ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

আনোয়ারে ডুবছে বিদ্যুতের মাস্টার প্ল্যান

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪
আনোয়ারে ডুবছে বিদ্যুতের মাস্টার প্ল্যান আনোয়ার হোসেন

ঢাকা: বিদ্যুৎ খাতের সমন্বিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাইকাকে দিয়ে করা মাস্টার প্ল্যানের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্পের শেষের দু’টির কোনটাই যথাসময়ে আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্তু ওই মাস্টার প্ল্যানকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তি স্বার্থে প্রকল্প নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।


 
মাস্টার প্ল্যান, এমনকি বিশ্বের কোথাও নেই এমন সব উদ্ভট পন্থা অবলম্বনের করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। আর সবটাই হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্মসচিব আনোয়ার হোসেনের পরিকল্পনায়।
 
তার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম। আর সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা।
 
ঘোড়াশালে একটি রিপাওয়ারিং প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে করে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে ২২০ মেগাওয়াট। আর এটির পেছনে সুদ ও আসল মিলিয়ে ব্যয় হবে তিন হাজার কোটি টাকার মতো।
 
অথচ এ অর্থ দিয়ে ৫শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যায় বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
 
ঘোড়াশালে আরও দু’টি ইউনিটে রি-পাওয়ারিংয়ের প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। এতে ব্যয় হবে ২৬শ’ কোটি টাকা। এখান থেকে ৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অথচ ৪ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন গ্যাস ভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সর্বোচ্চ ২৪শ’ কোটি টাকা হলেই যথেষ্ট। এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ সভাতেই বিরোধিতা ওঠে বলে সূত্র জানিয়েছে।
 
অতিরিক্ত অর্থ খরচের অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব। তিনি দাবি করেছেন মাস্টার প্ল্যানে ইফিসিয়েন্সি (সাশ্রয়ী) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে। এটাকে সেটাই বলতে হবে।
 
এখানে এখন ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ১৯০ মেগাওয়াট। রি-পাওয়ারিং হলে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, জ্বালানি সাশ্রয় হবে বলে জানান তিনি।
 
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক মেশিন রয়েছে যেগুলোর আপডেট ভার্সন এসেছে বাজারে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিই আর এসব যন্ত্রপাতি উৎপাদন করছে না। এরকম কিছু পুরনো যন্ত্রপাতি রেখে রি-পাওয়ারিং করা আত্মহত্যার শামিল ছাড়া কিছুই নয়।
 
ক্ষমতা কুক্ষিগত
বিদ্যুৎ বিভাগ কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসন শাখায় একজন অতিরিক্ত সচিব ও দুইজন যুগ্মসচিব দায়িত্বে রয়েছেন। অন্যদিকে উন্নয়নের ক্ষেত্র বিশাল হলেও একজন যুগ্ম সচিব দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। আর এই দায়িত্বে রয়েছেন বিতর্কিত ব্যক্তি আনোয়ার হোসেন।
 
টানা সাত বছর ধরে দাপটের সঙ্গে রয়েছেন। তার আচরণের কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের অধিনস্থ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। কথিত আছে, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ হোক এটা আনোয়ার হোসেন চান না।
 
আর তিনি চান না বলে, সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. মনোয়ার ইসলাম জনপ্রশাসনে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন শাখায় আর কোন নতুন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব বা নিয়োগ না দেওয়ার জন্য।
 
প্রশাসনে লোক বেশি। কিন্তু উন্নয়নে মাত্র একজন যুগ্ম সচিব রয়েছেন। উন্নয়ন কাজ কুক্ষিগত করার জন্যই এমনটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে  বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বলেন, আমাদের উন্নয়নের কোন সমস্যা হচ্ছে না।
 
তবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেন, উন্নয়নে লোক বেশি থাকা দরকার। এটা আমি অনুভব করি।
 
আনোয়ার হোসেন সাত বছরে বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকেই শুধু পিছিয়ে দেননি, একইসঙ্গে নজিরহীনভাবে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আনোয়ার হোসেনের নজর শুধু রেন্টাল কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো, পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনহীন প্রকল্পের কাজ শুরু করা ও বিদেশ ভ্রমণের দিকে।
 
বিদেশ ভ্রমণের সময় কাউকে দায়িত্ব দিয়ে না যাওয়ার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। আর সেই সময়গুলো সবকাজ স্থবির হয়ে থাকে। বিদ্যুৎ বিভাগে তাকে বলা হয় সফর সচিব। কারণ নানা ছুতোয় ৭০ দফায় বিদেশ সফর করেছেন এরই মধ্যে।
 
রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। পুরনো এবং বিকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ দিয়েছেন তিনি। প্রথমে বলা হয়েছিলো, যেহেতু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে। তাই ‘নো বিদ্যুৎ নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে চুক্তি হবে।
 
কিন্তু পরে রহস্যজনক কারণে সেখান থেকে সরে এসে কয়েক হাজার কোটি টাকা দিয়ে পুরনো অকেজো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ভাড়া করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও সরকারকে অর্থ গুণতে হবে।
 
আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানিতে (এপিসিএল) প্ল্যানিং কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই আনোয়ার হোসেন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন বলে এপিসিএল সূত্র দাবি করেছে। অথচ প্ল্যানিং কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোন প্রকল্প গ্রহণের সুযোগ নেই বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
 
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, এপিসিএল একটি কোম্পানি। তাই তাদের প্ল্যানিং কমিশনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কোম্পানির বোর্ড স্বাধীন। তারাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
 
বিসিএস রেলওয়ে ক্যাডারের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে যোগদান করেন ২০০৮ সালে। পরে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হন। ৭ বছর ধরে একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত তিনি।

অনেকবার ফোন দিয়েও আনোয়ার হোসেনের সাড়া পাওয়া যায় নি।   

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।