ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

সালতামামি

যুদ্ধে যুদ্ধে বছর পার

রকিবুল সুলভ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩
যুদ্ধে যুদ্ধে বছর পার খান ইউনিসের আল নাসের হাসপাতালের মর্গে মরদেহ আসতে দেখে ফিলিস্তিনি শিশুটি কাঁদছিল। ছবি: আনাদোলু

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর স্পষ্টতই বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ পরিলক্ষিত হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া এ যুদ্ধের দুই বছর হতে চলল।

আর ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধও বিশ্ব রাজনীতিকে নতুন রূপ দিয়েছে।  

এ দুই যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা সবখানে। নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধ মানেই অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব, রাজনীতির নতুন সংজ্ঞায়ন, অস্ত্র-বোমার নির্বিচার ব্যবহার, বহু মানুষের মৃত্যু। যুদ্ধে যুদ্ধে বিদায় নিতে যাচ্ছে আরও একটি বছর।  

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

ক্রিসমাস উদযাপন উপলক্ষে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ৫ জানুয়ারি একতরফাভাবে ইউক্রেনে ৩৬ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও কিয়েভ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং বিভিন্ন স্থানে লড়াই চালিয়ে যায়।

ইউক্রেনে রাশিয়ার শীর্ষ কমান্ডার সের্গেই সুরোভিকিনকে তার পদে বহালের মাত্র তিন মাসের মধ্যে সরিয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া যায় ১২ জানুয়ারি। পরদিনই রাশিয়া রাশিয়া দাবি করে, তারা পূর্ব ইউক্রেনের লবণ-খনির শহর সোলেদারের নিয়ন্ত্রণ দখল করেছে।

১৮ জানুয়ারি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কাছে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনিস মনাস্টিরস্কিসহ মোট ১৪ জন নিহত হন।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছে ট্যাংক চেয়ে আসছিল। কয়েকমাস অনিচ্ছার পরে আমেরিকা এবং জার্মানি ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর বেলারুশের প্রেসিডেন্ট অ্যালেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার নতুন আক্রমণের জন্য ঘাঁটি হিসেবে ফের নিজ দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিতে প্রস্তুত বলে জানান।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করার প্রথম বার্ষিকীর ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে আকস্মিক কিয়েভ সফর করেন। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দেন পুতিন।

মার্চের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে তার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর জানা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মতো নতুন দখলকৃত অঞ্চলে সফরে গিয়েছেন।  

মস্কোতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন পুতিন। তখন তিনি জানান, ইউক্রেনের জন্য চীনের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা যুদ্ধ বন্ধের ভিত্তি হতে পারে। মার্চের শেষভাগে লেপার্ড টু ট্যাংকের প্রথম চালান ইউক্রেনে পাঠানোর খবর জানায় জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

১৮ এপ্রিল ইউক্রেনের রুশ-অধিকৃত খেরসন অঞ্চলের কিছু অংশ পুতিন সফর করেন বলে জানা যায়। মার্চে তিনি ইউক্রেনের আরেক রুশ-অধিকৃত শহর মারিউপোলে গিয়েছিলেন।  

এপ্রিলের শেষ দিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও চীনের নেতা শি জিনপিংয়ের মধ্যে ফোনালাপ হয়। রুশ অভিযানের পর প্রথমবার তাদের আলাপ হয়। জেলেনস্কির ভাষ্যমতে, এটি ছিল একটি দীর্ঘ এবং অর্থপূর্ণ আলাপ।
৩ মে রাশিয়া ভোর রাতে মস্কোর ক্রেমলিনে ড্রোন হামলার চেষ্টা হয়। মস্কো তখন জানিয়েছিল, তাদের চোখে এটি পুতিনকে হত্যায় ইউক্রেনের চেষ্টা। তবে পুতিন ক্রেমলিনে ছিলেন না।  

২৩ মে জানা যায়, ইউক্রেনের ভেতর থেকে একটি সশস্ত্র দল রাশিয়ার বেলগোরোদ অঞ্চলে ঢুকে সংঘাতে জড়ায়। এতে বেশ কয়েকজন বাসিন্দা আহত হন বলে রুশ কর্তৃপক্ষ জানায়।

