ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

তারার ফুল

ফিরোজা বেগম সম্পর্কে কতোটা জানেন?

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩:৫২, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৫
ফিরোজা বেগম সম্পর্কে কতোটা জানেন?

স্বর্ণকণ্ঠী। নজরুলসংগীতের রাজেশ্বরী, সুর-তাপসী।

ফিরোজা বেগমের সঙ্গেই এমন বিশেষণগুলো ছিলো মানানসই। তার কণ্ঠে নজরুলের গান শোনার মাধুরীময় স্মৃতিরাজি এখন শ্রোতাদের প্রিয় নস্টালজিয়া! কানে বাজে জোছনার মতো গুণী এই শিল্পীর নরম হৃদয়ছোঁয়া কণ্ঠমাধুর্য।

ফিরোজা বেগম একনাগাড়ে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগীত সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। এমন নজির পৃথিবীতে আর নেই। নজরুলের গান নিয়ে সারাবিশ্ব ঘুরেছেন তিনি। যেমন গলা ছিলো, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বময়। তার ব্যক্তিত্বের বিভা মুগ্ধ করেনি কাকে!

মেঘছোঁয়া খ্যাতি ফিরোজা বেগমকে কখনও বিচলিত করতে পারেনি। তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী। প্রচারের আলো তাকে মোহিত করতে পারেনি কখনও। দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন খ্যাতিকেও। কখনও বিত্তের পেছনে ছোটেননি। তাই সারাজীবন মোহ থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন নিজেকে।

২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় চিরবিদায় নেন ফিরোজা বেগম। তার জীবনখাতার প্রতিটি পাতাই যেন একেকটি ক্যানভাস। সেখানে রঙের বৈচিত্র আর এতোই ঔজ্জ্বল্য যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়! তার জীবন যেন ছিলো সত্যিকার অর্থেই গানের আসরে মধুর কোনো রাগ।

ফিরোজা বেগমের বর্ণাঢ্য জীবন

* ফিরোজা বেগম জন্মেছিলেন ২৮ জুলাই, এক পূর্ণিমার রাতে। দিনটি ছিলো ১২ শ্রাবণ। এজন্য আদর করে কেউ কেউ শ্রাবণী বলতো তাকে। ফর্সা টুকটুকে হওয়ায় কেউবা ডাকতো আনার। কারও কাছে তিনি ছিলেন আসমানী। আর কাজের লোকদের কাছে প্রিয় সেজবু।

* শৈশব-কৈশোরে ফিরোজা বেগমের শখ ছিলো সাঁতার কাটা। চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী থাকাকালে গান গাওয়া ও নাচ শেখার পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। পড়ালেখা, খেলাধুলা, গান, অভিনয়, আঁকাআঁকি, নাচ- সবই করেছেন। সবকিছুতেই প্রথম হতেন। তা-ও নিজেই শিখে! ভুল হলে নিজেই শুধরে নিয়েছেন। নিজের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। এজন্যই তাকে দেখতে সবসময় পরিপাটি লাগতো।

* বাবা মনে মনে চাইতেন ফিরোজা বেগমকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু গানের প্রতি মেয়ের টান দেখে তিনি জোর করেননি।

* আব্বাসউদ্দিন এবং পল্লীকবি জসীমউদদীনের কাছে অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য মাঝে মধ্যে লোকগীতির তালিম নিয়েছেন ফিরোজা বেগম।

* শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্প অবলম্বনে একটি ছবিতে আমিনা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন ফিরোজা বেগম। কিন্তু তিনি রাজি হননি।

* গ্রীষ্মের ছুটিতে ছোট মামা আর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে একদিন গুণীজনদের মজলিসে ‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা’ গানটি গেয়ে প্রশংসা কুড়ান ফিরোজা বেগম। ওই আসরের মধ্যমণি ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের একজন মেয়ের মধ্যে গানের প্রতি আন্তরিকতার কথা জেনে খুব খুশি হয়েছিলেন নজরুল।

* ১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ইসলামী গান নিয়ে ফিরোজা বেগমের প্রথম রেকর্ড বের হয়। এতে তিনি গেয়েছিলেন ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। সেটা বাজারে আসার পরপরই সব রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায় হু হু করে।

* কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে ফিরোজা বেগম প্রথম গেয়েছিলেন উর্দু গান ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ আর ‘প্রীত শিখানে আয়া’।

* রবীন্দ্রসংগীত আর আধুনিক গানেও সমান বিখ্যাত ছিলেন ফিরোজা বেগম। তার গলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনে তাকে গান শেখানোর জন্য পঙ্কজ মল্লিকের মতো গুণী শিল্পী কলকাতায় তাদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন।

* রেডিওতে একসময় পাশাপাশি স্টুডিওতে গান গেয়েছেন ফিরোজা বেগম ও ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ।

