ঢাকা, রবিবার, ২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ জুন ২০২৪, ০৮ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

পাপন, আকরামের পদত্যাগ নয় কেন?

ড. জিনিয়া জাহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৬ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৪
পাপন, আকরামের পদত্যাগ নয় কেন? সাকিব-আল-হাসান

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন সম্প্রতি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে সাকিব-আল-হাসানের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগের রায় দিয়েছেন।
 
সাংবাদিকদের কাছে পাপনের ভাষ্য হলো যে, সাকিবের নাকি মারাত্মক আচরণগত সমস্যা আছে! সাকিবের আচরণগত সমস্যা নাকি এমনই যে, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমনটা কেউ কখনো দেখেনি।

পাপনের কাছে আমরা জানতে চাই, কি এমন আচরণগত সমস্যা যার কারণে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়টিকে ঘণ্টাখানেকের মিটিং শেষে ছয় মাসের জন্য জাতীয় দলে এবং দেড় বছরের জন্য আন্তর্জাতিক লীগে নিষিদ্ধ করা হলো?
 
আমরা জানতে চাই, সাকিবের সেই আচরণগত সমস্যাগুলো কি ক্রিকেটীয় সমস্যা? নাকি ত্যালত্যালে (তেলতেলে) মুখ নিয়ে হাত কচলে হুজুর-হুজুর করেনি সেই আচরণগত সমস্যা?

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে জনাব পাপন কতদিন ধরে জড়িত? আর কে না জানে, পাপন নামক কোন খেলোয়াড় কোনদিন বাংলাদেশ টিমে না খেলেও বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়েছে শুধু স্বজনপ্রীতির কারণে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে যেই সাকিবের আচরণের উদাহরণ টানা হচ্ছে, আসল সত্য হলো এই যে, দীর্ঘদিন আইসিসির টপ অলরাউন্ডার থাকার কৃতিত্ব শুধু সাকিবই করে দেখিয়েছে যা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে কেউ কখনই করে দেখাতে পারেননি।

পাপন সাহেবের মতে, সাকিবের কারণে নাকি অন্য ক্রিকেটাররাও বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে! এর জন্য নাকি সাকিবের শাস্তি প্রাপ্য। প্রশ্ন হলো, সাকিবের কারণে তো অন্য ক্রিকেটাররা খুব ভালও করছে, তাহলে সাকিবের সেই কৃতিত্ব কেন বিবেচনায় আনা হবে না? 

পাপন বললেন যে, তিনি অভিযোগ বিস্তারিত বলতে চান না। কিন্তু আমরা ক্রিকেটপ্রেমীরা এত সহজে ছেড়ে দেব না। আমরা সাকিবের বিরুদ্ধে আপনাদের আনীত সব অভিযোগ বিস্তারিত জানতে চাই। এমন কি কোচের সাথে, আকরাম খানের সাথে, টেলিফোনে সাকিবের যে কথোপকথন হয়েছে তার বিস্তারিত অডিও শুনতে চাই। কোন কথার প্রেক্ষিতে সাকিব কি অবস্থায় দলে খেলতে না চাওয়ার কথা বলতে পারে আমরাও তা জানতে চাই। নুর হোসেনের কথোপকথন যদি জাতি জানতে পারে, তবে সংশ্লিষ্ট মহলের সদিচ্ছা থাকলে সাকিবের সাথে অন্যান্যদের কথোপকথনও জাতি শুনতে পারবে। প্রযুক্তির এই উন্নয়নের যুগে এটা এমন কোন অসম্ভব ব্যাপার নিশ্চয় নয়।
 
সম্প্রতি সাকিব তার বউকে বখাটেদের দ্বারা নাজেহাল করা নিয়ে যে বাক-বিতণ্ডা বা মারামারিতে লিপ্ত হয়েছিল বলে পাপন অভিযোগ করলেন, সে ঘটনার জন্য কি সাকিব বোর্ডের কাছে জবাবদিহি করেনি? করেছিল। তবে সেসময় তাকে শাস্তি না দিয়ে এখন কেন দেয়া হলো?

প্রশ্ন হলো, বখাটেদের হাত থেকে স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য ড্রেসিং রুম ছেড়ে গিয়ে সাকিব আদৌ কি কোন অপরাধ করেছে? সাকিব খেলোয়াড় হয়েছে জন্য কি নীরবে বউয়ের অপমান হজম করে যাবে? শৃঙ্খলার কথা বলে যদি আপনজনকে দুর্বৃত্তের হাত থেকে রক্ষা করাই না যায়, তাহলে সেই শৃঙ্খলা মেনে কি হবে? আত্মরক্ষা করার জন্য তো খুন করাও যায়। তাহলে সাকিব বখাটেকে পিটিয়ে ভুলটা করলো কোথায়? ড্রেসিংরুমে বসে যখন সে জানতে পারছে প্রভাবশালী ধনীর বখাটেরা স্ত্রীকে উত্যক্ত করছে, তখনও কি সাকিবের উচিত ড্রেসিং রুমে চুপচাপ বসে থাকা? সুশিক্ষায় শিক্ষিত কোন পুরুষ কি পারবেন চুপচাপ বসে থাকতে যখন জানবেন যে আপনার বোন, মা কিংবা স্ত্রী অন্যদের দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আপনার কাছে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাচ্ছে?

এরপর আসি নব নিযুক্ত কোচ চান্দিকা হাথুরাসিংহের অভিযোগের কথায়। মাত্র কিছুদিন আগে দলের সাথে যুক্ত হয়ে কুশল বিনিময় করতে না করতেই খেলোয়াড়দের সাথে বাক-বিতণ্ডায় তিনি জড়িয়ে পড়বেনই বা কেন? আর খেলোয়াড়দের সাথে কথা না বলেই তিনি সরাসরি বোর্ডের প্রেসিডেন্টকেই বা নালিশ করতে গেলেন কেন? এটা কি কোচের আচরণগত সমস্যা নয়? তার পেশাদারিত্বের ঘাটতি নয়? বোঝা যাচ্ছে নতুন কোচ আগের কোচদের তুলনায় ভিন্ন। তিনি প্রথমে এসেই খেলোয়াড়দের পাশে না থেকে বোর্ডের তোষামোদ ও খেদমতগিরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের কী উন্নয়ন হবে জানি না, তবে তার যে বাংলাদেশের মাটিতে ভবিষ্যত উজ্জ্বল তা বলা বাহুল্য।

বাংলাদেশের যত বিদেশী কোচ নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তারা সবাই মেয়াদ শেষ হবার আগে কিংবা মেয়াদ পূর্ণ হবার পরে বোর্ডের অযাচিত হস্তক্ষেপের উপর অভিযোগ করে গিয়েছেন। বোর্ডের নোংরা রাজনীতির কারণে স্বাভাবিকভাবে কোচের দায়িত্ব পালন যে সম্ভব ছিল না, অনেক কোচ খোলামেলাভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে অভিযোগ করেছেন। তখন ক্রিকেট বোর্ড কেন নিজেদের বিপক্ষের সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করেননি? তখন কোথায় ছিল ক্রিকেটীয় আইন-কানুন-শৃঙ্খলা?

এরপর আসি আকরাম খানের কথায়। তিনি কেন সাকিবকে ভুল পথে পরিচালনা করলেন? কেন আকরাম খান সাকিবকে মৌখিক অনুমতি দিয়েই চলে যেতে বললেন? তিনি কি বোর্ডের নিয়মের কথা জানেন না? ‘ড্যাম কেয়ার’ আচরণে যদি সাকিব অভিযুক্ত হয়ে থাকে তবে নিয়মের তোয়াক্কা না করে সাকিবকে মৌখিক অনুমতি দিয়ে আকরাম খানও কি ‘ড্যাম কেয়ার’ আচরণে অভিযুক্ত নয়? বিভিন্ন সময়ে আকরাম খানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের শাস্তি কী আমরা তাও জানতে চাই।

দলের ধারাবাহিক বাজে পারফরম্যান্সের দায়-দায়িত্ব কেন একা সাকিবকেই নিতে হবে? অন্য খেলোয়াড়েরা, কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট এমনকি জনাব পাপনসহ বাকি সদস্যরা নয় কেন? টিমওয়ার্ক খুঁজে না পাওয়ার অভিযোগে কেন একা সাকিব অভিযুক্ত হবে? তবে কেন দলের অধিনায়ক মুশফিকসহ অন্যরা সাকিব টিমে না থাকলে বিমর্ষ ও অসহায় বোধ করে? 
 
ক্রিকেট বোর্ড যদি সত্যি বাংলাদেশের ক্রিকেটের মঙ্গল চাইত তবে বিশ্বকাপ শুরুর আগে দেশের সব থেকে প্রতিভাধর, সফল খেলোয়াড়কে এভাবে ধ্বংস করার খেলায় মত্ত হত না। যে অপরাধগুলোর শাস্তি সাকিব অলরেডি ম্যাচে নিষিদ্ধ হওয়া থেকে শুরু করে জরিমানা, ক্ষমা চাওয়াসহ ভোগ করেছে, সেই পুরাতন অপরাধগুলো কেন নতুন করে আমলে এনে তাকে নিষিদ্ধ করা হলো এর জবাবদিহি ক্রিকেটবোর্ডকে দিতেই হবে। আর এত তাড়াহুড়া  করে কঠোর শাস্তি দিয়ে কি এমন বীর পালোয়ানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন পাপন? বরং স্বেচ্ছাচারীতার চূড়ান্ত উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি।
 
মাঠে ক্রিকেট খেলে কারা? বিসিবি নাকি ক্রিকেটারেরা? আমরা মাঠে বসে খেলা দেখি সাকিবদের। মাঠের বাইরে বোর্ডের নোংরা রাজনীতির খেলা আমরা দেখতে চাই না।
 
শাস্তি দেবার নাম করে সাকিবের ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হিংস্র ষড়যন্ত্র আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। আমরা অনতিবিলম্বে সাকিবের উপর থেকে সব রকম নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেবার জোর দাবি জানাই এবং কোনোরকম সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই সাকিব তথা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ধ্বংসের অভিযোগে পাপন, আকরামের পদত্যাগ চাই।

ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

বাংলাদেশ সময়: ১২০৯ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।