শুল্ক কম হওয়ায় সস্তা সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৮:২৩, এপ্রিল ২৩, ২০১৩

ঢাকা: প্রায় প্রতিটি বাজেটেই বিড়ির ওপর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে দাম বেড়েছে বিড়ির। অতি মূল্যের সিগারেটের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কম মূল্যমানের সিগারেটের ওপর সেই হারে শুল্ক বৃদ্ধি না হওয়াতে ব্যাবহার বাড়ছে সস্তা সিগারেটের।

কমদামী সিগারেটের শুল্কহার কম থাকার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সিগারেট সবচেয়ে সস্তা। আর এ কারণে তরুণ সমাজ সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে। দিন দিন এ আসক্তির সংখ্যা বাড়ছে। এ বৃদ্ধির হার কমাতেই আসন্ন বাজেটে সিগারেটের ওপর শুল্ক হার বৃদ্ধির দাবি উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে শতকরা ৪৩ দশমিক ৩ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তামাক সেবন করে। ফলে তামাকজনিত রোগে তাদের চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর যে অর্থ ব্যয় হয়, তা এ খাত থেকে প্রতিবছর সরকারের রাজস্ব আদায়ের দ্বিগুণ।

অন্যদিকে তামাকজনিত রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায়। এছাড়া আরও প্রায় ১২ লাখ মানুষ নানাবিধ রোধে আক্রান্ত হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১০-১১ অর্থবছরে তামাক কোম্পানিগুলো থেকে ৭ হাজার ৫৫ টাকার রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে, যা মোট আদায় করা করের শতকরা ১১ ভাগ। এর মধ্যে সিগারেট থেকে সাত হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা এবং বিড়ি থেকে ২৩৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে। (তামাকসেবীর সংখ্যা কমিয়ে আনাই মূল উদ্দেশ্য) পরিসংখ্যান থেকে আরও দেখে যায়, ২০০০-০১ সালে প্রতি হাজার বিড়ির ওপর শুল্ক ছিল ৩০.৯০ টাকা। বর্তমান অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০.৮৮ টাকা। এই শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বিড়ির দাম বেড়েছে।

বিপরীতে কমদামী সিগারেট সস্তা হয়ে গেছে। ফলে বিড়ি ব্যয়বহুল হওয়ায় বিড়িসেবীরা বিড়ি ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ধরছে।

গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর সিগারেট ক্রয়ে জিডিপির এক শতাংশ এবং বিড়ি ক্রয়ে জিডিপির দশমিক ৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়। ফলে দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলে সিগারেটের ব্যবহার ৬৬ শতাংশ কমে যাবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বাড়বে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে মোট পুরুষের মধ্যে তামাক সেবনে আসক্ত প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ সিগারেটে এবং ২০ শতাংশ বিড়ি ও অন্যান্য তামাকে আসক্ত।

এক পরিসংখ্যানে, দক্ষিণ এশিয়ার তুলনামুলক চিত্র থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের সর্বনিম্ন দাম ১ দশমিক ৩৮ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ভারতে এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৭ দশমিক ০৪ ডলার, নেপালে ১ দশমিক ৬৬ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮৯ ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশে সিগারেটের ওপর গড় শুল্ক হার ৫১ শতাংশ, ভারতে ৫৮ শতাংশ, নেপালে ৭০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৫৪ শতাংশ।

এ চিত্র থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ শুধু সিগারেটের দামই কম নয়, শুল্কও কম। বিশেষ করে সস্তা সিগারেটের ওপর দাম অবিশ্বাস্যভাবে কম। গত তিন বছরে ফিল্টার বিড়ি ছাড়া সাধারণ বিড়ির ওপর ট্যাক্স বাড়েনি। কিন্তু বিদ্যমান শুল্কের কারণে বিড়ির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিড়ি সেবীরা সস্তা সিগারেটে চলে গেছে। ফলে শুল্ক বৃদ্ধির সুফল সরকার পাচ্ছে না। তাই বিড়ির পাশাপাশি সিগারেটের ওপরও শুল্কহার বাড়াতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, গত আট বছরে সিগারেটের ওপর শুল্ক বেড়েছে গড়ে এক শতাংশ। আর বিড়ির ওপর বেড়েছে ১০ শতাংশ।

সিগারেটের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আয় আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে সিগারেটের চতুর্থ স্ল্যাব বাতিল করে দশ শলাকার সিগারেটের মূল্য ন্যূনতম ৩০ টাকা করা যেতে পারে।

