
চট্টগ্রাম: এক সময় মনে করা হতো জাহাজ কেটে শুধু লোহাই পাওয়া যায়। অর্ধ যুগ পেরিয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প এখন শুধু নির্মাণ শিল্প নয়, ফার্নিচার, স্টিল মিল, ইলেট্রিক ক্যাবল, অ্যালমুনিয়াম, প্লাস্টিক, জেনারেটরসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানার কাচামালের চাহিদা পূরণ করছে। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে প্রায় দেড় কোটি লোক।
কিন্তু গত এক বছর চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপকুলীয় এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা বিকাশমান এ শিল্পের কার্যক্রম বার বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পের বিনিয়োগ। পাশাপাশি কাজ না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক।
দীর্ঘ ২২ বছর ধরে শিপ ইয়ার্ডে কাজ করে এখন ফোরম্যান হয়েছেন বারো আউলিয়া এলাকার মক্কা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের মহরম আলী। এখানে কাজ করে তিনি সংসার চালানোর পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে মা-বাবাকে টাকা পাঠান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘শিপইয়ার্ড বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের কষ্ট। জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকায় বর্তমানে মাত্র ২০টির মতো শিপইয়ার্ড সচল রয়েছে। ফলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গ্রামে ফিরে গেছে।’
মহরম আলী জানান, অনেকেই মাটি কাটাসহ অন্য কাজে চলে গেছে। আর কিছু শিপইয়ার্ডে আগে আমদানি করা পুরনো জাহাজের টুকটাক কাজ চলছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ১১৪টি শিপইয়ার্ডের মধ্যে বন্ধ রয়েছে ৮০টিরও বেশি শিপইয়ার্ড।
মহরম বলেন, শিপ ব্রেকিং শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আছে। বেলাইনে কাজ করলেই শুধু এখানে দুর্ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখন আগের মতো অবস্থা নেই। জাহাজগুলো পরিষ্কার করে তারপর কাটা হয়।’
তিনি জানান, নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত জাহাজ আমদানির ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বর্তমানে শুধু ১০/১২টি ইয়ার্ডে পুরনো স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটার কাজ চলছে ।
তবে সরকার যদি শিগগিরই বিধিমালা তৈরি করে জাহাজ আমদানির সুযোগ না দেয় তবে এ সেক্টরসহ সংশ্লিষ্ট শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন কামালউদ্দিন।
কামালউদ্দিন জানান, জাহাজের কাঠ দিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ফৌজদারহাট ভাটিয়ারী এলাকায় গড়ে উঠেছে ফার্নিচার শিল্পসহ হালকা ইস্পাত শিল্প।
এছাড়া তামা, পিতল, অ্যালুমিনিয়াম কারখানা, মোল্ডিং কারখানাসহ অভ্যন্তরীণ নৌযান তৈরিতে ব্যবহৃত হয় শিপইয়ার্ডের মাল।
স্থানীয় এসব শিল্প অনেক কম দামে শিপইয়ার্ড থেকে ইলেকট্র্কি মোটর, জেনারেটর, ক্যাবল, পাইপ, স্ক্রু, বেয়রিং, এমনকি ফার্নেস অয়েল সংগ্রহ করতো।
বর্তমানে শিপইয়ার্ড বন্ধ থাকায় এসব মালামাল এখন বিদেশ থেকে আনতে হবে তাদের।
এছাড়া কাঁচামালের অভাবে রি-রোলিং মিলসহ অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
লোহার চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের উন্নয়ন কাজ থমকে যাবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তিনি।
সীতাকুন্ডের কুমিরা রাজা কাশেম শিপইয়ার্ডে কাজ করতেন কাটারম্যান সবুজ। সুদূর দিনাজপুর থেকে জীবিকার তাগিদে ছুটে এসেছিলেন তিনি চট্টগ্রামে। এখানে জাহাজ কেটে আয়-রোজগার ভালোই ছিল। মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা পেতেন। কিন্তু ইয়ার্ডে কাটার মতো আর নতুন কোনও জাহাজ না থাকায় বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে দিয়ে ঢাকার কালিগঞ্জে অর্ধেক বেতনে একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানায় যোগ দিয়েছে বলে জানান।
