ঢাকা, শুক্রবার, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি-২০২০

উচ্চ আদালতের আলোচিত যত আদেশ ও রায়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০
উচ্চ আদালতের আলোচিত যত আদেশ ও রায় ...

ঢাকা: করোনা মহামারির বছরে দুই পদ্ধতিতে (ভার্চ্যুয়াল ও শারীরিকভাবে) উচ্চ আদালতের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে অনেক আলোচিত রায় ও আদেশ এসেছে দেশের উচ্চ আদালত থেকে।

ক্ষতিপূরণের রায় পেয়েছেন পা হারানো রাসেল সরকার ও বিনাদোষে জেল খাটা জাহালম। জামিন প্রত্যাহার করা হয়েছে আলোচিত কারাবন্দী ঠিকাদার জিকে শামীমের। ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জেরে এক আইনজীবী ক্ষমা চেয়ে পার পেলেও অপর আইনজীবীকে তিন মাসের জন্য আইনপেশা পরিচালনা থেকে বিরত রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত। ঠিক করে দিয়েছেন যাবজ্জীবন দণ্ডের সীমাও।

তাৎক্ষণিক মৌলিক অধিকার রক্ষায় অন্তত তিনবার রাতে বসেছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ। রাতে বসে আদেশের কারণে তাৎক্ষণিক মুক্তি পেয়েছেন বরিশালের চার শিশু। নিজ পিতার বাসায় ফিরেছেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের দুই নাতি। একই সুযোগ পেয়েছেন কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদেরে দুই ভাতিজিও।

তবে করোনার কারণে যখন সব বন্ধ হয়ে গেছে তখন জনগণকে আইনি প্রতিকার দিতে বসে থাকেনি বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। ফুল কোর্ট সভা করে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালানোর বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ। অপরদিকে নির্বাহী বিভাগ ভার্চ্যুয়াল আদালতের অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। শুরু হয় ভার্চ্যুয়াল বিচার কাজ। পরে সংসদ বসার পর তা আইনে পরিণত করা হয়।

জি কে শামীম

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় ওই ভবন থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা, এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ উদ্ধার ক‌রে আইন-শৃঙ্খলা বা‌হিনী।

ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ ও ৬ তারিখে তিনি হাইকোর্টের দুই বেঞ্চ থেকে অস্ত্র ও মাদক আইনের দুই মামলায় জামিন পান। মাসখানেক পরে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এরপর ৮ মার্চ সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ দুই মামলায় তার জামিন প্রত্যাহার করেন।

রাসেল সরকার

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল গ্রিন লাইন পরিবহনের ধাক্কায় প্রাইভেটকারচালক রাসেল সরকারের বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি রিট আবেদন করেন। এই রিট আবেদনে হাইকোর্ট ওই বছরের ১৪ মে রুল জারি করেন। এ রুল বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় রাসেল সরকারকে চিকিৎসা ব্যয়সহ মোট ১৩ লাখ টাকা দেয় গ্রিন লাইন। তবে রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ১ অক্টোবর তিন মাসের মধ্যে আরও ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে গ্রিনলাইনকে নির্দেশ দেন
হাইকোর্ট।

জাহালম

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি জাতীয় দৈনিকে ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না...’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেন হাইকোর্ট। এছাড়া রুলও জারি করেন । ৩ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টরা হাজিরের পর হাইকোর্ট জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন।

পরে এ ঘটনায় জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানির শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর এক রায়ে হাইকোর্ট জাহালমকে ১৫ লাখ টকা ক্ষতিপূরণ দিতে ব্র্যাক ব্যাংকে নির্দেশ দেন। অবশ্য এ রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছে ব্র্যাংকটি।

রাতের আদেশ

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় শিশু ধর্ষ‌ণের অভি‌যো‌গে দা‌য়ের করা মামলায় চার শিশুকে জামিন না দিয়ে য‌শোর কি‌শোর উন্নয়ন কে‌ন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ওই শিশুদেরকে পুলিশভ্যানে তোলার সময় তাদের কান্নায় হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে তা উচ্চ আদালতের নজরে আসে।

৮ অক্টোবর রাতে হাইকোর্ট তাদের জামিন নিস্পত্তি করতে আদেশ দিয়ে ওই চার শিশু‌কে রাতের মধ্যেই এসি মাইক্রোবাসে করে তাদের অভিভাবকদের নিকট পৌঁছে দিতে নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্ট আদালত তাদেরকে জামিন দেওয়ার পর রাতের মধ্যে তাদের যশোর থেকে মাইক্রোবাসে করে বরিশালে রওনা দেন কর্মকর্তারা। পরদিন সকালে শিশুদের অভিভাবকদের নিকট বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

৪ অক্টোবর শনিবার রাতে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছিলো সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল কে এস নবীর ছোট ছেলের দুটি শিশু নিয়ে। যাদেরকে তাদের চাচা বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। কিছুদিন আগে যারা বাবা হারিয়েছিলো। আর এ টকশোটি হাইকোর্ট বিভাগের নজরে আসায় শনিবার দিনগত মধ্যরাতে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাৎক্ষণিক আদেশ দেন। আদেশে ওই দুই শিশুকে তাদের বাসায় নিরাপদে রেখে আসতে ধানমণ্ডি থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। আদেশ অনুসারে রাত দেড়টার দিকে ওসি তাদের বাসায় পৌঁছে দেন।

বাবা মারা যাওয়ার পর সৎ মা সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের দুই ভাতিজিকে তাদের বাবা মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের গুলশান ২–এ ৯৫ নম্বর সড়কের বাসায় ঢুকতে দিচ্ছেন না। এ রকম প্রতিবেদন নজরে আসার পর ২৬ অক্টোবর রাতে দুই বোনকে অনতিবিলম্বে তাদের বাবার বাসায় প্রবেশ নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

এ আদেশ অনুসারে গুলশান থানার ওসি রাতেই দুই বোনকে বাবার বাসায় উঠিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।

ফেসবুক স্ট্যাটাস

আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বিচার বিভাগ নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন অভিযোগ তুলে তা আপিল বিভাগের নজরে আনেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আপিল বিভাগ বিষয়টি আমলে নিয়ে তাকে শোকজ করে তলব করেন। পরে সৈয়দ মামুন মাহবুব আপিল বিভাগে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে তিনি এ ধরনের অবমাননাকর কাজ থেকে বিরত থাকার নিশ্চয়তা দেন। শুনানি শেষে ২৩ আগস্ট তার আদালত অবমাননার মামলা নিষ্পত্তি করে দেন।

পরবর্তীতে আইনজীবী ইউনুছ আলীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আদালত নিয়ে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেওয়ায় অভিযোগ আনেন তৎকালীন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। আপিল বিভাগ তা আমলে নিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর তাকে তলব করে দুই সপ্তাহের জন্য আইনপেশা থেকে বরখাস্ত করেন। এছাড়া তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্লক এবং আপত্তিকর স্ট্যাটাস অপসারণ করতে বিটিআরটিসিকে নির্দেশ দেন। পরে ইউনুছ আলী হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। শুনানি শেষে ১২ অক্টোবর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে তিন মাস ইউনুছ আলীকে সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি তাকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

যাবজ্জীবন

২০০১ সালে সাভারে এক হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক আসামির মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায় ঘোষণার সময় আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে আমৃত্যু কারাবাস বলে উল্লেখ করেন। তখন যাবজ্জীবনের সময়সীমা নিয়ে আলোচনা সামনে আসে। এ অবস্থায় আসামিও এ রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করেন। সেই রিভিউ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করে ১ ডিসেম্বর রায় দেন আপিল বিভাগ। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুপ্রিম কোর্ট তাদের সংক্ষিপ্ত আদেশে যেটা বলছেন (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে), যাবজ্জীবন বলতে বোঝা যাচ্ছে যে সারাজীবনই হবে। আমৃত্যু হবে। তবে বিভিন্ন আইন, ধারা উপধারা বিশ্লেষণ করে আদালত বলছেন যে এটা (যাবজ্জীবন) ৩০ বছর। ধারাগুলো যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে ৩০ বছর। কিন্তু যদি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কেনো মামলায় কারো যদি আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সে ক্ষেত্রে ৩০ বছরের বিধানটি হবে না। আমৃত্যু হবে।

বাংলদেশ সময়: ১২০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২০
ইএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।