ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫) পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা।

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৫
রংপুর-লালমনিরহাট-ইন্দ্রাপাড় (৩৪.০২ কিমি)
টিনের চালে কুয়াশার মৃদু টুপটাপ শব্দে ঘুম যখন ভাঙলো তখন সবে ভোর পাঁচটা। ছয়টায় কর্কশ অ্যালার্মটা বাজার আগেই ঘুম ভাঙছে রোজ।

সাড়ে ছয়টা নাগাদ মণির মামির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতেই মণ্ডল ভাইয়ের ফোন। উনি এই ভোরেই লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ থেকে রওয়ানা দিয়ে রংপুর পৌঁছে গেছেন। সাতমাথা মোড়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগলো না। পথে হঠাৎ শিউলি ফুলের সুবাস পেয়ে মনটা চনমন করে উঠলো। রাস্তার ধারের শিউলি গাছ থেকে ফুল পড়ে বিছিয়ে আছে রাস্তায়। ছোটবেলায় নানাবাড়ির সামনে এই দৃশ্য দেখতে পেতাম নিয়মিত।

আরও পড়ুন>>পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)​

সাতমাথা নামক জায়গাটাতে আছে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের ম্যুরাল। তার ওপাশেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন মণ্ডল ভাই। কুশল বিনিময় করে হাঁটা দিলাম তৎক্ষণাৎ। নব্দীগঞ্জ থেকে শুরু হলো পীরগাছা উপজেলার সীমানা। খানিক বাদেই একটা সরু সেতু পেরোতেই প্রবেশ করলাম কাউনিয়া উপজেলায়। বিশাল সব পাটখড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন বেশ ক'জন সাইকেল আরোহী। দেখতে খুবই কিম্ভূত লাগছিল। ধানক্ষেতের বুক চিরে ট্রেনের ছুটে যাওয়া দেখতে দেখতেই প্রথম চা বিরতি। বিজলের ঘুন্টি, মীরবাগ পেরিয়ে যেতেই এক কিশোর জিজ্ঞেস করলো হাঁটাটা আমাদের শাস্তি কিনা। মণ্ডল ভাইয়ের আর্মি ছাঁটের চুল আর ক্যামোফ্লেজ টিশার্ট দেখে কিশোরের এই ভ্রান্তি। তার ভুল ভাঙিয়ে কাগজির ঘাট, বেইলি ব্রিজ বাজার পেরিয়ে চলে এলাম ভূতছাড়ায়।

আরও পড়ুন>>পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা
সমতলে হাঁটলেও মণ্ডল ভাইয়ের সঙ্গে পাহাড়ের গল্পই করেছি বেশি। আর আমরা দুজনেই অল্প-বিস্তর সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলে সে নিয়েও গল্প হচ্ছে। হলদিবাড়ী পেরিয়ে রাস্তার দু'পাশে পড়লো প্রচুর ইপিল ইপিল গাছ। এদিকের আরেকটা জিনিস বেশ নজর কাড়লো। বড় বড় টিনের পাত্রে দুধ নিয়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারের দুপাশে বেঁধে নিকটস্থ বাজারগামী হতে দেখলাম অনেককেই। পরিত্যক্ত একটা ফিলিং স্টেশনের সামনে আরেকটা চা বিরতি নিয়ে বিল দিতে পকেটে হাত দিতেই মণ্ডল ভাই আজকের জন্য পকেটে হাত দেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন।

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা।
আবার হাঁটা শুরু করতেই কাউনিয়া বাজার। উপজেলা সদর হিসেবে একদম ছোট্ট বাজার। আরো খানিকটা এগিয়ে মূল হাইওয়ে ছেড়ে তিস্তা রেল সেতুর পথ ধরলাম। এদিকে যান চলাচল নেই বলেই দু’পাশের রাস্তায় চলছে ধান শুকানোর মহোৎসব। রেল সেতুতে ওঠার মুখেই মণ্ডল ভাই বেশকিছু ছবি তুলে দিলেন আমার। দার্জিলিংয়ে তিস্তা দেখার সৌভাগ্য আগেই হয়েছিল। এবার দেখা হলো দেশের ভূখণ্ডের দুকূল ছাপিয়ে বয়ে চলা তিস্তাকে। সেতুর নিচে তিস্তার বিশাল সব চর চোখে পড়ছে৷ রেল সেতুর ডান পাশেই তিস্তা সেতু যেখান দিয়ে রেল বাদে অন্য বাহন চলাচল করে।

আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)

মাঝ সেতুতে চোখে পড়লো বেশ কিছু যুগল। কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন আর পায়ে হাঁটার জায়গাটা তৈরি ধাতব পাতে। পাশের সেতুটা তৈরির আগে অন্য যানবাহনও এই রেলসেতু দিয়েই চলাচল করতো। সেতু পার হতেই শুরু লালমনিরহাট জেলা। দু'পাশে বিশাল সব বাঁশঝাড় সঙ্গ দিচ্ছে আজ। এক মোড়ে পড়লো রাজারহাট হয়ে কুড়িগ্রাম যাওয়ার রাস্তা। একটু সামনেই গোকুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের ভবনে থামলাম। এখানে কর্মরত মণ্ডল ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ফের পথে। মোস্তফি নামক একটা জায়গা থেকে সোজা রাস্তা গিয়েছে কুড়িগ্রামের দিকে। আমাদের গন্তব্য লালমনিরহাট বলে আমরা ধরলাম বামের রাস্তা।
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা
পিচের রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে এবার কিছু অংশে পড়ছিল ইটের রাস্তাও। তালুক মৃত্তিঙ্গা ছাড়িয়ে এগোতেই দৃষ্টিসীমায় বিশাল হিমাগার। এদিকে প্রচুর আলুর ফলন বলে হিমাগারগুলো প্রচণ্ড ব্যস্ত। পদ্ম আর কচুরিপানাতে ভরপুর বিল পেরিয়ে মণ্ডল হাট। মণ্ডল হাটের সামনে মণ্ডল ভাইকে দাঁড় করিয়ে একটা ছবি না তুললে বড্ড অবিচার হবে!

ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে, এই দৃশ্য আজ চোখে বারবার চোখে পড়ছে। পাটবোঝাই ট্রাক দেখতে দেখতেই গুড়িয়াদহ চলে এলো। খানিক পরেই একটা ছাউনির মতো জায়গা ঘিরে প্রচুর লোকের ভিড়। উঁকি দিতেই বুঝলাম এটা পাইকারি মাছের বাজার। আজ হাঁটতে তেমন ক্লান্তিই বোধ হচ্ছে না। গল্প করতে করতে দারুণ মশগুল আমি এন্ডোমন্ডো অ্যাপে আমাদের অ্যাভারেজ পেস দেখে খুশিই হলাম। আজ হাঁটার স্পিড যথেষ্ট ভালো।
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা
আজ পুরো দিনে পাটগ্রামগামী প্রচুর বাসের দেখা পাচ্ছিলাম খানিক বাদে বাদেই। এই নাম দেখলেই পাটগ্রামে কর্মরত প্রিয় অগ্রজ ডা. ইমরুল কায়েসের কথা মনে পড়ে। সোয়া দুইটা নাগাদ চলে এলাম মহেন্দ্রনগর। এখান থেকেই একটা রাস্তা এগিয়েছে কুড়িগ্রামের দিকে। কাল এ রাস্তা ধরেই যাবো কুড়িগ্রাম। হাতে এখনো অনেক সময় দেখে ভাবলাম আগামীকালের কিছুটা রাস্তা এগিয়ে রাখি। ডানে মোড় ঘুরে ফের হাঁটতেই বুড়ির বাজার, সিংগাদার বাজার পড়লো। এদিকের বাড়ির সামনে প্রচুর ফুলগাছ। তাতে টগরের আধিপত্য স্পষ্ট। গবাই হয়ে ইন্দ্রার পাড়ে যখন আজকের দিনের মতো হাঁটার ইতি টানলাম, তখন সবে ঘড়ির কাঁটায় ৩টা ৫।

অটোতে মহেন্দ্রনগর ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়া হলো। আজই প্রথমবারের মত দুপুরের খাবার খেলাম পুরোদিনের হাঁটা শেষ হওয়ার পর। ক্যান্টনমেন্ট মোড়ে অপেক্ষা করছিলেন মণ্ডল ভাইয়ের বন্ধু ওয়াজেদ ভাই। আমরা পৌঁছাতেই বরণ করে নিলেন ফুল দিয়ে। আজ থাকার ব্যবস্থা ছিল আদিতমারীতে। মণ্ডল ভাই জানতেন, আমি লালমনিরহাট সদরেই থাকবো। আদিতমারীর কথা শুনেই উনি বললেন, আদিতমারী যে কথা, কালীগঞ্জও সেই কথা! 'রাস্তায় পেতেছি শয্যা, ফুটপাথে কি ভয়'- আওড়াতে আওড়াতে কালীগঞ্জে মণ্ডল ভাইয়ের নতুন নির্মিত বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঠিক সন্ধ্যা। খানিক বিশ্রাম নিয়ে স্কুল শিক্ষক মণ্ডল ভাইয়ের গাছে ঘেরা স্কুল দিনের শেষটা রাঙিয়ে দিল।

চলবে...

আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।