তামাক বিরোধী কর্মীরা বলছেন, সরকার কখনই সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায়নি। শুধু বিভিন্ন স্ল্যাবে দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে বরং সরকার নয়, কোম্পানিগুলোই লাভবান হয়েছে। তাই সিগারেটের দামের স্ল্যাব তুলে দেওয়ার দাবি জানান তারা।

ধূমপান নিরুৎসাহিত করার জন্য আগামী বাজেটে কমদামী সিগারেটের ওপর কর বাড়ছে। কমছে সর্বোচ্চ ধাপের সঙ্গে সর্বনিম্ন ধাপের শুল্ক পার্থক্য। এতে কমদামী সিগারেটের দাম বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে সরকারের রাজস্ব।

জানা যায়, বর্তমানে দামী সিগারেটের ওপর সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপিত আছে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত কমদামী সিগারেটের ওপর তেমন কোন শুল্ক বাড়ছে না। ছয় বছর পর কমদামী সিগারেটের ওপর এক শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি পেলেও তা সাত বছর আগের তুলনায় কম। অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে এ সিগারেটের ওপর মাত্র এক শতাংশ শুল্ক বাড়িয়ে ৩৩ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু এখনও তা ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরের শুল্কের চেয়ে কম রয়েছে। ওই বছর সিগারেটের সর্বনিম্ন ধাপের শুল্ক ছিল ৩৫ শতাংশ। যা ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে কমিয়ে করা হয় ৩২ শতাংশ এবং তা অব্যাহত থাকে ২০০৯-’১০ পর্যন্ত।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিগারেটকে আরও সুবিধা দেবার জন্য সিগারেটের শুল্কের ধাপ করা হয়েছে চার ভাগে। সর্বোচ্চ ধাপের জন্য ৫৮ শতাংশ, তৃতীয় ধাপের জন্য ৫৬ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপের জন্য ৫০ শতাংশ এবং প্রথম ধাপের জন্য ৩৩ শতাংশ হারে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে সর্বোচ্চ ধাপের সঙ্গে তার পরের ধাপের ব্যবধান ২ শতাংশ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ব্যবধান ছয় শতাংশ। আর দ্বিতীয় ধাপের তুলনায় প্রথম ধাপের জন্য ব্যবধান ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ এমনভাবে শুল্কায়ন করা হয়েছে, দামী সিগারেট আরও দামী হয়, আর কমদামী সিগারেট সহজলভ্য হয়।

এর ফলে ১২ বছর আগে বিড়ি চলত ১২০০ কোটি আর সিগারেট চলত ১৫০ কোটি। বর্তমানে সেই বিড়ি নেমে এসেছে ৪৮০ কোটিতে আর সিগারেট বেড়ে গেছে ৭০০ কোটিতে।

বাংলাদেশ হচ্ছে, সবচেয়ে সস্তা সিগারেটের দেশগুলোর অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্ব তামাক মহামারী ২০০৮ প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, বিশ্ব শলাকায় এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ২০০৬ সালে মার্কিন ডলারে ছিল শ্রীলঙ্কায় ৭.৮৯, ভারতে ৭.০৪, নেপালে ১.৬৬ এবং বাংলাদেশে ১.৩৮। এর ফলে ২০১০ সালে বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালের তুলনায় সিগারেটের প্রাপ্যতা অনেক সহজ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চহারে শুল্কায়ন করে মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। কম শুল্ক ধার্য করে এক শ্রেণির সিগারেটকে করা হচ্ছে সস্তা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিসেবে, খুচরা মূল্যের শতকরা হারে সিগারেট শুল্কায়ন নেপালে ৭০, ভারতে ৫৮, শ্রীলঙ্কায় ৫৮ আর বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে সিগারেটের শুল্কায়ন সবচেয়ে কম। অথচ তামাক রফতানির ওপর শুল্ক আরোপ করে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তামাক রফতানিকে প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এসব বিবেচনায় আগামী  অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে তাতে বাড়ানো হচ্ছে কমদামী সিগারেটের ওপর শুল্ক। সেই সঙ্গে হ্রাস করা হচ্ছে দামী সিগারেটের সঙ্গে কমদামী সিগারেটের মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক বৈষম্য।

বাংলাদেশ সময় ১৭৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৩
এমএন/এআর/জেডএম


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান