ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অপার মহিমার রমজান

তোপধ্বনি দিয়ে রমজান মাসকে স্বাগত জানায় ইরাকিরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৭ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৬
তোপধ্বনি দিয়ে রমজান মাসকে স্বাগত জানায় ইরাকিরা

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে রমজানে আর আগের জৌলুস নেই। তারপরও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ইরাকিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।

এখনও তারা তাদের আপন ঐতিহ্যে রমজান মাসকে স্বাগত জানায়। উসমানীয় শাসনামল থেকে চলে আসা সংস্কৃতি মতে তোপধ্বনির মাধ্যমে রমজানের চাঁদকে অভিনন্দন জানানোর মাধ্যমে ইরাকে রোজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এমনকি তোপধ্বনি শুনে ইরাকিরা সেহরি ও ইফতার করেন।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসলামের শুরুলগ্নে কুফা নগরীতে বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হজরত আলী ইবনে আবী তালিব (রা.) এবং অন্যান্য ফকিহ সাহাবিদের মাধ্যমে ফিকহে ইসলামির যে বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছিল তা ইরাকের সীমানা অতিক্রম করে গোটা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে। ফিকহে হানাফির মাতৃভূমিও তাই এই ইরাক।

ছয়শ’ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে খলিফা হজরত উমরের (রা.) নির্দেশে সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীর তীরে কুফা এবং উতবা ইবন গাজওয়ান (রা.) শাতিল আরবের তীরে বসরা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে সেনানিবাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ধীরে ধীরে আরবের ধর্মতাত্ত্বিক এবং চিন্তাবিদেরা এই দুই নগরীতে জড়ো হতে থাকেন। টাইগ্রিস তীরে ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আল মনসুর বাগদাদ নগরীর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে এ নগরী আরব তথা মুসলিম বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। নিকট অতীতে তথা বিশ শতকের শুরুতেও বাগদাদ আধুনিক আরব বিশ্বের অনন্য উদাহরণ ছিল। এখানে ছিল সর্বোৎকৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর, শিক্ষার উচ্চমান, বেগবান সংস্কৃতি ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা। অথচ এ শহর এখন নিত্যদিনই রক্তের স্রোতে ভাসছে।
 
এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, আজকের ইরাক এককালে মানবসভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া থেকে ইরাকের উদ্ভব। সে সঙ্গে মানব সভ্যতার বিকাশ। আজ ইরাকজুড়ে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা ও আইসিস বা আইএস সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ালেও রমজানের পূর্ব থেকেই ফোরাত নদীর তীরের বাসিন্দারা প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং রমজান মাসকে স্বাগত জানায় আপন ঐতিহ্যে।

ইরাক হলো সেই পবিত্র ভূমি, যেখানে মানব সভ্যতা সর্বপ্রথম রূপলাভ করেছে। ইরাকি প্রাচীন খাদ্য রসনাকে তাই ইতিহাসবিদগণ বলে থাকেন আধুনিক রান্নার ভিত্তি। রমজানব্যাপী বাগদাদের বিখ্যাত ‘শোরজাহ’ বাজারে চলে মজাদার খাবারের বেচাকেনা। পুরো ইরাকবাসীর কাছেই এই শোরজাহ বাজারটা বেহেশতের মতো, বিশেষ করে রমজানে। সহিসংতা, আতঙ্ক কাটিয়ে মানুষের ভিড় জমে ৭০০ বছরের রমজানের ঐতিহ্য ঐতিহাসিক এই মার্কেটে। যদিও আগের আমেজে ভাটা পড়েছে খানিকটা। চড়া মূল্য, তীব্র গরম আর সেই সঙ্গে রক্তপাতের আশঙ্কা যে কোনো মুহূর্তে- এ সবই ছায়া ফেলেছে বহু বছরের ঐতিহ্যবাহী এই বাজারে।
 
তাদের জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে কুব্বা, বৌরেগ, কুব্বাত বুরঘুল, কুব্বাত হালাব, পটেটা চাপ ইত্যাদি যা আসলে বিভিন্ন স্বাদ ও নকশার লুচি। রমজানের সমাপ্তি উদযাপনের জন্য তারা ক্লেইচা নামের খাবার খেয়ে থাকে। এছাড়া কাবাব, দোলমা, শেখ মাহশি নামের পাকোড়া ছাড়াও বাকলাওয়া জিলাবিয়া নামের মিষ্টিও পরিবেশিত হয়ে থাকে। খাবার-দাবারের জন্য দুনিয়াজুড়ে সুনামের অধিকারী এই দেশটিতে রমজানের খাবারে থাকে বৈচিত্র। সেহরির সময় অল্প আহার করলেও ইফতারে থাকে নানা আয়োজন।

ঐতিহ্যগতভাবেই ইরাকিরা সামাজিক। রমজানে তাদের সামাজিকতা চোখে পড়ার মতো। পুরো রোজার মাস প্রতিবেশিদের মধ্যে ইফতার আদান-প্রদান হয়। অনেক সময় নিজেদের ঘরে তৈরি খাবারও নিজেরা খাওয়ার সুযোগ পান না তারা। ইরাকিদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সাধারণত খোলা ছাদে বা বাড়ির সামনে খোলা প্রাঙ্গণে বসে সবাই মিলে ইফতার করতে পছন্দ করেন। মসজিদগুলোতে থাকে উন্মুক্ত ইফতারের আয়োজন।

ইরাকে রোজার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় মাসখানেক আগে থেকেই। নানা রকম রান্নার জোগাড়যন্ত্রে ভরতে থাকে ইরাকিদের ভাঁড়ার। এই ভাঁড়ারকে স্থানীয় ভাষায় ‘মুনেহ’ বলা হয়। মুনেহতে সাধারণত অপচনশীল শুকনো খাবার-দাবার সংরক্ষণ করা হয়।

বেশিরভাগ ইরাকি গরু, মহিষ কিংবা ছাগলের দুধ পান করে রোজা ভাঙে। এরপর তারা বসরার খেজুর খায়। সঙ্গে থাকে বিশেষ ধরনের শরবত। যা তারা ইফতার-সাহরি উভয় সময়ই পান করেন। ইফতারে বাড়ি বাড়ি তৈরি হয় মিষ্টি, বিরিয়ানি ও কাবাব। ময়দা, চাল এবং আলু দিয়ে তৈরি কুব্বা বুরগাল, কুব্বা হালেব ও পটেটো চপের পাশাপাশি মিষ্টি ও নুডলস দিয়ে বানানো সুস্বাদু খাবার ‘হালাওয়াত শারিয়া’ ইফতারের টেবিলে খুবই জনপ্রিয়। ইরাকের বাইরে এ খাবার ‘সুইট অ্যান্ড গোল্ডেন ভার্মিসেলি নুডলস’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া দৈনন্দিন খাবার ‘শেখ মাহসি’ এবং ‘দোলমা’ও থাকে ইফতারে। সবজি দিয়ে কয়েক পদের দোলমা বানানো হয়। আর শেখ মাহসি তৈরি হয় মাংস ও বেগুন দিয়ে। এ ছাড়া ইফতারে থাকে গরু, মহিষ কিংবা ভেড়ার কাবাব, বিরিয়ানি, নাওয়াশিফ এবং থারিড। শেষের দুই পদ মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়।

রমজানের শেষ ১০ দিন অবশ্য ইরাকিদের ঘর থাকবে তাদের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ‘ক্লেইচা’ দিয়ে। কেবল রমজানের সময় নয়, যেকোনো উৎসবে বিস্কুট জাতীয় এ খাবারের কদর অনেক। খেজুর, বাদাম, চিনি ও শুকনো নারকেলে ভরা ইরাকের জাতীয় বিস্কুট হিসেবে পরিচিত এই ক্লেইচা খুবই সুস্বাদু। তাই ইরাকিদের সব উৎসবে আপ্যায়নের টেবিলে নানা আকৃতির ক্লেইচা দেখা যায়। স্বাদের পাশাপাশি এর গন্ধও মনমাতানো। ক্লেইচা সাধারণত এলাচের ফ্লেভারের হয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে গোলাপের ফ্লেভার দিয়েও তৈরি হয়। স্যাফ্রন রং দেওয়া এই বিস্কুট সাধারণত চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। সব মিলিয়ে খাদ্যরসনায় ঐতিহ্যের ছাপ পরিলক্ষিত হয় ফিকহে হানাফির মাতৃভূমিতে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৬
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।