তার মতো আরও দুশ’ শ্রমিক একই সঙ্গে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বলে সবুজ জানান।
সবুজ বাংলানিউজকে বলেন, ‘তিন বছর এখানে কাজ করেছি। কখনও একটু হাত-পায়ে ব্যথা পাইনি। সাবধানে কাজ করলে দুর্ঘটনা ঘটে না।’
সবুজ জানান, দিনাজপুর, রংপুর বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন দরিদ্রপ্রবণ অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার শ্রমিক চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে কাজ করে তাদরে সংসার চালাতেন। কিন্তু নতুন জাহাজ কাটার অনুমতি না থাকা এবং ইয়ার্ডে কাটার মতো জাহাজ না অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে এখন নতুন কাজের আশায় ঘুরছে। বাড়ি ফিরে গেছে অনেকে। ইয়ার্ডগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে।
এদিকে জাহাজ কাটা বন্ধ থাকায় প্রভাব পড়েছে রডের বাজারে।
শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, বার বার জাহাজ কাটার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ২০০৯-১০ অর্থ বছরে শিপইয়ার্ডগুলোতে উৎপাদনের পরিমাণ অনেক কমে যায়। ওই বছর ১৭১টি জাহাজ থেকে উৎপাদন হয় ১৯ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন লোহা।
এর আগে ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে ১৯১টি জাহাজ থেকে উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন।
বর্জ্যমুক্ত সনদ এবং পরিবশেগত ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজ আমদানির ওপর মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা থাকায় চলতি ২০১০ - ১১ অর্থ বছরের সাত মাসে জাহাজ আমদানি হয়েছে মাত্র ২৪টি।
ফলে চলতি বছরে লোহার সংকট বাড়ার কারণে রডের দাম আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন হাবিব স্টিলের স্বত্বাধিকারী ইয়াসিন আলী।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শিপইয়ার্ডগুলো চালু না হলে শুধু রি-রোলিং মিল নয়, পুরো দেশের মানুষ সাফার করবে। আবাসন খাতসহ সংশ্লিষ্ট সব সেক্টর বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে।’
তিনি জানান, বর্তমানে ৪০০ রি-রোলিং মিল, ২১০টি মোল্ডিং কারখানা, ৮০০টি ফার্নিচার কারখানা, ৩০০ তামা পিতলের কারখানা, ৩২০টি অ্যালমিনিয়াম ফ্যাক্টরি, ১৫টি প্লাস্টিক ও ৩৫টি অক্সিজেন ফ্যাক্টরির ৮০ লাখ শ্রমিকের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে এ শিল্পের ওপর।
অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক বাংলানিউজকে জানান, কাচামালের অভাবে অনেক রি-রোলিং মিল বন্ধ হয়ে প্রায় এক লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে।
চালু মিলগুলোতেও পুরো দমে কাজ হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে একটি মিলে দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ হতো, এখন সেখানে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ হয়। ফলে একটি বড় মিলে আগে এক হাজার শ্রমিক কাজ করতো সেখানে শ্রমিক সংখ্যা এখন আড়াইশ’তে গিয়ে ঠেকেছে।’
এদিকে, জাহাজ আমদানি না হওয়ায় শিপইয়ার্ড মালিকরা সিন্ডিকেট করে লোহার দাম বাড়ানোর কারণে রি-রোলিং মিল মালিকরাও রডের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন।
৪০ গ্রেডের রডের দাম ১৫ দিনের ব্যবধানে পাঁচ হাজার টাকা বেড়ে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়া ওঠা লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন জীবিকার উৎস চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্পকে বাঁচাতে সরকার দ্রুত সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে অসবে- এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।’
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১১