ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

কাদের কথায় চলবে বাংলাদেশ?

সারওয়ার-ই আলম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০২০
কাদের কথায় চলবে বাংলাদেশ?

বাঙালি মুসলমানরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশে চান, নাকি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চান এটা নিয়ে আজ চলছে দ্বিধাবিভক্তি। ধর্মনিরপেক্ষতার যে মূলনীতির ওপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত সে নীতির আলোকে দেশ পরিচালিত হলে সেখানে শাসনতন্ত্রে কোনও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিফলন থাকার কথা নয়।

কারণ ধর্মীয় অনুশাসনসমূহ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে, আপামর জনগৌষ্ঠীকে নয়।

মুসলমানদের কোনো একটি ধর্মীয় অনুশাসনকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হলে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুশাসনকে কেন শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না সে প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়; যার সঠিক কোনও সুরাহা পাওয়া যায় না। আমরা প্রায়শ একটা সত্যকে ভুলে যাই, বাংলাদেশ শুধু মুসলমানদের দেশ নয়। এই দেশে অন্য সব ধর্মের নাগরিকদের সমান অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আজ সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি তুলে ধরে শাসনতন্ত্রে যদি ইসলামী অনুশাসনের নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা হবে একদিকে যেমন সংবিধানের মূলনীতির বরখেলাপ, অন্যদিকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি চরম বৈষম্য। একটি গণমুখী রাষ্ট্র তার জনগণের সঙ্গে এরকম কোনও বৈষম্যে অবতীর্ণ হলে সে রাষ্ট্রে মুসলমানগণ নিজেদেরকে সম্মানিত মনে করবেন একথা সত্য; কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীরা নিজেদেরকে যে অসহায় মনে করবেন সে সত্যটিও অস্বীকার করা যাবে না।

এরকম একটি দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি রাষ্ট্রের জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়। সংখ্যার বিচারে অধিকতর লঘু জনগোষ্ঠীর অনুভূতির মূল্য যে রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, সে রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অধরাই থেকে যায়। ফলশ্রুতিতে কিছু কাঠমোল্লা, তথাকথিত আলেম ও ফতোয়াবাজরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে সমর্থ হন। সমাজদেহের বিভেদটা এখানেই সৃষ্ট। এই সংকট থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে আজ প্রয়োজন মহা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমাদেরকে আজ এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে যে আমরা সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি উদার বাংলাদেশ চা। কোনও মুসলিম, হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ প্রজাতন্ত্র চাই না।

সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বাংলাদেশে কোনও একটি সম্প্রদায় যদি তাদের ধর্মীয় অনুশাসন মানতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে চায় তাহলে সে চেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে সাব্যস্ত করতে হবে এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহ করতে হবে। যদি তা করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় তাহলে বারবারই ধর্মের দোহাই দিয়ে নৈরাজ্য চলতেই থাকবে। জাতিগত প্রগতির পথে এসকল নৈরাজ্য বিরাট বাধা হয়ে অগ্রগতির পথরোধ করে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্ট হয়, সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য ভেঙে পড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে রাষ্ট্রটি একটি অকার্যকর রাষ্ট্র পরিণত হয়। কোও দেশপ্রেমিক নাগরিকই নিশ্চয় নিজ রাষ্ট্রে এরকম অচলাবস্থা কামনা করেন না।

অতিসম্প্রতি স্বাধীনতার স্থপতির ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে দেশে যে মারমুখী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে একটা বিষয়তো স্পষ্ট যে, ইসলামপন্থীরা মনে করছেন এই রাষ্ট্রটি শরীয়তবিরোধী কাজকে আস্কারা দিচ্ছে। এই বিশ্বাস থেকে তারা ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ প্রতিহত করতে প্রকাশ্যে সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। এখানে যে প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে এসে দাঁড়ায়, তাহলো-তাদের এই চ্যালেঞ্জ কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য হবে না? তাদের এই হুংকার কী শাসনতন্ত্রের প্রতিও চ্যালেঞ্জ নয়?

আজ জাতির জনকের ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে যেভাবে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে কাল যদি তাদেরকে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য সম্পর্কে একই ছবক দিয়ে এই দাবি তোলা হয়, যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব থাকতে পারবে না, তাহলে রাষ্ট্রের অবস্থান কী হবে তা আজ নির্ণয় করা খুবই জরুরি।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক, লন্ডন 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।