ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

অস্ট্রেলিয়ার জিম্মি নাটক, বাংলাদেশের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীলতা

নোমান শামীম ও ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪
অস্ট্রেলিয়ার জিম্মি নাটক, বাংলাদেশের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীলতা

গত ১৫ ডিসেম্বর (২০১৪) সিডনির মার্টিন প্লেসে সংঘটিত জিম্মি নাটক এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা এবং দেশপ্রেম সম্পর্কে আমাদেরকে অনেক কিছুই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সব মিডিয়া দায়িত্বশীলতা ও রাষ্ট্রের প্রতি পরিষ্কার আনুগত্য নিয়ে পেশাদারি রিপোর্টিং করে দেখিয়ে দিলো- 'যা ইচ্ছে বলা ও দেখানো' মানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নয়।



জিম্মি নাটক চলাকালেই মিডিয়ার কাছে জিম্মিকারীর ব্যক্তিগত তথ্য, পরিচয়, ছবি, ভিডিও এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত ছিল। এমনকি জিম্মিদের দিয়ে তার প্রধান তিনটি শর্তের ভিডিও ধারণ করে বারবার গণমাধ্যমের কাছে পাঠালেও গণমাধ্যম তা সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সময়মতো পৌছে দিয়েছে। কিন্তু সরকারের অনুমতি ছাড়া কিছুই প্রচার করেনি।

সম্প্রচার নীতিমালা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি সম্মানের কারণে অস্ট্রেলিয়ার কোনো মিডিয়াই প্রাপ্ত স্বাধীনতার সীমা লংঘন করে বিপদজনক স্বাধীনতা চর্চা করেনি। কিংবা বাংলাদেশের এক শ্রেণীর অতি উৎসুক মিডিয়ার মতো গুজব প্রচারে নির্লজ্জ উম্মাদনায় নামেনি। ব্রেকিং নিউজের নামে মিথ্যা খবর বানিয়ে,  আংশিক সত্য কিংবা সত্যের বিকৃতি ঘটিয়ে নিজ নিজ চ্যানেলের জন্য উদ্দেশ্যমূলক 'খবর উৎপাদন' করে জাতিকে আতঙ্কগ্রস্ত করেনি। যা একটি দেশের মিডিয়ার পরিপক্কতা,  পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে।

তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা রেখে পরিবেশন করাটাই মিডিয়ার কাজ। দেশ ও জাতির বৃহত্তর সার্থ রক্ষা করাও মিডিয়ার ভূমিকার মধ্যে পড়ে।

অস্ট্রেলিয়ার সব সংবাদ মাধ্যম অপেক্ষা করেছে জিম্মি নাটকের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত। তবে এটা নয় যে, তারা দেশবাসীকে জিম্মি ঘটনা সম্পর্কে আপডেট করেনি। তারা ক্রমাগত লাইভ আপডেট করেছে। কিন্তু সবসময় মাথায় রেখেছে, ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টরা যাতে খবর পরিবেশনার কারণে বিপদগ্রস্ত হয়ে না পড়েন। সরকারের সাথে মিডিয়ার যাতে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি না হয়, আইনের সাথে যাতে মিডিয়ার সংঘাত অনিবার্য্য হয়ে না পড়ে। বরং তারা দেশের জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে সরকারের সাথে সমন্নয় সাধন করেই সংবাদ প্রচার করেছে।    

জিম্মি নাটকের সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দেশটির সরকার, বিরোধীদল একই সুরে কথা বলেছে। খ্রিস্টান,  মুসলিম সব ধর্মীয় গোষ্ঠীই সরকারকে সমর্থন করেছে। দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের মতো সরকার বিরোধীদলকে কিংবা বিরোধীদল সরকারকে দোষারোপে ব্যস্ত হয়ে পড়েনি। কোনো দেশের দিকে কেউ ইঙ্গিত করে কথা বলেনি। এমনকি জিম্মি নাটকের অবসানের পর অপরাধীর সাথে কোনো রাজনীতিবিদের সুসম্পর্কও কেউ আবিস্কার করেনি। কিংবা ফটোশপের মাধ্যমে ছবি তৈরি করে কেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়নি। যদিও জিম্মি নাটকের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ান কর্তৃপক্ষ ফেসবুক,  ট্যুইটার নিয়ন্ত্রণে নজিরবিহীন সক্ষমতা দেখিয়েছে এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, কেউ যাতে কোনো ধরনের নেতিবাচক বার্তা প্রচার করতে না পারে।

দায়িত্বহীন রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক কথা-বার্তা অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমে একবারের বেশী দুইবার আসে না। প্রমাণিত ও ঐতিহাসিক সত্যের বাইরে কোনো কিছু এই দেশের মিডিয়া এন্টারটেইন করে না, করলে সে জন্য সম্পাদককে পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হয় এবং দোষী হলে জেল-জরিমানাও অনিবার্য্য। বাংলাদেশে মিডিয়ার জন্য এই কথাটি কি প্রযোজ্য নয়?

বাংলাদেশে মিডিয়া ও সম্পাদকরা আইনের উর্ধে উঠে যাওয়া একটি শ্রেণীর মতো কর্মকাণ্ড করতে পছন্দ করে। হরহামেশাই সামন্ত মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়। অনেক সময়ই খবরের পেছনের খবর হচ্ছে- আর্থিক কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা। যে কোনো বড় খবরের ব্যাপারে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের উম্মাদনা, সব-কিছু এবং কখনো কখনো অনেক কিছুই দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ভাবে বলে ফেলাটা মিডিয়ার একটি অসাংবাদিকসুলভ কুঅভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। পরিশীলতা ও সত্য নির্ভর সংবাদ পরিবেশন আস্তে আস্তে কদাচিৎ চর্চায় পরিণত হয়েছে।  

সম্প্রতি লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশি এক শীর্ষ নেতা যেসব কথা উচ্চারণ করেছেন,  অস্ট্রেলিয়ার কোনো রাজিনীতিবিদ এমন কথা উচ্চারণ করলে কোনো মিডিয়ায় তা দ্বিতীয়বারের মতো আসতো না। অথবা ঐতিহাসিক তথ্যের বাইরে কোনো উল্টা-পাল্টা নিউজ করে বক্তার মতো নিজেকে হাস্যকর করে তোলার মতো বোকামিও তারা করতো না। সবচেয়ে নির্ভরতার ব্যাপার হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়ার জনগণও এ ধরনের বিকৃত তথ্যের জন্য সরকারের কাছে আশ্রয় চাইতো বা তথ্য বিকৃতিকারীর বিরুদ্ধে নিজেরাই দাঁড়িয়ে পড়তো।

নব্বই ও গত দশকের গোড়ার দিকে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের উগ্রপন্থি রাজনীতিবিদ পলিন হ্যানসন তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে 'উগ্র অস্ট্রেলিয়ান' উম্মাদনা ছড়িয়ে দিলে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াই তাঁকে হাসির খোরাকে পরিণত করে তুলেছিল। কারণ তখন এই দেশের মিডিয়া এই ব্যাপারটি পরিষ্কার বিবেচনায় নিয়েছিল, পলিন হ্যানসনের এই উম্মাদ কথায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে অস্ট্রেলিয়া নামক দেশটির ভাবমূর্তি।   

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় আন্দোলন দানা বেঁধেছিলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা সেই গণ-জাগরণকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এক শ্রেণীর সংবাদ মাধ্যম জনগণকে আস্তিক-নাস্তিকে বিভক্ত করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছিল। ফলে অনেকের জানমাল বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল,  অপমানিত হয়েছিলো লক্ষ-কোটি সাধারণ মানুষ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টির অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে কয়েকজন মুক্তমনা মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। অথচ অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগুরু দেশে একজন ইরানি বংশোদ্ভূত মুসলিম জঙ্গি ৩০/৪০ জন মানুষকে ১৭ ঘণ্টা জিম্মি করে রেখেছিল। দুইজন জিম্মি প্রাণ হারিয়েছে,  আরো ৪/৫ জনের অবস্থা আশংকাজনক।

সমগ্র অস্ট্রেলিয়ার মানুষ এক মুহূর্তের জন্যও টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ সরায় নি। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলায় যার যার মতো করে জিম্মিদের জন্য প্রার্থনা করেছে। কিন্তু কোনো খ্রিস্টান একজন মুসলিমকেও আক্রমণ করেনি। কোনো মুসলিমের বাড়ি-ঘরে, মসজিদে হামলা চালায় নি। লুটপাট হয়নি, কাউকে ধর্ষণ করেনি। কেউ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। সংবাদ মাধ্যমগুলো কোনো ধরনের উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচার করেনি কিংবা সেরকম কোনো রুচির পরিচয় দেবার ধৃষ্টতাও দেখায়নি।

কিন্তু ২০১৩ সালে গণজাগরণ নিয়ে বাংলাদেশের কতিপয় সংবাদ মাধ্যম যে স্বেচ্ছাচারিতা করেছে, পশ্চিমা দেশে কখনোই তা হতো না। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো যে,  জঘন্যতম একটি হলুদ সাংবাদপত্রের দুর্নীতিগ্রস্ত সম্পাদকের পক্ষে যেভাবে কতিপয় সম্পাদক কলম ধরেছিলেন,  বিবৃতি দিয়ে অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ছিলো চিন্তারও অতীত। যা পশ্চিমা কোনো দেশে কখনোই সম্ভব ছিলো না। বরং তাঁদের ওই কলম ধরা প্রমাণ করে দেয়, অনৈতিক কাজের সাথে অন্যান্য সম্পাদকরাও কোনো না কোনো গোষ্ঠীগত স্বার্থে জড়িত। এ ধরনের অপকর্ম অস্ট্রেলিয়া সরকার উল্লেখযোগ্যভাবে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করত, বিন্দুমাত্র ছাড় দিতো না।   
মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে অন্যের মতামতকে পরাধীন করা নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে অন্যকে সম্মান করে নিজের মত প্রকাশের অধিকার। মিডিয়ার দায়িত্ব অনেক,  সেটা বাংলাদেশের বর্ধনশীল এই ইন্ডাস্ট্রিকে বুঝতে হবে। এর যেমন ভবিষ্যৎ আছে, তেমনি আছে সেই ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক স্বার্থের উপর অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক হিসাব-নিকাশ খেলা করে। সেটাও আমাদের বুঝতে হবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে- আমাদের অর্জন যেমন কঠিন, বিসর্জন তেমন সহজ। সরকার ও সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্বশীলতা ও স্বাধীনতার বাধ্যবাধকতার মধ্যে আমরা বেড়ে উঠি,  শক্তি সঞ্চয় করি এবং স্বপ্ন দেখি।

লেখকঃ নোমান শামীম, সম্পাদক, মাসিক মুক্তমঞ্চ, অস্ট্রেলিয়া। ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।