ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অপার মহিমার রমজান

‘তারাবিতে পঠিতব্য আয়াতের তাফসির’

আজ পাঠ মুমিনরা তো পরস্পরে ভাই-ভাই

মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৫
আজ পাঠ মুমিনরা তো পরস্পরে ভাই-ভাই

আজ অনুষ্ঠিত হবে ২৩তম তারাবি। আজকের খতমে তারাবিতে ২৬তম পারা তেলাওয়াত করা হবে।

আজকের তেলাওয়াতকৃত অংশে রয়েছে- সূরা আহকাফ, সূরা মুহাম্মদ, সূরা ফাতহ, সূরা আল হুজরাত, সূরা ক্বাফ সম্পূর্ণ ও সূরা আয যারিয়াতের শুরু থেকে ৩০নং আয়াত পর্যন্ত।

সূরা আহকাফ
সূরা আহকাফ মক্কি সূরা। পবিত্র কোরআনে কারিমের ধারাবাহিকতায় এ সূরার ক্রমিক নং ৪৬। এর আয়াত সংখ্যা মোট আয়াত ৩৫টি।

সূরা আহকাফের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হলো-
১-৬নং আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার একত্ববাদকে প্রমাণ করা হয়েছে।

৭-১০নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে যে, এ কোরআনের বাহক মুহাম্মদ সত্য-সত্যই আল্লাহর নবী। মক্কার মুশরেকদের অন্যতম দাবি ছিল- এ কোরআন মুহাম্মদের রচনা। আল্লাহতায়ালা তাদের এ দাবির উত্তর সূরা আহকাফের ৮নং আয়াতে নিজের প্রিয় নবীকে শিখিয়ে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, আপনি বলুন, আমি নিজেই যদি এ কোরআন রচনা করে আল্লাহর পাঠানো বলে দাবি করি তবে তোমরা আল্লাহর আজাব থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।

এ থেকে প্রতীয়মান হয়, নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীদার কোনো দিনই এ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত ও সফল হতে পারবে না। তাকে হয়তো তওবা করতে হবে, ভুল স্বীকার করতে হবে। না হয় সময়ের ব্যবধানে আল্লাহর আজাব তাকে অপদস্থ করবেই ও  ধ্বংস করবেই। সাহাবাদের আমলে মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের ভাগ্যে এবং ব্রিটিশ আমলে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ভাগ্যে এমনই ঘটেছে। মানুষের সত্য-মিথ্যা উপলব্ধি করতে পারার শেষ আশ্রয়স্থল হল নবী ও ওহি। তাই আল্লাহতায়ালা মিথ্যা নবীকে সফল হতে দিবেন না, প্রতিষ্ঠিত হতে দিবেন না। এটা কোরআনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা।

১৫নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার পিতা-মাতার সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তার মা তাকে অনেক কষ্ট করে গর্ভে রেখেছে এবং অনেক কষ্ট করে তাকে প্রসব করেছে। একজন মা না হলেও আড়াই মাস অসহনীয়, অবর্ণনীয় এ কষ্ট ভোগ করে থাকে।

১৭নং আয়াতে এমন দুর্ভাগা ব্যক্তির আলোচনা করা হয়েছে যাকে তার পিতা-মাতা ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়, ইসলাম পালনের আহ্বান করে। কিন্তু উত্তরে সে পিতা-মাতাকে ধিক্কার দেয়। মন্দ বলে।

২১-২৬নং আয়াতে আদ জাতির ওপর আল্লাহর আজাব বর্ষণের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ২৪নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, যখন তারা সে মেঘরাশিকে নিজেদের প্রান্ত ভূমির দিকে অগ্রসর হতে দেখল তখন বলতে লাগল, এ তো মেঘ মাত্র। আমাদের বৃষ্টি দিবে। আল্লাহর বললেন, না। তোমরা যা ভাবছ তা নয়। তোমরা যার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলে এটা তা। এটা ঝড়। এতে আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এটা নিজ প্রভুর নির্দেশ মতো সবকিছুকে ধ্বংস করবে। ফলে তারা এমন হয়ে গেল যে, তাদের বাসস্থান ব্যতীত আর কিছুই দেখা গেল না। কোনো জনপ্রাণীর অস্তিত্ব সেখানে থাকল না। আমি এভাবেই অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে থাকি।

