‘মাদকের হাট’ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড

জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ২১:০৬, জুন ২৬, ২০১১

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জ শহরবাসীর কাছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডটি (সংযোগ সড়ক) ‘মাদকের হাট’ হিসেবে পরিচিত। শহর ও শহরতলীর ৫০টি স্পটে অন্তত ২০০ মাদক ব্যবসায়ি ও বিক্রেতার নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসা।

এসব স্পটে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কয়েক লাখ টাকার মাদক। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন পরিবহনে করে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রুটে মাদকের বিপুল পরিমাণ চালান প্রবেশ করছে। নারায়ণগঞ্জে মাদক ব্যবসা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ বলেও মন্তব্য স্থানীয়দের।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সহায়তায় মাদক স্পটগুলোতে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে মাদক। পুলিশের নিস্ক্রিয়তার কারণেই নারায়ণগঞ্জে মাদকের বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গত ১৪ জুন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা থানার পাগলা রেললাইন বটতলা এলাকায় মাদক বিরোধী অভিযান চালানোর সময়ে র‌্যাব সদস্যদের ওপর মাদক ব্যবসায়ী-সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও র‌্যাবের সদস্যকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এসময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে এক স্কুল ছাত্রের মৃত্যু ও দুইজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে।

র‌্যাবের দাবি ছিল, তারা সাদা পোশাকে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করতে গেলে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে গুলিবর্ষণ করে মাদক ব্যবসায়ীরা।

এ ঘটনার পরও প্রশ্ন উঠেছিল, বটতলা এলাকায় সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করে আসলেও পুলিশ কেন সেখানে অভিযান চালায়নি। তাছাড়া ১৪ জুনের ওই ঘটনার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে দু’টি ও নিহত স্কুল ছাত্র স্বাধীন আহমেদ শুভ শেখ এর মা রহিমা খাতুন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। তবে পুলিশ শনিবার বিকেল পর্যন্ত মামলার এজাহারভুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

গত ২২ মে নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজার পৌর কলোনী এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ হেরোইন ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে র‌্যাব-২। এসময় গ্রেপ্তার করা হয় ৪জনকে।

শহরবাসীর অভিযোগ, মাদকের আখড়া টানবাজার পৌর কলোনী নারায়ণগঞ্জ সদর থানার কাছে হলেও পুলিশ সেখান থেকে বড় ধরনের কোনও মাদক উদ্ধার করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক থাকার কারণেই পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়নি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ফোরাম জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভাগুলোতেও মাদকের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সভায় কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের বক্তব্যে মাদকের বিস্তারের ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

ওইসব সভাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে তাদের জেহাদের কথা বললেও বাস্তব অর্থে চিত্র তার ভিন্ন। নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকের ব্যপকতা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় ক্রাইমজোন ও মাদকের আস্তানা হিসেবে পরিচিত ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের মাত্র শ’ খানেক গজ দূরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের (সংযোগ সড়ক) পাশে অবস্থিত চাঁদমারী বস্তি। ওয়ান ইলেভেনের সময় এ বস্তিতে উচ্ছেদ অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। সে সময় প্রকাশ্যে অবৈধ মাদক বিক্রি অনেকাংশে কমে যায় এ জেলায়।

কিন্তু পরে উচ্ছেদ করা বস্তির আশেপাশের এলাকাতে আবারো নতুন করে ছোট ছোট বস্তি গড়ে উঠে। এসব বস্তিসহ চাঁদমারীর এলাকা থেকে নতুন কোর্ট পর্যন্ত এলাকাজুড়ে প্রকাশ্যে বিক্রি হয় মাদক। বস্তির বাইরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অভিনব কায়দায় বিক্রি হচ্ছে মাদক। বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ সাংকেতিক ‘শিষ’ বাজিয়ে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করলেও সেখানে নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোনও অভিযান।

শহরের ইসদাইর এলাকার সিদ্দিকুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, তিনি প্রতিদিন চাঁদমারি এলাকা দিয়ে যাতায়াত করেন। রাতের বেলায় তো বটেই দিনের বেলাতেও তিনি প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা করতে দেখেন। রিকশায় যুবক শ্রেণী কাউকে দেখলেই শিষ বাজিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাদক ব্যবসায়ীরা। দেখা যায়- রিকশা চালকরা রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে প্রকাশ্যে মাদক ক্রয় করছে। তবে কেবল পুলিশসহ আইন-শৃংখলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেউ এসব দেখেন না।

সস্তাপুর এলাকার আলামিন প্রধান বাংলানিউজকে জানান, প্রায় সময়ে বিভিন্ন বয়সী লোকজন চাঁদমারি এলাকায় গাড়ি থামিয়ে মাদক কিনে নিচ্ছে। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট।

