ঢাকা, সোমবার, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০২ জুন ২০২৫, ০৫ জিলহজ ১৪৪৬

সারাদেশ

পুশ-ইন অব্যাহত রেখেছে ভারত, ১১৮ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:২১, মে ৩১, ২০২৫
পুশ-ইন অব্যাহত রেখেছে ভারত, ১১৮ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর

খাগড়াছড়ি: মাটিরাঙ্গা উপজেলার দুর্গম গোমতী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী শান্তিপুর গ্রামের দোকানদার মো. আবুল হাসেম। গত ৭ মে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় তিনি প্রথম রাস্তার পাশে নারী ও শিশুসহ একটি জটলা দেখতে পান।

কথা বলে জানতে পারেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাদের পুশ-ইন করেছে। স্থানীয়দের সহায়তায় তিনি ক্ষুধার্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত ওই ২৭ জনকে শুকনা খাবারের ব্যবস্থা দেন এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্পে খবর দেন।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানাজানি হতে থাকে। নড়ে বসে প্রশাসন। ভোরের প্রায় একই সময়ে মাটিরাঙ্গার তাইন্দং ও পানছড়ির লোগাং সীমান্ত দিয়ে আরও ৫৩ জনকে পুশ-ইন করে বিএসএফ। এভাবে ৭ মে একদিনেই মোট ৮০ জনকে পুশ-ইন করা হয়। প্রথমে তাদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সন্দেহ করা হলেও, পরে খোঁজ নিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় নিশ্চিত হলে তাদের পর্যায়ক্রমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এরপর গত ২২ মে রামগড় সীমান্তের ফেনী নদী দিয়ে একই পরিবারের পাঁচজনকে কোমরে প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। গত ২৬ মে মাটিরাঙ্গার তাইন্দং ইউনিয়নের আচালং পাড়া সীমান্ত দিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১৯ জন এবং পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১৪ জনকে পুশ-ইন করা হয়।

সবশেষ গতকাল শুক্রবার (৩০ মে) সকালে নতুন করে আরও ১৪ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে। এই নিয়ে এখন পর্যন্ত ১৩২ জনকে পুশ-ইন করেছে ভারত।

এই পুশ-ইন প্রক্রিয়াকে অমানবিক বলছেন স্থানীয়রা। তাদের মতে, বাংলাদেশি হলে সরকারিভাবে যোগাযোগ করে ফেরত পাঠানো যেত, কিন্তু হাত-পা বেঁধে সীমান্তের এপাড়ে ছেড়ে দেওয়া অমানবিক। পুশ-ইন হওয়া ব্যক্তিরা মূলত গুজরাট ও হরিয়ানা রাজ্যে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন।

গত ২ মে রামগড় সীমান্তের ফেনী নদীতে একই পরিবারের ৫ জনকে পুশ-ইনের বিষয়টি তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি করে। স্থানীয়দের রেকর্ড করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, কোমড়ে প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে উমেদ আলী, তার স্ত্রী ও তিন মেয়েকে ফেনী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। পরে তারা ভাসতে ভাসতে তীরে এলে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করেন। উমেদ আলীর বাড়ি কুড়িগ্রামে। দশ বছর আগে তিনি অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে হরিয়ানায় একটি ইটভাটায় কাজ শুরু করেন।

রামগড়ের স্থানীয় সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন লাভলু বলেন, ভারত যেভাবে পুশ-ইন করছে, তা সম্পূর্ণ অমানবিক। রাতের আঁধারে কারও হাত-পা, চোখ বেঁধে সীমান্ত নদীতে ফেলে দিয়েছে। ভারত যদি নিশ্চিত হতো এরা বাংলাদেশি, তাহলে সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের হস্তান্তর করতে পারতো।

গোমতী ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের বাসিন্দা শামছুল হক জানান, গুজরাট থেকে রাতের বেলা এক কাপড়ে ধরে এনে, হাত বেঁধে বিমানে করে ত্রিপুরায় পাঠিয়ে, সেখান থেকে সুযোগ বুঝে গ্রুপ করে করে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ-ইন করছে। নারী ও শিশুর সঙ্গেও অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে।

পুশ-ইন হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য মতে, প্রায় অন্তত ৪০০ জনকে গুজরাট থেকে একসঙ্গে ধরে আনা হয়েছে বলে তিনি জানান।

প্রশাসন জানিয়েছে, পুশ-ইন হওয়া সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। গত ৭ মে প্রথম পুশ-ইন হওয়া ৮০ জনের মধ্যে ৭৩ জন কুড়িগ্রামের, ৬ জন নড়াইলের, এবং ১ জন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। কেবল মাটিরাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে এখন পর্যন্ত ৮৩ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে।

পুশ-ইন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো ভারতীয় বা রোহিঙ্গা আসেননি বলে জানান মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম। তিনি বলেন, আমরা পুশ-ইন হওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য যাচাই করছি এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় ইউএনওদের সহযোগিতায় হস্তান্তর করছি। নতুন করে আসা ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন কুড়িগ্রাম ও ২ জন দিনাজপুরের বাসিন্দা বলে জেনেছি। এ বিষয়ে আরও খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।

পানছড়ি উপজেলার সীমান্ত দিয়ে দুই দফায় মোট ৪৪ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে এবং তাদের সবাইকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পানছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা নাসরিন বলেন, “এখন পর্যন্ত যাদের পুশ-ইন করা হয়েছে, সবাই বাংলাদেশি। আমরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হস্তান্তর করেছি। ”

এ বিষয়ে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত মাটিরাঙ্গা, রামগড় ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে মোট ১৩২ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৮ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়েছি এবং স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবি সতর্ক রয়েছে।

এডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।