২৯-৩২নং আয়াতে জিনদের মনোযোগের সঙ্গে কোরআন শোনা, ইসলাম গ্রহণ করা এবং নিজ দেশে যেয়ে ইসলামের দাওয়াতের কাজ করার কথা স্থান পেয়েছে।

সূরা মুহাম্মদ
সূরা মুহাম্মদ মাদানি সূরা। ক্রমিক নং ৪৭। মোট আয়াত ৩৮টি। এ সূরার উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হলো-

৪-১১নং আয়াতে জেহাদের ফজিলত, শহিদদের ফজিলত, জেহাদের যৌক্তিক মূল্যায়ন, বিধান আলোচনা করা হয়েছে। ৭নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো তবে আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের পায়ের নীচের মাটিকে স্থির রাখবেন।

এ আয়াতে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে ভাবার বিষয় আছে। আল্লাহর সাহায্য লাভের পূর্বশর্ত আল্লাহকে সাহায্য করা। আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে সাহায্য করা। ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী করতে সাহায্য করা। এ আয়াতের দ্বারা এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের (বিধি-বিধান) হেফাজতের জন্য মুমিনদের অগ্রসর হতে হবে, কাজ করতে হবে।

১৫নং আয়াতে জান্নাতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। ১৬-১৮নং আয়াতে মুনাফেকদের নিন্দা করা হয়েছে।
 
৩৩নং আয়াতে পৃথকভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। আল্লাহর আনুগত্যের অর্থ হলো- কোরআন মানা আর রাসূলের আনুগত্যের অর্থ হলো- হাদিস মানা। কোরআন আল্লাহর কথা, হাদিস রাসূলের কথা।

হাদিস অস্বীকারাকরীরা এ আয়াতের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। তারা বলে, রাসূলের আনুগত্য করার অর্থ রাসূলের প্রচারিত কোরআন মানা। তাদের এ ব্যাখ্যার জবাবে বলতে হয়, রাসূলের আনুগত্যের ব্যাখ্যাও যদি হয় কোরআনকেই মানা তবে কেন পৃথকভাবে রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হলো?

৩৪নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, যারা পূর্ণ ইসলামকে বা ইসলামের অংশবিশেষকে অস্বীকার করা অবস্থায় মারা যাবে আল্লাহতায়ালা কখনো তাদের ক্ষমা করবেন না।

৩৮নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা যদি ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আল্লাহ তোমাদের স্থলে অপর এক সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করবেন। তারা তোমাদের মতো ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না।

বর্তমানে মুসলিমরা ইসলাম বিষয়ে যে পরিমাণ উদাস আর পশ্চিমা বিশ্ব ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে- তাতে মনে হয় আয়াতের বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। সেটা অবশ্য আল্লাহতায়ালা ভালো জানেন।

সূরা আল ফাতহ
সূরা আল ফাতহ মাদানি সূরা। ক্রমিক নং ৪৮। আয়াত ২৯টি। এ সূরার উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হলো-

৬ষ্ঠ হিজরিতে মহানবী (সা.) ১৪০০ সাহাবি সঙ্গে নিয়ে ওমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হন। তিনি মক্কাবাসী থেকে বাঁধা পাওয়ার আশঙ্কায় মক্কা থেকে তিন মাইল উত্তরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। এ স্থানে মক্কাবাসীদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিকে ১নং আয়াতে মুসলমনাদের ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে।

হুদায়বিয়াতে শিবির স্থাপনের পর মক্কাবাসীদের মত জানার জন্য মহানবী (সা.) হজরত উসমান (রা.) কে মক্কায় প্রেরণ করেন। তার ফিরে আসতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হওয়ায় গুজব রটে যায় যে, মক্কায় হজরত উসমান (রা.) কে শহিদ করা হয়েছে। এ সংবাদ শ্রবণে মহানবী (সা.) হজরত উসমানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্তে একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সাহাবাদের থেকে জেহাদের বায়াত গ্রহণ করেন। এ বায়াত ইতিহাসে বায়াতে রিজওয়ান নামে পরিচিত।

১৮নং আয়াতে এ বায়াতের আলোচনা হয়েছে। এবং এ বায়াতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ঘোষণা করা হয়েছে।

এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, খেলাফতের বায়াত ছাড়াও বিশেষ নেক আমলের উপর বায়াত গ্রহণ করা যায়। আমাদের পীর-মাশায়েখরা তাদের মুরিদদের থেকে বিভিন্ন নেক আমলের বায়াত গ্রহণ করেন। তাই তাদের বায়াত কোরআন সম্মত ও জায়েয।

২৮নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তার রসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন সব মতাদর্শ ও মতবাদের উপর এ দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য এবং এটাই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা।

সূরা আল হুজরাত
সূরা আল হুজরাত মাদানি সূরা। ক্রমিক নং ৪৯। মোট আয়াত ১৮টি। এ সূরার উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হলো-

৬নং আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সন্দেহ ভাজন কোনো ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসলে সে সংবাদের ভিত্তিতে তাড়াহুড়ো করা যাবে না। সংবাদের সত্যতা অনুসন্ধান করতে হবে। বর্তমানে তথ্যপ্রবাহের অবাধ সময়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদের ক্ষেত্রে এ আয়াতটি একটি মাইলফলক ও মানুষের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

৯-১০নং আয়াতে মুসলিমদের পরষ্পরের মধ্যে বিবাদ দেখা দিলে অন্য মুসলিমদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের মাঝে আপোষ-মিমাংসা করে দিতে। প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে হলেও তা করতে বলা হয়েছে।

১০নং আয়াতে বলা  হয়েছে, মুমিনরা সবাই ভাই-ভাই।

১১নং আয়াতে কোনো মুমিনকে নিয়ে ঠাট্টা করা, দোষারোপ করা, মন্দ নামে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে।

১২নং আয়াতে অনুমান নির্ভর কু-ধারণা পোষণ করা, পরের দোষ তালাশ করা, গিবত (পরনিন্দা) করাকে হারাম করা হয়েছে।

১৩নং আয়াতে বংশ নিয়ে গৌরব করাকে হারাম করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, এ সব বংশ ও গোত্রের বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে নিছক পরিচয়ের সুবিধার্থে।

সূরা ক্বাফ
সূরা ক্বাফ মক্কি সূরা। ক্রমিক নং ৫০। মোট আয়াত ৪৫টি। আজকের তারাবিতে পঠিতব্য এ সূরায় সৃষ্টির বিচিত্র নিদর্শন দ্বারা আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমাণ করা হয়েছে, মুমিনদের জন্য জান্নাতের ও অবাধ্যদের জন্য জাহান্নামের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, কিয়ামত ও পুনরুত্থান নিয়েও বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

সূরা আয যারিয়াত
সূরা আয যারিয়াত মক্কি সূরা। ক্রমিক নং ৫১। মোট আয়াত ৬০টি। আজ তেলাওয়াত হবে সূরা আয যারিয়াতের শুরু থেকে ৩০নং আয়াত পর্যন্ত। আজকের পঠিতব্য অংশে জাহান্নামের আলোচনা হবে।

এছাড়াও রয়েছে আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে অতিথিরূপে ফেরেশতাদের আগমন, বার্ধক্যের সময় সন্তান লাভের সুসংবাদ এবং তার আতিথেয়তার গুণ সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘন্টা, জুলাই ১০, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।