জুনের শুরুর দিকে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বাঁধ রাশিয়া উড়িয়ে দেয় বলে কিয়েভ অভিযোগ করে। তখন জেলেনস্কি দাবি করেন, বাঁধটি ধ্বংস হওয়ার কারণে ৮০টি শহর এবং বসতি বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানির স্রোত লোকালয়ে প্রবেশ করছে।

কদিন পর জেলেনস্কি জানান, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতীক্ষিত পাল্টা অভিযান শুরু হয়েছে। এ তথ্য দিলেও অভিযান কোন পর্যায়ে আছে, এবং কোন অঞ্চলে হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত বলতে অস্বীকৃতি জানান।  
জুনের মাঝামাঝি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম ধাপ স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান। এক ফোরামে তিনি বলেন, রাশিয়ার কোনো অঞ্চল হুমকিতে পড়লেই এটি ব্যবহার করা হবে।

২৩ জুন রাশিয়ার ভাড়াটে গোষ্ঠী ওয়াগনার গ্রুপ রুশ সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় বিদ্রোহ থামাতে রাজি হন প্রিগোজিন। এর দু-তিনদিন পরই ওয়াগনার গ্রুপ ভেঙে দেওয়ার খবর জানায় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে। জোটভুক্ত হওয়ার স্পষ্ট আশ্বাস না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হয় তাকে।  

আগস্টের শেষদিকে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও ২৪ ঘণ্টা পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, তিনি প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন, যিনি জীবনে বড় ভুল করেছেন। পরে প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন রুশ কর্মকর্তারা।  

সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণা নিয়ে ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে এক আনুষঙ্গিক অনুচ্ছেদে রাশিয়া শব্দটি উল্লেখযোগ্যভাবে বাদ দেওয়া সত্ত্বেও, সম্মেলনকে একটি সাফল্য হিসাবে অভিহিত করেছে হোয়াইট হাউজ। তবে অনুচ্ছেদে রাশিয়া শব্দটি বিশেষভাবে বাদ দেওয়ায় এর তীব্র সমালোচনা করে ইউক্রেন সরকার।

১২ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আন ব্যক্তিগত ট্রেনে রাশিয়া সফরে যান। দুই দেশের শীর্ষ নেতার বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এই সফরে চোখ ছিল কিয়েভ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের।  

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে বিশ্বের মনোযোগ অনেকটাই সরে আসে। ডিসেম্বরের শুরুতে হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারা সতর্ক করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সময় ও অর্থ দুই-ই ফুরিয়ে আসছে।  

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, লক্ষ্য অর্জিত হলেই কেবল ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আসবে।

একই সময়ে জানা যায়, ইউক্রেনের সহায়তায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৫০ বিলিয়ন ইউরোর একটি তহবিল আটকে দিয়েছে হাঙ্গেরি। ইউক্রেনকে ইইউর সদস্য করা নিয়ে আলোচনা শুরু করার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছানোর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাঙ্গেরি এ পদক্ষেপ নেয়।  

জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে মিল রেখে ৭ জানুয়ারি ক্রিসমাস বা বড়দিন উদযাপন করত। তবে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার বিরোধিতা আর পশ্চিমা মিত্রতার অংশ হিসেবে চলতি বছর তারিখ বদলে ২৫ ডিসেম্বরই উৎসব উদযাপন করল দেশটি।

ডিসেম্বরের একেবারে শেষ দিকে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া শেষবারের মতো ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তায় অনুমোদন দেয় হোয়াইট হাউস। ২৫০ মিলিয়ন ডলারের এ প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে বিমান প্রতিরক্ষা, আর্টিলারি ও ছোট অস্ত্রের গোলাবারুদ ও ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ 

বছরের শেষভাগে এসে বিশ্বের নজর কেড়ে নেয় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। হামাস শাসিত গাজা ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা বর্ষণে এক ধ্বংস উপত্যকায় রূপ নিয়েছে। প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দার গাজা উপত্যকায় বহু মানুষের প্রাণ গেছে। বাসিন্দারা। বাসিন্দারা ঘরছাড়া হয়ে বোমাবৃষ্টির মধ্যেই আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন। কিন্তু নিরাপদ আশ্রয় মিলছে কই? প্রতিদিনই শতশত ফিলিস্তিনির প্রাণ যাওয়ার খবর শোনা যাচ্ছে।  