চাষাঢ়া আদর্শ চাঁদমারি এলাকার আবদুল্লাহ রনি বাংলানিউজকে জানান, মাদক স্পটগুলোতে প্রতিদিন টহল পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। টহল পুলিশের উপস্থিতিতেই মাদক বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘পুলিশের সহায়তা ছাড়া প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি সম্ভব নয়।’

নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাবিবুর রহমান বাদল বাংলানিউজকে জানান, শহরের আনাচে-কানাচে ও অলিতে-গলিতে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে মাদকদ্রব্য। নারায়ণগঞ্জ বর্তমানে মাদকে ভাসছে। এতে করে নারায়ণগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বাড়ছে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-।

এনিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভাগুলোতে সবসময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং দিন দিন বাড়ছে মাদকের ব্যবহার। স্কুল কলেজ পড়–য়া মেয়েরাও ইয়াবা সেবর ও ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।

সাংবাদিক মাকসুদুর রহমান কামাল বাংলানিউজকে জানান, মাদকদ্রব্য উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ কোনও অভিযান না থাকায় নারায়ণগঞ্জের প্রত্যেকটি পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠেছে একাধিক মাদক স্পট। ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে উঠতি মাস্তান-ক্যাডাররা এসব মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আজকাল শহরের মিনি পতিতালয় পরিচিতি আবাসিক হোটেলগুলোতেও এখন মাদক ব্যবসা চলছে ধুমসে।

তিনি আরো জানান, মোবাইল ফোন থাকায় এখন মাদক ব্যবসা আরো সহজ হয়ে গেছে। মাদক বিক্রেতা ও ক্রেতারা মোবাইলে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাদক কেনা-বেচা করছে।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, শহরের চাষাঢ়া রেললাইন বস্তি, চাঁদমারী বস্তি, বালুরমাঠ, গলাচিপা-উকিলপাড়া রেললাইন, জামতলা, হংস হলের পুল, ম-লপাড়া পুল, জিমখানা বস্তি, মাছুয়াপাড়া, আমলাপাড়া, মাসদাইর, ইসদাইর, বাবুরাইল, দেওভোগ, জল্লারপাড়, পাইকপাড়া, বেপারীপাড়া, ভূঁইয়ার বাগ, জিউসপুকুর পাড়, নন্দিপাড়া, নাগবাড়ী, হাজীগঞ্জ, পাঠানতলী, কোতালের বাগ, সস্তাপুর, ডনচেম্বার, ব্যাংক কলোনি, খানপুর, তল্লা, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, চাষাঢ়া` ও নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশন, নিতাইগঞ্জ, জিমখানা ও র‌্যালিবাগান বস্তিসহ নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীর ৫০টি স্পটে ২০০ মাদক ব্যবসায়ি ও বিক্রেতার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাদক ব্যবসা।

এসব স্পটে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কয়েক লাখ টাকার ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, দেশি-বিদেশি মদ, গাঁজাসহ অন্যান্য মাদক। অভিযোগ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। তার সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, ক্যাডার ও এলাকার ‘বড়ভাই’দের শেল্টার।

মূলত দেশের মাদক ব্যবসার অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট এখন নারায়ণগঞ্জ জেলা। ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগস্থল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জ শিমরাইল মোড় হল মাদকের অন্যতম বর্ডার। খোদ পুলিশের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রুটে মাদকের বিপুল পরিমাণ চালান প্রবেশ করছে।

ফেনসিডিলের সবচেয়ে বড় চালানগুলো আসছে কুমিল্লা জেলা থেকে। ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা ফেনসিডিল বিভিন্ন কৌশলে ট্রাক, বাস কিংবা অন্যান পরিবহনে করে পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্যে। মাঝে মধ্যে পুলিশ বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের কয়েকজনকে আটক আর কিছু মাদকদ্রব্য উদ্ধার করলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে রাঘববোয়ালরা।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার নাজমুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে কোনও আপোষ নেই। মাদক ব্যবসায়ী আর এর সঙ্গে সম্পৃক্তরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন তাদেরকে কোনওভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।’

তিনি জানা, বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের প্রধান কাজ হলো মাদক নিমর্ূূল করা। তবে শুধু পুলিশের পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ। তবে বর্তমান পুলিশ প্রশাসন মাদকের বিরুদ্ধে অনেক তৎপর। আগের চেয়ে মাদক উদ্ধার ও মাদক ব্যবসায়িদের গ্রেপ্তারসহ মাদক আইনে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।’

পুলিশের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের আঁতাতের অভিযোগ সত্য নয় বলেও দাবি করেন পুলিশ সুপার। তিনি বলেন, ‘কোনও পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, ২৬ জুন, ২০১১


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান