ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ ভাদ্র ১৪৩২, ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

সারাদেশ

যশোর-৫ এ প্রার্থীজটের পাশাপাশি জোট ভাবনায় বিএনপি, নিশ্চিন্তে জামায়াত

সরোয়ার হোসেন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫৯, আগস্ট ২৫, ২০২৫
যশোর-৫ এ প্রার্থীজটের পাশাপাশি জোট ভাবনায় বিএনপি, নিশ্চিন্তে জামায়াত অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল হোসেন, মোহাম্মদ মুছা ও অ্যাডভোকেট গাজী এনামুল হক

যশোর: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৫ আসনে প্রধানতম রাজনৈতিক দল বিএনপির মনোনয়ন কে পাবেন তাই এখন আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। বিএনপি যদি এককভাবে নির্বাচন করে তাহলে এখানে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চাইতে পারেন এমন অন্তত ছয়জন নেতার নাম শোনা যাচ্ছে।

রয়েছে অন্য হিসেবও।  

আর যদি জোটগতভাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে জোট শরীক কোনো দলকেও আসনটি ছেড়ে দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই আসনটিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীকে মাঠে দেখা যেতে পারে। তবে, আসনটিতে নির্ভার থেকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ঘোষিত প্রার্থী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

যশোর-৫ থেকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন লড়াইয়ে যারা এগিয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দলের উপজেলা কমিটির সভাপতি শহীদ ইকবাল হোসেন। এর আগে তিনি দলের থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন মণিরামপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং মণিরামপুর পৌরসভার দুই বারের চেয়ারম্যান। ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে দলীয় মনোনয়নে সংসদ নির্বাচন করারও অভিজ্ঞতা রয়েছে এই নেতার। তবে, বিজয়ী হতে পারেননি। এবার দলীয় মনোনয়ন পেলে সেই অপূর্ণতা দূর করতে ব্যাপক সক্রিয় হয়েছেন তিনি। তিনি দলের প্রায় প্রতিটি কর্মসূচিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছুটে যাচ্ছেন সাধারণ ভোটারদের কাছে।  

দলীয় মনোনয়ন লাভে শহীদ ইকবাল হোসেনকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হবে দলের উপজেলা কমিটির সাবেক সভাপতি, জেলা কমিটির সদস্য এবং মণিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুছার। তিনিও তৃণমূলের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের সাথে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত। তিনি ধানের শীষ প্রতীক পেতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সেই সাথে ব্যাপক গণসংযোগ ও দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।  

এছাড়া, যশোর-৫ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির অন্য নেতারা হলেন দলের যশোর জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইফতেখার সেলিম অগ্নি এবং উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান মিন্টু। তাদের মধ্যে মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু এই আসনের সাবেক এমপি, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক প্রয়াত আফসার আহমদ সিদ্দিকীর ছেলে। শোনা যাচ্ছে মরহুম আফসার আহমদ সিদ্দিকীর স্ত্রী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক (নার্সেস) জাহানারা সিদ্দিকীও এবার দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।  

জোট ছাড়া বিএনপি এককভাবে নির্বাচন করলে এবং স্থানীয়ভাবে সমস্যার সমাধান করা না গেলে জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু অথবা সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকনের যে কেউ প্রার্থী হওয়ার দৌঁড়ে সামিল হতে পারেন। তখন বিএনপির নির্বাচনী ময়দানের খেলা অন্যরকম হয়ে যেতে পারে বলে দলের দায়িত্বশীল একজন নেতা জানিয়েছেন।  

বিএনপির এই দলীয় মনোনয়ন লড়াইয়ের মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে মুফতি আব্দুর রশিদের নাম। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। তবে, যশোর-৫ আসন তথা মণিরামপুরবাসীর কাছে তার সবথেকে বড় পরিচয় তিনি ‘ওয়াক্কাস হুজুরের’ ছেলে। তার পিতা মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস এই আসন থেকে তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের হুইপ ছাড়াও তিনি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে মুফতি ওয়াক্কাসের অসামান্য অবদান রয়েছে। সে কারণে প্রয়াত এই নেতাকে এখনো স্মরণে রেখেছে মণিরামপুরবাসী। তার সাথে যুক্ত হয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরামের একটি ঘোষণা।

গত ৫ জুলাই ড. মহিউদ্দিন ইকরাম মণিরামপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে যশোর-৫ আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী হিসেবে মুফতি আব্দুর রশিদের নাম ঘোষণা করে গেছেন। এর পর থেকেই শুরু হয়েছে আব্দুর রশিদকে নিয়ে নানা জল্পনা। তা যেমন বিএনপির মধ্যে, তেমনি অন্যান্য দল এবং সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও।  

এই যখন পরিস্থিতি তখন আসনটিতে নির্ভার জামায়াতে ইসলামী। এই আসনে তাদের প্রার্থী দলের জেলা কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট গাজী এনামুল হক। কবি, লেখক এবং ইসলামি বক্তা হিসেবে তার সুপরিচিতি রয়েছে। তিনি ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেসময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। দলীয় প্রভাব ও প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও সেবার অ্যাডভোকেট গাজী এনামুল হক প্রচুর ভোট পেয়েছিলেন। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শক্ত অবস্থান নিয়ে হাজির হচ্ছেন তা এখনই বোঝা যাচ্ছে। প্রতিদিনই তিনি ছুটে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছে। সবথেকে বড় কথা জামায়াতে ইসলামী এই আসনটিতে ইতিমধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের যাবতীয় সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এখন যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে তা ছক অনুযায়ী।  

এদিকে, যশোর-৫ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলের মণিরামপুর উপজেলা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন টিপু মাস্টারকে। খেলাফত মজলিসের প্রার্থী দলের মণিরামপুর উপজেলা কমিটির সভাপতি মাওলানা তবিবর রহমান।  

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপা থেকে প্রার্থী হচ্ছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যশোর জেলা কমিটির সভাপতি এবং খুলনা বিভাগীয় প্রধান সমন্বয়ক নিজামদ্দিন অমিত। তিনি এই আসন থেকে দলের প্রার্থী হিসেবে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন।  

মণিরামপুর উপজেলাটি স্বাধীনতার পর ছিল যশোর-৮ আসনের অন্তর্গত। এই আসন থেকে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির আফসার আহমদ সিদ্দিকী। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও পরিবর্তিত যশোর-৫ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে এমপি হয়েছিলেন।  

এছাড়া, যশোর-৫ আসন থেকে মুফতি ওয়াক্কাস ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে, ২০০১ সালে জামাত-ই-উলামাই থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনেও তিনি এমপি হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে খান টিপু সুলতান ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে, স্বপন ভট্টাচার্য্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ২০১৪ ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ২০১৮ সালে এবং এসএম ইয়াকুব আলী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ২০২৪ সালে এমপি হয়েছিলেন এই আসন থেকে।  

যশোর-৫ আসনের একটি বড় অংশ অভিশপ্ত ভবদহের অন্তর্গত। এই এলাকার মানুষ যুগের পর যুগ জলাবদ্ধতায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কিন্তু, সমস্যার সমাধানে আজ পর্যন্ত কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।  

এলাকাবাসীর অভিযোগ ভবদহের জলাবদ্ধতা কিছু কর্মকর্তা আর রাজনৈতিক নেতার অনৈতিক টাকা উপার্জনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। যুগের পর যুগ এই এলাকায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার সিংহভাগই গেছে এসব ব্যক্তির পকেটে। আর বিপন্ন ভবদহপাড়ের মানুষ নিজেদের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামে প্রাণপাত করে চলেছেন।  

তার সাথে আছে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, সামাজিক সম্প্রীতির অভাব ইত্যাদি জটিল সমস্যা। এ সবই আগামী নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যু হিসেবে সামনে আসবে বলে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে।  

মণিরামপুর উপজেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট রয়েছে ২০ শতাংশের ওপর। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মতুয়া সম্প্রদায়ের। ভবদহ এলাকার একটা অংশ সম্পূর্ণ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিগত দিনগুলোতে এই এলাকায় যেসব সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে তার সিংহভাগই ছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংঘটিত। বিশেষ করে একবার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং দুইবার এমপি হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতা স্বপন ভট্টাচার্য্য ও তার স্ত্রী-সন্তান সংখ্যালঘুদেরকে পূঁজি করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। কিন্তু, তারা এই এলাকার সংখ্যালঘুদেরকে অচ্ছুৎ হিসেবে ঘৃণা করতেন। তাদের বাড়িতে পর্যন্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যেতে পারতেন না। যার খেসারত হিসেবে ২০২৪ এর পাতানো নির্বাচনেও তারা স্বপন ভট্টাচার্য্যরে পক্ষে আওয়ামী লীগ, প্রশাসন এবং সরকারের জোটবদ্ধ ভূমিকার বিরুদ্ধে ‘জনতার ঐক্য’ গড়ে তুলে স্বতন্ত্র এসএম ইয়াকুব আলীকে বিজয়ী করেছিলেন। এর প্রভাব আগামী নির্বাচনেও পড়তে পারে।  

এসএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।