসী মো. সিরাজুল ইসলামের ছেলে সায়েম।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলে, ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বাড়িতে এসে আম্মুর সঙ্গে দেখা করেন ভাইয়া। আম্মু তাকে চুল কাটতে টাকা দিয়ে সেলুনে যেতে বলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আম্মুর সঙ্গে কথা বলে বিদায় নেন ভাইয়া। সেটিই ছিল আম্মুর সঙ্গে শেষ দেখা। আম্মুর সঙ্গে কথা বলে এক বন্ধুর সঙ্গে রাস্তার দিকে যায় ভাইয়া। দুজনে নাস্তা করে ভাইয়া সেলুনে যান। এরপর ভাইয়ার কাছে এক বন্ধু ফোনকল করে জানতে চায় আন্দোলনে যাবে কিনা। তখন ভাইয়া সেলুনে। বন্ধুর ফোনকল পেয়ে সেলুন থেকে বের হয়ে মহিপাল আন্দোলনে যান ভাইয়া।

সায়েম বলে, সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে শামিল হন ভাইয়া। যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন ভাইয়ার সেই বন্ধু ফ্লাইওভারের ওপর আর ভাইয়া সার্কিট হাউস রোডে ঢুকলে তার ওপর এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। এতে ভাইয়ার মাথায়, পিঠে ও পায়ে তিনটি গুলি লাগে।

সে আরও বলে, সেদিন দুপুরে আমি ভাত খাচ্ছিলাম। তখন আম্মু বললো শিহাব এত দেরি করছে কেন, তার খোঁজ নে। ভাইয়াকে অনেকবার ফোনকল দিলেও ধরেননি। ভাইয়া যেখানে কাজ করেন সেখানেও খোঁজ নিই, ততক্ষণে তারা জানলেও আমাদের কিছুই বলেননি।

বিকেলে এসব বিষয় নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন একজন জানান, ভাইয়া ফেনী জেনারেল হাসপাতালে আছেন। আমরা ভেবেছি ভাইয়া কাউকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন, তাই দেরি হচ্ছে। তখন আমার এক আত্মীয় ফোনকলে জানান ভাইয়া গুলিবিদ্ধ।

সায়েম বলে, এরপর আমি আর চাচ্চু হাসপাতালে যাই। ভাইয়াকে যখন খুঁজছিলাম তখন জরুরি বিভাগের সামনে আরও পাঁচ থেকে ছয়টি লাশ পড়েছিল। লাশ বুঝে নেওয়ার পর সবাই বলাবলি করছিল, দেরি করলে লাশ গুম করে ফেলবে। এরপর তড়িঘড়ি করে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ভাইয়ার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি। সেদিন আম্মু সারাদিন অজ্ঞান ছিল। নিজেকে দোষ দিচ্ছিল কেন চুল কাটাতে বলেছি। কিন্তু ভাইয়া চুল না কেটে আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হন।

সবসময়ই মানুষের উপকারে কাজ করতো শিহাব। রক্তদান কর্মসূচি, সামাজিক কার্যক্রম ও খেলাধুলার সঙ্গে লেগে থাকতো সবসময়। ইচ্ছা ছিল বিদেশ যাবে। তাই মহিপাল প্লাজায় মোবাইল দোকানে মোবাইল ফোন মেরামতের কাজ শিখছিল শিহাব।

ছেলের জন্য এখনও আহাজারি করছেন শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার। তিনি বলেন, ছেলে সবসময় আমার কাছাকাছি থাকতো, সেদিনও আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে। কিন্তু কে জানতো সেটিই ছিল শেষ দেখা। আন্দোলনে গিয়েছিল শিহাব, খুনিরা তাকে মেরে ফেলল। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।

শিহাবের বাবা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। এখন এই হত্যার বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের তথা সরকারের দায়িত্ব। শিহাব হত্যার বিচার চেয়েছেন এলাকাবাসীও।

দক্ষিণ কাশিমপুর এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী জানান, শিহাব সবসময় ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতো। যে-কারও প্রয়োজনে সবার আগে দৌড়ে যেত। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে গুলি করে তাকে হত্যা করেছে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

এ ঘটনায় গত ২০ আগস্ট রাতে শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বাদী হয়ে ১৫১ জনের নাম উল্লেখ ও আরও ১০০-১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে ফেনী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম এবং ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বর আসামি করা হয়েছে।

পরিবারে দুই সন্তানের মধ্যে বড় শহীদ শিহাব ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ২০২১ সালে জায়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে পরে স্থানীয় মহিপাল প্লাজায় মোবাইল মেকানিকের কাজ শিখছিলেন। তার ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম স্থানীয় একটি মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।

এসএইচডি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।