চলতি বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। সংগঠনটির কিছু অস্ত্রধারী দক্ষিণ ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে। দেশটি থেকে দুই শতাধিক লোককে হামাস জিম্মি করে। হামাসের হামলার জবাবে গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।   

এরপর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, গাজায় হামাসের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে। বাহিনীটি বলে, ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় আমরা কাজ করে যাব।  

ইসরায়েলে হামাসের হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়ে প্রতিরক্ষা সমর্থনের প্রতিশ্রুতি জানায় যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি নিন্দা জানায় ন্যাটো। জোটটি বলে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। নিন্দা জানায় ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ।

ইসরায়েলের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র বিমান বহনকারী একটি জাহাজ ইসরায়েলের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা জানায়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন তখন জানান, রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড, একটি মিসাইল ক্রুজার ও চারটি মিসাইল বিধ্বংসী যান ওই অঞ্চলের দিকে যাচ্ছে। হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে আরও অস্ত্র সহায়তার  আশ্বাস দেয়।  

এক পর্যায়ে গাজায় বিদ্যুৎসহ খাদ্য, পানি ও জ্বালানি সরবরাহও বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন, যার মধ্যে খাদ্য, পানি ও জ্বালানি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  

গাজায় হামলার পাশাপাশি অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সব ধরনের চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। লোহার গেট, সিমেন্ট ব্লক ও মাটির ঢিবি দিয়ে শহরের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নতুন সামরিক চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়।  

হামাসের হামলার পরপরই যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এতে তিনি সাবেক সেনা কর্মকর্তা, এমনকি বিরোধী দল থেকেও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন।  

ওই সময় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, তারা গাজায় অভিযান চালাতে প্রস্তুত। এর অংশ হিসেবে গাজা সীমান্তে লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।  

ইসরায়েলে হামাসের হামলা চালানোর তিন দিন আগেই মিশর সতর্ক করেছিল বলে জানা যায়। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ তথ্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে আখ্যা দেন।  

১২ অক্টোবর ইসরায়েল বলে, তাদের বাহিনী গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এর মধ্যেই নেতানিয়াহুর সঙ্গে কয়েক দফা ফোনালাপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

১৩ অক্টোবর জানা যায়, গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১১ লাখ ফিলিস্তিনিকে সরতে বলে ইসরায়েল। জাতিসংঘের এক মুখপাত্র এ তথ্য জানান।

১৪ অক্টোবর জানা যায়, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে রাশিয়া। পাশাপাশি সংঘর্ষ চলতে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে মস্কো। ইসরায়েলে হামাসের হামলার পরপরই ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ব্যর্থ মার্কিন নীতির জ্বলন্ত উদাহরণ এ ঘটনা।

১৭ অক্টোবর রাতে গাজায় হাসপাতালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ৫০০ জন নিহত হন বলে জানান গাজার স্বাস্থ্য দপ্তরের মুখপাত্র। তবে ইসরায়েলি সেনা মুখপাত্র, বলেন এ নিয়ে তাদের জানা নেই, খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা চলছে।  

হাসপাতালে হামলায় বহু ফিলিস্তিনির নিহত হওয়ার ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠক বাতিল করেন আরব নেতারা। তবে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইসরায়েল সফরে পরিবর্তন আসেনি।  

ইসরায়েলে গিয়ে জো বাইডেনের সমর্থনের পর সার্বিক সহায়তার বার্তা নিয়ে দেশটিতে যান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তিনি ইসরায়েলে গিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের পাশে আছে। এরপর সমর্থনের বার্তা নিয়ে তেল আবিব যান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো।

নভেম্বরের একেবারে শুরুতেই রাফাহ ক্রসিং দিয়ে বিদেশি নাগরিক এবং গুরুতর অসুস্থ ফিলিস্তিনিদের মিশরে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর আগে এ ক্রসিং দিয়ে খাবার ও সাহায্য বহনকারী ট্রাক ঢুকতে দেওয়া হলেও বিদেশি নাগরিকদের সেবারই প্রথম গাজা ত্যাগের সুযোগ দেওয়া হয়।

একই সময়ে লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ গাজা ইস্যুতে প্রথমবার মুখ খোলেন। তখন তিনি এ সংঘাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। হামলা চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কার কথা জানান।  

যুদ্ধ শুরুর এক মাস পর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী দাবি করে, তারা গাজাকে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। ইসরায়েল এখনো গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে বাসিন্দাদের জন্য একটি করিডর খোলা রেখেছে। তখন ইসরায়েল স্থল অভিযান আরও জোরদারের ঘোষণা দেয়।  

১০ নভেম্বর জানা যায়, ফক্স নিউজকে নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েল গাজা জয় করতে চায় না, দেশটি গাজা দখলও করতে চায় না, শাসন করতে চায় না।  

নভেম্বরের মাঝামাঝি আল শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলি সেনারা ঢুকে অভিযান চালানো শুরু করে। অবশ্য অভিযানের আগে থেকেই সেনারা হাসপাতাল এলাকা ঘিরে রাখে। তাদের দাবি ছিল, হামাসের বিরুদ্ধেই এ অভিযান।

উত্তর গাজা ছাড়তে বলায় লাখ লাখ বাসিন্দা পালিয়ে খান ইউনিসে আশ্রয় নেন। পরে খান ইউনিসও ছাড়তে বলে ইসরায়েলি বাহিনী। শহরটিতে লিফলেট বিতরণ করে ইসরায়েল বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলে।

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সাত দিনের যুদ্ধবিরতি ছিল। যুদ্ধবিরতি শেষে ডিসেম্বরের শুরুতে ফের হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এসময় হামাসের হাতে বন্দি শতাধিক জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ইসরায়েলে বন্দি ২৪০ ফিলিস্তিনি মুক্ত হন।  

পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে এ ভিসানীতি। সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনি কেউ অভিযুক্ত হলে তার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হয়। ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৫৩টি রাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ১০টি দেশ ভোট দেয়। আর ২৩টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।

একই সময়ে সুর বদলে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের সমালোচনা করতে দেখা যায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে। তিনি বলেন, গাজায় ‘নির্বিচারে বোমা হামলা’ চালানোয় ইসরায়েল বিশ্বজুড়ে সমর্থন হারাচ্ছে।

এরপর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী দাবি করে, তারা গাজায় হামাসের একটি সুড়ঙ্গের সন্ধান পেয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী হামাসের প্রশাসনিক ও সামরিক নেতারা এটি ব্যবহার করতেন।

যুদ্ধ শুরুর পর অবরুদ্ধ গাজায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা চরমভাবে ব্যাহত হয়। বিশুদ্ধ পানির অভাব, খাবারের অভাব, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গাদাগাদি বসবাসের কারণে এবং সুয়ারেজ লাইন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় নানা রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।  

গাজা যুদ্ধের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আল-জাজিরা সবশেষ তথ্যে জানায়, ৭ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি আবাসিক ইউনিট ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০৩টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩৬টি হাসপাতালের ২৩টিতে কার্যক্রম বন্ধ। ১০৪টি অ্যাম্বুলেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০৪টি বেকারি ধ্বংস হয়ে গেছে।

২৩ লাখ মানুষের বসবাস গাজায়। এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ শিশু। ১৭ লাখ বাসিন্দা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায়  ২১ হাজার ৮২২ ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন ৫৬ হাজার ৪৫১ জন। অন্যদিকে হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত প্রথমে বেশি শোনা গেলেও পরে জানা যায় ১ হাজার ১৩৯ জনের প্রাণ গেছে।

গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল ও লেবানন সীমান্তে সংঘাত বেড়েছে। অক্টোবর থেকে লেবাননে শতাধিক লোকের প্রাণ গেছে। এদের বেশিরভাগই হিজবুল্লাহ যোদ্ধা, বেসামরিকও আছেন। তিন সাংবাদিক এ নিহতদের মধ্যে রয়েছেন। আর একই সময়ে লেবানন সীমান্তে ইসরায়েলে চার বেসামরিক ও নয় সেনার প্রাণ গেছে। এ অঞ্চল থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়েছে। ইসরায়েল পার্শ্ববর্তী সিরিয়াতেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩
আরএইচ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।