* ১৯৪৮-৪৯ সালে ফিরোজা বেগম আর তালাত মাহমুদকে অতিথি শিল্পী হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তাদের গানেই উদ্বোধন করা হয়েছিলো ঢাকা রেডিওর শর্ট ওয়েভ। তখন রেডিওর চেয়ারম্যান ছিলেন জেড এ বোখারী।

* ১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত ফিরোজা বেগমের প্রথম রেকর্ড হলো ‘আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা’। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৬০ সালের পূজায় বের হয় তার আরেকটি রেকর্ড। এখানে তিনি গেয়েছেন ‘দূর দ্বীপরাসিনী’ আর ‘মোমের পুতুল’।

* প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাকে নজরুলসংগীত আর অতুলপ্রসাদ সেনের গান শিখিয়েছিলেন ফিরোজা বেগম।

* রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডও আছে ফিরোজা বেগমের। শান্তিদেব ঘোষের অনুমতি নিয়েই রেকর্ড করা হয় সেটা। তখনকার দিনে রেকর্ড করে ছাড়পত্রের জন্য শান্তিনিকেতনে গান পাঠাতে হতো। পরে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে দু’বার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে তাকে।

* শান্তিনিকেতনেই পড়ার কথা ছিলো ফিরোজা বেগমের। কিন্তু বাবা টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি বলেই যাওয়া হয়নি।

* ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন ফিরোজা বেগম। ১৯৫৬ সালে সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কলকাতাতেই জন্মেছেন তার তিন সন্তান- তাহসিন, হামিন ও শাফিন। টানা পাঁচ বছর স্বামী-সন্তান-সংসার সামলাতে গিয়ে গাইতে পারেননি তিনি।

* ১৯৬১ সালে ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুলসংগীত নিয়ে লংপ্লে রেকর্ড বেরোয়। এখানে তিনি গেয়েছেন ‘মোর ঘুম ঘোরে’ আর ‘নিরজনে সখি’। এটাই ছিলো নজরুলের গানের প্রথম লংপ্লে। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানেও প্রথম নজরুলের গানের লংপ্লে তার। এতে ছিলো ‘ওরে শুভ্রবাসনা রজনীগন্ধা’ গানটি। নজরুলের গজলের প্রথম লংপ্লেও তার। ১৯৬৮ সালে তার গাওয়া ‘শাওন রাতে যদি’ গানের রেকর্ড এক সপ্তাহের মধ্যে দুই লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। এজন্য জাপানের সনি কর্পোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সিবিএস তাকে গোল্ড ডিক্স দিয়ে সম্মানিত করে।

* স্বামীর চিকিৎসা আর সন্তানদের কথা ভেবে ১৯৬৭ সালে দেশে ফিরে আসেন ফিরোজা বেগম। আসতে না আসতেই তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাকে একদিনের মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলো। রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছিলো উপর্যুপরি টেলিগ্রাম। কালো তালিকাভুক্তও করা হয়েছিলো তাকে। সে সময় তার  বাবা ও ভাইরা তাকে দেশে রাখার জন্য লড়াই করেছেন। ব্যর্থ হননি তারা।

* ১৯৬৮-৬৯ ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথমে বাংলা গান গাওয়ার শর্তসাপেক্ষে গাইতে রাজি হন ফিরোজা বেগম। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন তা মেনে নেন। তিনি গাইলেন- ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাটি আমার দেশের মাটি’। সত্তরে করাচিতে ইএমআই পাকিস্তানে ‘জয়, জয়, জয় বাংলার জয়’ আর ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ গান দুটি রেকর্ড করেন তিনি। কিন্তু একদিন রেডিও স্টেশন থেকে গানের মূল রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়।

* ১২ বছর বয়সে রেকর্ড বের হলেও ১৯৭২ সালের আগে কখনও মঞ্চে ওঠেননি ফিরোজা বেগম। ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর কলকাতার রবীন্দ্রসদনে তিনি জনসম্মুখে গান করেন। সেটাই ছিলো সেখানে কোনো শিল্পীর করা প্রথম একক অনুষ্ঠান। ওই সময়ের আগে তার কোন ছবি রেকর্ডেও ছাপা হতো না। তিনি নিজেই এর অনুমতি দেননি।

* বিভিন্ন সময়ে নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন ফিরোজা বেগম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ), স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, সত্যজিৎ রায় স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার প্রভৃতি। বাংলা ১৪০০ সালে কলকাতায় ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ শিরোনামে নজরুলসংগীতে ফিরোজা বেগম এবং রবীন্দ্রসংগীতে সুচিত্রা মিত্রকে সম্মান জানানো হয়।

* জীবন সায়াহ্নে এসেও ফিরোজা বেগম নিয়মিত রেওয়াজ করতেন, কবিতা পড়তেন আর বাগান করতেন।

* জাতীয় কবির প্রতি সম্মান দেওয়ার জন্য টিভিতে নজরুলের গান বাধ্যতামূলক করার তাগিদ তৈরি করতে চেয়েছিলেন ফিরোজা বেগম।

বাংলাদেশ সময় : ০২৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