ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

না.গঞ্জে আ.লীগ অফিসে হামলার ২১ বছর, মামলার ধীরগতিতে হতাশা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১১ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২২
না.গঞ্জে আ.লীগ অফিসে হামলার ২১ বছর, মামলার ধীরগতিতে হতাশা

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বর্বরোচিত বোমা হামলার ২১ বছরপূর্তি ১৬ জুন। ২০০১ সালের ১৬ জুন রাতে শহরের চাষাঢ়াস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে অবস্থিত ওই কার্যালয়ে বোমা হামলায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ২০ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।

আহত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানসহ আরও অনেকেই।

ওই সময় দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এ ঘটনার বিচার হয়নি গত ২১ বছরেও। এর মধ্যে গত ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায়। এ সরকারের ক্ষমতায় চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচারকাজে ধীরগতি হওয়ায় হতাহতদের স্বজনরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা পৃথক দুটি মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ১৩৮ জন। গত ২১ বছরে চাঞ্চল্যকর এই দুটি মামলায় ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই মামলায় ১৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছিল। আর গত ১ বছরে এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে মাত্র ৫ সাক্ষীর।

গত ১৪ বছর আওয়ামী লীগ টানা সরকারে থাকলেও চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেছেন সেদিনের হামলায় নিহতদের স্বজনরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালেই ওই ঘটনার বিচার দেখতে চান স্বজন হারা পরিবারগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৬ জুন বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার একটি হত্যা ও অপরটি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা। দুটি মামলার বাদী নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা। মামলাটি এখন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে বিচারাধীন।

ওই মামলার অন্যতম ভিকটিম নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান বলেন, নৃশংস এ ঘটনার ২১ বছর হয়ে গেল। কিন্তু বিচার পেলাম না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৭১ সালের ঘাতকদের বিচার করেছে, জাতীয় ৪ নেতার হত্যাকারীদের বিচার করেছেন। আমার বিশ্বাস তিনি ১৬ জুন বোমা হামলার বিচারও করবেন।

তিনি বলেন, ঘাতকরা সেদিনের সেই বোমা হামলা আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে করেছিল। আমার জন্যই নিরপরাধ ২০ জনের প্রাণ ঝরে গেছে। এজন্য আমি নিজেই অনুতপ্ত। নিহতদের স্বজনদের কাছে আমি এজন্য করোজোরে ক্ষমা চাই।

তিনি বলেন, এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দেখি ঘটনার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমি যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তা পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। এজন্য আমি আদালতে সাক্ষ্য না দিয়ে এ মামলার অধিকতর তদন্ত দাবি করেছি।

দেশজুড়ে আলোচিত এ সংসদ সদস্য আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। মাঝেমধ্যেই নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে। ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে তাদের গ্রেফতার করে। হলি আর্টিসানের মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আত্মগোপনে ছিল। জঙ্গিদের ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তেমন উদ্যোগী দেখা যায় না। সেজন্য তিনি নারায়ণগঞ্জে আরও যোগ্য ও চৌকস কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানান।  

সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আবদুর রহিম বলেন, হত্যা মামলায় ৫৬ জন এবং বিস্ফোরক মামলায় ৮২ জন সাক্ষী রয়েছেন। দুটি মামলায় মোট ২৩ জন সাক্ষী দিয়েছেন। তবে ওই ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী এবং ঘটনার ভিকটিম সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান এখনও সাক্ষ্য প্রদান করেননি। গত বছরের ২৩ মার্চ তার সাক্ষ্য প্রদানের কথা থাকলেও করোনার কারণে তার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি আদালতে উপস্থিত হয়ে ১৬ জুনের বোমা হামলার ঘটনার পুনঃতদন্ত দাবি করেন।

অ্যাডভোকেট আবদুর রহিম আরও বলেন, করোনার কারণে গত ২ বছর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ বিঘ্নিত হয়েছে। এখন আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে দ্রুত সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করা। আগামী ২৩ জুন এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে বলে জানান তিনি।

মামলার বাদী অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, গত ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালে আমাকে না জানিয়েই আদালতে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। আমরা এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হই এবং ২০০৮ সালের ১৭ আগস্ট উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২ মে ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়।

তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে গত ২ বছর আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আমরা আশা করি, এখন এ মামলার কার্যক্রমে গতি আসবে।

নিহতের স্বজন ও আহতরা যা বললেন

১৬ জুনের বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী। তার ছোট ভাই ও নাসিকের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না বলেন, অতীতে এই মামলাটি নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে মামলার চার্জশিট দেওয়ার পর বিচারের আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু গত ২১ বছরেও বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়েই হতাশ হয়ে পড়েছি। চার্জশিটভুক্ত ৬ জনই এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছেন তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। তারপরেও যদি বিচারকাজ শেষ হতো তাহলে নিহতদের আত্মা শান্তি পেতো। আমি নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছি।

সেদিনের ঘটনায় দুই পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য চন্দন শীল বলেন, সেদিনের ঘটনায় যেহেতু বেঁচে গেছি তাই বিচারটা দেখে যেতে চাই। আশা করি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বিমুখ করবেন না।

আসামি যারা এবং তাদের অবস্থান

সাত জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পর অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ২ মে ওই ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলায় ৬ জনকে আসামি করে অভিন্ন চার্জশিট প্রদান করেন। চার্জশিটে অভিযুক্তরা হলেন- হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, ফরিদপুরের ২ জমজ সহোদর আনিসুল মোরছালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন, নগরের উত্তর চাষাঢ়া এলাকার ওবায়দুল্লাহ রহমান, নাসিকের ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিএনপি নেতা শওকত হাশেম শকু ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতা শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল। আসামিদের মধ্যে ২০১৭ সালে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের অপর একটি মামলায় ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। জমজ ২ সহোদর আনিসুল মোরছালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন ভারতের দিল্লি কারাগারে বন্দি, ওবায়দুল্লাহ রহমান ও কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু জামিনে রয়েছেন। কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল।

সেই ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন

সেদিনের ঘটনায় নিহত হয়েছিল শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সরকারী তোলারাম কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদের সাবেক জিএস আকতার হোসেন ও তার ভাই সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এ বি এম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েতউল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২২
এমআরপি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।