ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র

বাপদাদার ভিটে হারাবে লাখো মানুষ

রমেন দাশগুপ্ত, আনোয়ারা থেকে ফিরে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১২
বাপদাদার ভিটে হারাবে লাখো মানুষ

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন সাধারণ মানুষ। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে ভূমি অধিগ্রহণ হলে পৈতৃক ভিটেমাটি, ফসলি জমি হারিয়ে আনোয়ারার বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন হবে বলে আশংকা করছেন স্থানীয়রা।



বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে আনোয়ারার মানুষ রাজনৈতিক মতপার্থক্য, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। শনিবার বিকেলে স্থানীয় জনসাধারণের পক্ষ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে এ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার জন্য সমাবেশ আহ্বান করা হয়।

কিন্তু প্রশাসনের নির্দেশের কথা বলে স্থানীয় জনসাধারণের ডাকা এ সমাবেশে বাধা দেয় পুলিশ। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আনোয়ারা উপজেলার পারকি সমুদ্রসৈকত এলাকায় জড়ো হন কয়েক’শ প্রতিবাদী মানুষ। তারা সভা শুরু করার পূর্ব মুহূর্তে সেখানে হাজির হয় স্থানীয় কর্ণফুলী থানার এসআই আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে একদল পুলিশ।

সমাবেশ শুরুর কয়েক মিনিটের মাথায় পুলিশ ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট ফৌজুল আমিন চৌধুরী, আহ্বায়ক এম এ গফুরকে ডেকে তা বন্ধ করার হুকুম দেন।

এ সময় নেতৃবৃন্দ এর কারণ জানতে চাইলে তারা প্রশাসনের নির্দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে সমাবেশ বন্ধের কথা জানান। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হবে না বলে জানালেও সভা করতে না দেওয়ার ব্যাপারে পুলিশ অনড় থাকে।

পরে  বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা ছাড়াই ভূমি প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ লোকজন সভাস্থল ত্যাগ করেন।

ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক এম এ গফুর বাংলানিউজকে বলেন, ``আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে নই। আমরা চাই বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক। কিন্তু সাধারণ মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র আমরা চাই না। আমরা এ কথাটি বলার জন্য সভা ডেকেছিলাম। পুলিশ আমাদের সভ‍া করতে দেয়নি। আমরা ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে সমাবেশ করব। ``

কর্ণফুলী থানার এসআই আব্দুল হাই বাংলানিউজকে বলেন, ``আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সমাবেশ বন্ধ করে দিয়েছি। তারা আগে থেকে আমাদের জানালে, অনুমতি নিলে আমরা সমাবেশ করতে দিতাম। ``

জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে অনুমতির প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ``তাদের কমিটি আছে। কমিটির পক্ষ থেকে আমাদের অবহিত করা প্রয়োজন ছিল। তখন আমরা বাধা না দিয়ে বরং নিরাপত্তা দিতাম। ``

এদিকে সমাবেশস্থলের বাইরে এসে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আতংকিত ও ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন।

আবাসন কোম্পানি লুসাই প্রপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ কাইয়ূম শাহ বাংলানিউজকে জানান, তারা তাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে পারকি সমুদ্রসৈকত এলাকায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে পয়েন্ট নীলিমা নামে অত্যাধুনিক একটি রিসোর্ট নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। এজন্য এক কোটি ১৭ লাখ টাকা দিয়ে তিনি জমিও কিনেছেন। কিন্তু পিডিবির এক কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন, তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে।

তিনি বলেন, ``সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য রিসোর্ট বানানোর উদ্যোগ নেওয়া কি আমার অপরাধ? বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পুরো সমুদ্রসৈকত ধ্বংস হয়ে যাবে। পারকি বিচ আমাদের আনোয়ারার গর্ব, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। এটা হারিয়ে যাওয়া আর আমাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়া একই কথা। ``
এমএ গফুর বাংলানিউজকে জানান, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে আনোয়ারার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের কমপক্ষে দু’লাখ মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন হবে। তিনটি ইউনিয়ন হচ্ছে- বৈরাগ, বারশত এবং রায়পুর। এছাড়া ঝুঁকির মুখে থাকা গ্রামগুলো হচ্ছে- পরুয়াপাড়া, ফুলতলী, দুধকুমড়া, বোয়ালিয়া, চালিত্যাতলী, গোবাদিয়া, পশ্চিম তুলাতলী এবং পশ্চিম চাল।

বারাসাত ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহ জমির বাংলানিউজকে বলেন, ``সরকার বলছে, তারা খাস জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে। কিন্তু সেটা যদি আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করে তো সে বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে আমরা কি করব? সরকার লাখ লাখ অসহায় মানুষের কথা কি একবারও ভাববে না?``

আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফজলুল করিম চৌধুরী বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, ``বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে এখানে মৎস্য প্ল্যান্ট থাকবে না, ফসলি জমি থাকবে না। সৈকতের অস্তিত্বও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কেইপিজেড করে মানুষ অনেক ফসলি জমি হারিয়েছে। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র করলে মানুষ আবারও জমি হারাবে। মানুষকে পথে বসিয়ে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক আমরা চাই না। `` 

তিনি বলেন, ``আমরা এমপি আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সাহেবকে জানিয়ে দিয়েছি, এভাবে মানুষের ফসলি জমি, শিল্প কারখানার জমি দখল করে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে। ``

এমএ গফুর বাংলানিউজকে বলেন, ``বাঁশখালীতে শঙ্খ নদীর ধারে হাজার হাজার একর জমি পড়ে আছে। সরকার চাইলে সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে পারে। আমাদের ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কবরস্থানের দিকে কেন চোখ পড়ল সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। ``

বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১২
আরডিজি/সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;                                                জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর[email protected]

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।