ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

জার্মানির আল্পস পর্বতমালা জয়ের গল্প (পর্ব-২)

আবুল হাসান, অতিথি লেখক, হেইডেলবার্গ, জার্মানি থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২০
জার্মানির আল্পস পর্বতমালা জয়ের গল্প (পর্ব-২) মাটি ও ঘাসের পথ এখানেই শেষ, এর পর শুরু পাথুরে পথ

মানবদেহের ইঞ্জিনিয়ারিং এমনভাবে করা হয়েছে যে, প্রতিটি কোষ শিরা-উপশিরা প্রাকৃতিকভাবেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বাঁচার, যেখানে সে দেখে তার জীবন বিপন্ন সেখানে সে তার সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দেয়। এই ইনবিল্ট প্রোগ্রামিংয়ের সাথে আছে আপন মানুষের ভালোবাসা, তাদের কাছে ফেরার তীব্র আকুতি।

খাড়া পাহাড়ের কার্নিশে দাঁড়িয়ে চোখে ভাসছিলো প্রিয়তমা বউয়ের মুখ, উদ্বিগ্ন বোন বা ভাইয়ের চেহারা। আমার বেঁচেবর্তে থাকা তাদের জন্য ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা নিজের জন্য। সবকিছু মিলে এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দেয়ার সময় এখনো হয়নি।

হিম্মতে বান্দা, মদদে খোদা
আমি এমন জায়গায় এসে আটকে আছি যেখান থেকে উপরে যাওয়া ভয়ঙ্কর কঠিন, পিছনে যাওয়া অসম্ভব! সুতরাং উপরেই যেতে হবে। প্রায় ২০ মিনিট এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে শক্তি-সাহস সঞ্চয় করে শুরু করলাম হাঁটা। উপরেও তাকাই না, কারণ দূরত্ব দেখলে হতাশা চলে আসবে। নিচে তাকাই না, কারণ উচ্চতাভীতির জন্য মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কঠিনভাবে নিজের দৃষ্টি প্রতিটা পদক্ষেপের দিকে নিবিষ্ট। মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল আমি হাঁটছি, আর এভাবে একেবারে শেষ বিকেলে পৌঁছে যাই knorrhutte-এ। পৌঁছে সেখানকার বারান্দায় বসে প্রথমে একটু চকলেট আর পানি খেয়ে নেই, শরীর অনবরত কাঁপছিল তাই নিজেকে একটু সময় দেই স্থির হবার জন্য। খুদেবার্তায় চিন্তিত বউকে জানিয়ে দেই যে, আমরা আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি।

পর্বতারোহণের পথে নয় হাজার ফুট উঁচুতে কোথাও কোথাও বরফে ঢাকা পথ মাড়িয়ে যেতে হয়েছে 

অত্যন্ত দুর্গম জায়গায় তৈরি এই কুঁড়েঘরে একসাথে ৪৫ জন মানুষ থাকতে পারে। আমাদের যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছিল সেই রুমে ১৬ জন মানুষের থাকার বন্দোবস্ত! আক্ষরিক অর্থেই আমাদের দেশের চিৎ-কাইত হোটেলের মতো। প্রতিজনের জন্য একটা সিঙ্গেল মেট্রেস আর একটা বালিশ বরাদ্দ। এর উপর নিজের স্লিপিংব্যাগ বিছিয়ে ঘুমাতে হবে। ১৬ জন মানুষ ছোট্ট এক রুমে থাকার কারণে রুমের বাতাসও ভারী। তবে অভিযোগ করার কোনো উপায় নেই, কারণ এমন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা আছে সেজন্যই শুকরিয়া! Knorhutte জার্মানির পর্বতারোহন সংস্থা ডয়েচে আল্পাইন ভেরেইনের সম্পত্তি। সুতরাং যারা এই সংস্থার সদস্য তাদের থাকার জন্য এখানে ডিসকাউন্টেড প্রাইস ও অগ্রাধিকার। সেখানে থাকা অন্যান্য লোকজনদের দেখে মনে হয়েছে আমরা ছাড়া বাকি প্রায় সবাই ওই সংস্থার সদস্য ও সিরিয়াস পর্বতারোহী।

রুমে ব্যাগ রেখে প্রথমেই চলে যাই গোসলখানার দিকে। সেখানে সিরিয়াল দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। ভিতরে ঢোকার পর দেখি পানি ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা, একেবারে বরফগলা! এই পানি দিয়ে গোসল করা অসম্ভব, হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাবে, গরম পানির ব্যবস্থা আছে, ৩ ইউরো দিয়ে ৩ মিনিট গরম পানি। মনের দুঃখে বন্ধু আনোয়ারকে দরজায় পাহারায় রেখে গামছা ভিজিয়ে গা মুছে ফেলি। এমন ভয়ঙ্কর দিনব্যাপী হাঁটার পর সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছিল, সেই সময় গরম পানির গোসলটা টনিক হিসেবে কাজ করতো। আমার কাছে ৩ ইউরো ছিল না তা নয়, তার উপর আরিফ ভাই বলেছিলেন তুমি গোসলটা করো আমি ৩ ইউরো দেব, আমি করিনি। অতিরিক্ত বা বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। আমার গত ২০ বছরের ভ্রমণজীবন—৪২ দেশ, ৩১৯ শহর; এমন অসংখ্য ৩ ইউরো বাঁচিয়ে ফেলার যোগফল! কেউ না জানুক আমি জানি কত স্যাক্রিফাইসের বিনিময়ে আমি ছোটোখাটো একজন ট্রাভেলার হতে পেরেছি।

চূড়া থেকে আইবসি লেক

ফ্রেশ হয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে এখন খাবারের আয়োজন। সেখানে খাবারের ব্যবস্থা আছে কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল। রাতের খাবার একজনের ৩৪ ইউরো, অকল্পনীয়! যদিও পরিস্থিতি ও স্থান বিবেচনায় সেটা ঠিক আছে কিন্তু আমাদের মতো বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য সেটা সামর্থ্যের বাইরে। আগে থেকে জানতাম তাই আমরা সাথে করে ছোট্ট পোর্টেবল চুলা ও পাতিল নিয়ে যাই। খাবার জন্য ইনস্ট্যান্ট কাপ নুডলস, যেটাতে গরম পানি ঢাললেই ৩ মিনিটে খাবার উপযোগী। অন্ধকারে কুঁড়েঘরের বাইরে বসে গরম পানি করার সময় প্রচণ্ড মেঘের গর্জন ও বিজলির চমক, সাথে হালকা বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া। এমন বৈরী আবহাওয়ায় কোনোরকমে পানি গরম করে খেতে খেতে আকাশ পরিষ্কার। আকাশে তারাও দেখা যাচ্ছিল। পরিবেশ অনেক রোমান্টিক যদিও কনকনে ঠাণ্ডা। এত উঁচু পাহাড়ে রাত্রিযাপন করার অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি, এই প্রথম। গা ছমছম করছিল আবার ভালোও লাগছিল। রাতের অন্ধকারে চারপাশের কালো পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছিলো রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা দৈত্যের মতো! ভয় লাগে আবার এক অদ্ভুত অমোঘ আকর্ষণ অনুভূত হয়। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়— অন্তর্গত অস্তিত্বে বিপন্ন বিস্ময়।

সেখানে বসে এক অদ্ভুত হাহাকার অনুভূত হচ্ছিল, আমরা কত তুচ্ছ, কত ক্ষুদ্র, তারপরও আমাদের কতো বড়াই, অহংকার! তীব্রভাবে কারো অভাব অনুভূত হচ্ছিল! কী এমন ক্ষতি হতো এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যদি এখন তুমি আমার পাশে আমার হাত ধরে বসে থাকতে! আহারে! আহারে!!

পর্বতের চূড়ায় অবজারভেশন ডেক

ঘুমিয়ে শরীরটাকে রিচার্জ করে কাল সকালে আবার শুরু করতে হবে দুর্গমগিরি অভিযান। পাওয়ারফুল পেইনকিলার খেয়ে শোয়ার পর দেখি চোখে ঘুম নেই! মাথায় আসছিল নিজের সারাজীবনের ফ্ল্যাশব্যাক! কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি, কোথায় যাব— এমন দার্শনিক টাইপ চিন্তাভাবনা। বিভিন্ন খাপছাড়া ভাবনার পর একসময় ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ!

অনেক ভোরে আরিফ ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। ফজর পড়ে, নাস্তা করে সকাল সকাল হাঁটা শুরু করতে হবে। রোদ উঠে গেলে হাঁটা কঠিন হয়ে যাবে। বাথরুম, টয়লেট সেখানে একটা যুদ্ধের মতো! বরফঠাণ্ডা পানির জন্য মনে হয় যন্ত্রপাতি সব খসে পড়ে যাবে! ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে বাইরে এসে এমন অসাধারণ সকাল দেখে আমি হতভম্ব! এই সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়ার পর্যাপ্ত প্রতিভা ও ভাষাজ্ঞান আমার নেই। পাহাড়ের পেছন থেকে আস্তে আস্তে সূর্যের উঁকি দেয়া, বিপরীত দিকের পাহাড়গুলোতে সে আলো প্রতিফলিত হয়ে এমন অদ্ভুত অপার্থিব সৌন্দর্যের অবলোকন করতে পারা সত্যি সৌভাগ্যের! এমন অদ্ভুত, বৈচিত্র্যময়, বিশাল, অপূর্ব সৃষ্টির কারিগর কতো মহান!

জার্মানির আল্পস পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়া

রুটিনমাফিক নুডলস আর কফি খেয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে শুরু হাঁটা। আজকে কোনো সমতল রাস্তা নেই, শুধুই আরোহণ। বাকি সময়টা শুধু পাথুরে, রুক্ষ প্রাণহীন খাড়া পাহাড়! প্রায় ৬ ঘণ্টা হেঁটে, নিজের সামর্থ্য ও শক্তির শেষবিন্দু অতিক্রম করে আমরা পৌঁছাই জার্মানি ও অস্ট্রিয়া সীমান্তে অবস্থিত জার্মানির সর্বোচ্চ চূড়া সুগস্পিৎসে-তে! চূড়াতে আমরা প্রায় ১ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করি। সেখানে গবেষণা ও পর্যটনের জন্য হুলুস্থূল আয়োজন, হাজার হাজার টুরিস্ট। ৯৯ শতাংশ ক্যাবল কারে করে আসা। উপরে পৌঁছে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি! কোনোকিছু ঠিকমতো উপভোগ করতে যে শারীরিক ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন তা আমার অনেক আগেই শেষ! ঠাণ্ডায়ও কাঁপছিলাম। আল্লাহকে ধন্যবাদ শক্তি সামর্থ্য দেয়ার জন্য আর আমার সফরসঙ্গীদের ধন্যবাদ এমন পাগলামি মিশনে আসার জন্য। পরিকল্পনামাফিক বিকেল নাগাদ আমরা টানেল ট্রেনে করে গার্মিস ফিরে আসি ও সন্ধ্যায় যার যার শহরের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যাই।

এই হাইকিং বা পাগলামি আমাকে সুযোগ দিয়েছে নিজের শক্তি সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দেখার, বোঝার। দিয়েছে কিছু আত্মবিশ্বাস প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করার। একটু গরম খাবার বা গরম পানি, আরামদায়ক বিছানার ভ্যালু আমরা জেনেছি, যা হয়তো নিজের ঘরে কখনোই উপলব্ধি করা সম্ভব হতো না। নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হলেই বোঝা সম্ভব আমরা কতো নেয়ামতের মধ্যে ডুবে আছি, আমাদের অন্ধ চোখ যা কখনোই দেখে না। (শেষ)

প্রথম পর্ব: জার্মানির আল্পস পর্বতমালা জয়ের গল্প

মো. আবুল হাসান
হেইডেলবার্গ, জার্মানি
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২০
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।