ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপন্যাস

নীল উড়াল: পঞ্চবিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭
নীল উড়াল: পঞ্চবিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

২৫.
শ্রাবণের মাঝামাঝি। স্থলবন্দর বেনাপোল থেকে দক্ষিণমুখো কাঁচা রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছি; আমি, সঙ্গে এনামুল।

দৌলতপুর-পুটখালী গ্রামের মাঝামাঝি। রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা। দু’পাশে খানাখন্দ পানিতে টইটুম্বুর। আকাশে ভারী মেঘ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও পড়ছে। পথচলতি লোকেদের কেউ কেউ ছাতা খুলে মেলে ধরেছেন। সন্ধ্যা ছুঁই-ছুঁই। মনে হচ্ছে অধিকাংশই ঘরমুখো। যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি তার নাম ‘বালির মাঠ’। ডানে কয়েক শ গজ দূরে নদী-ইছামতি। তারপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। বলা যায় নদীটিই দু’ দেশের নো-ম্যান্স ল্যান্ড।

নীল উড়াল: চতুর্বিংশ পর্ব

অনেকক্ষণ চুপ আছে এনামুল।   কথা বলছে না। বেশ গম্ভীর। অধুনা সে আমার সঙ্গে যথেষ্ট গাম্ভীর্য বজায় রাখছে। যদিও এবারের সীমান্ত সফরের পুরো আয়োজন তার। আমি নীরব পর্যবেক্ষক। এনামুল আমাকে পাহারায় রাখতে নিজেই চলে এসেছে। জানি, সে আমাকে ভুল তথ্য দেবে। কিংবা বিভ্রান্ত করবে। আমার দৃষ্টি নিয়ে যাবে ভুল পথে। মাদকের বদলে সার, মিষ্টি বা কসমেটিক পাচারের চিত্র দেখিয়ে আনতেও পারে। আমাকে দেখতে হবে নিজের গরজে। পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য আলাপের সুযোগ খুঁজছি। হঠাৎ পেয়েও গেলাম। ওর দিকে চেয়ে জানতে চাইলাম:
-ব্যতিক্রমী কোনও দৃশ্য কি দেখতে পাচ্ছিস?

এনামুল অত খেয়াল করছে না। নতুন জায়গায় প্রকৃতি ও পরিবেশ আঁচ করাই যেন ওর একমাত্র উদ্দেশ্য। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী এনামুলকে এখন মনে হচ্ছে একজন সাচ্চা পরিবেশ পর্যবেক্ষক। আমার কথায় এনামুল ভালো করে লক্ষ্য করে। চোখ মেলে তাকায় চারপাশে। বাহ! আসলেই তো বেশ অভিনব ব্যাপার! বাংলাদেশ থেকে একদল লোক সারিবদ্ধভাবে ইছামতি নদীর দিকে যাচ্ছে। মাথায় বড় বড় বোঝা। কারও কারও পিঠে। তবে আকারে ছোট। পরনের লুঙ্গি উঠিয়ে বাঁধা। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা।

এখান থেকে খানিক দূর এগুতেই চোখে পড়ল আরও একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য। কাউকেই আর কিছু বলে দিতে হলো না। দু’জনেই লক্ষ্য করি, রাস্তার পাশে যে সামান্য ঘাসের রাস্তা তার ওপর দিয়ে এক যুবক ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে একটি নতুন চকচকে হিরো হোন্ডা।

এরপর আর এগুতে পারলাম না। মুঘলধারে বৃষ্টি নেমেছে। দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম সামনের একটি ছোট চালা ঘরে। আমাদের আসার আওয়াজ শুনে ঘরের ভিতর থেকে একজন সন্দিগ্ধ গলায় জানতে চাইলো:
-আপনারা কারা?
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে যে লোকটি প্রশ্ন করল, সে-ই সম্ভবত গৃহকর্তা। এখনও তার মুখ দেখতে পারি নি। সে কথা বলছে চালা ঘরের ভেতর থেকে। আমি কিছু বলার আগেই এনামুল উত্তর দিল:
-আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। পাশেই আত্মীয় বাড়ি যাব। বৃষ্টির জন্য আটকে গেলাম।
ঘরের ভেতর থেকে একই রকম সন্দেহ মাখা কণ্ঠস্বর শোনা গেলো:
-পুলিশের লোক না তো?
এবার এনামুল কিছু বলার আগেই আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলি:
-না না। তাহলে হুমকি দিতাম দরজা খোলার জন্য। আমরা কি সেটা করেছি?

আমার উত্তরে কাজ হলো। আস্তে আস্তে চালার বাঁশের পাল্লা সরে গেল। ততক্ষণে আমাদের প্যান্টের নীচের অংশ ভিজে চুপসে গেছে। একটি মাথা ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে আমাদের ডাকছে:
-আসুন। ভেতরে আসুন।

বসত ঘর নয়। আবার দোকান ঘরও নয়। বসবার আর মাল গুদাম করার ব্যবস্থা রয়েছে ঘরটিতে। কুপির মৃদ্যু আলোয় দেখা গেল পুরো ঘরে নানা জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। মাঝখানে একটা লম্বা বেঞ্চি। ওখানেই আমাদের বসতে দিলেন গৃহকর্তা। পাশে আরও দু’জন মাঝ বয়েসী লোক বসে আছে। তাদের একজন গৃহকর্তার দিকে তাকিয়ে বলল:
-না না আবদুস সাত্তার, এরা পুলিশের লোক না। পুলিশের লোকের শরীর এমন আরাম-মার্কা হয় না।
গৃহকর্তা, যার নাম আবদুস সাত্তার মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বলল:
-ঠিকই কইছস মণ্ডল। আর পুলিশ আইব কোত্থেকে? নেতা তাগোরে সামলাইয়া রাখছে না। কি কস কাশেম?

তৃতীয় ব্যক্তি, যার নাম জানা গেল কাশেম, সে-ও সম্মতির মাথা ঝাঁকাল।
ওদের আলাপের আলাপে নাম জানা হয়ে গেল। এখন কথা জমাতে অসুবিধা হবে না। এনামুল একই রকম গম্ভীর। আমিই সুযোগ তৈরির চেষ্টা করে বলি:
-সাত্তার মিয়া। একেবারে তো ভিজে গেলাম। চা-টা কিছু করা যাবে ভাই?
লোকগুলো আমাদের নিয়ে এরই মাঝে নিরুদ্বিগ্ন হয়েছে। গৃহকর্তা জবাব দিল:
-বসেন বসেন। ব্যবস্থা হবে। কাশেম দেখ তো কি করা যায়।

কাশেম নামের লোকটি ঘরের কোণের দিকে উঠে গেল। এই সুযোগে আমি কিছু জানি না এমন ভাব করে কৌতুহলবশত তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করি:
-ভর সন্ধ্যায় নদীর দিকে লোকগুলো লাইন ধরে মাথায় বোঝা নিয়ে কোথায় গেল?
কোনও রাখঢাক না করেই একজন উত্তর দিল:
-মনে হয় বাংলাদেশে থাকেন না? যেন কিছুই জানেন না! ওরা চোরাকারবারী। আশপাশের গ্রামেই এদের বাড়ি। এখানে এটাই সবার ব্যবসা।
আব্দুস সাত্তার গলা নামিয়ে বলল:
-এই যে এখানে বসে আছেন। এটি একটি মালের আড়ৎ। এমন শত শত ঘর আছে যেখানে পারাপারের আগে মাল রাখা হয়। ওপারের মাল এসে প্রথমে এসব ঘরেই জমা হয়। এপারের মালও এখান থেকেই যায়। আমরা লিস্ট ধরে যার মাল তার কাছে পৌঁছে দিই।
আমি নিরীহভাবে জানতে চাই:
-থানা-পুলিশ আসে না?
কালক্ষেপণ না করেই একজন উত্তর দিল:
-আসে। মাসোয়ারা নিয়ে যেতে আর আমাদের সুযোগ-সুবিধা দেখতে।
আব্দুস সাত্তার আরও যোগ করল:
-আমাদের টাকার অংশ ঢাকা পর্যন্ত যায়। খুবই নিরাপদে ব্যবসা করি।

‘ব্যবসা!’ কষ্ট করে হাসি থামালাম। চোরাকারবারের মতো একটি জঘন্য অপরাধ এখানে ‘নিরাপদ ব্যবসা’। এদিকে বৃষ্টি থেমে গেছে। আমাদের আরও সামনে এগুতে হবে। যতটুকু গভীরে যাওয়া যায় যেতে হবে। ধন্যবাদ দিয়ে বের হলাম। এবার গন্তব্য খলসী নামে একটি অজ গ্রাম। সেখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হয়ে গেল। আগেই ঠিক করা ছিল এয়াকুব মেম্বারের বাড়িতে উঠব। এনামুলই সব ব্যবস্থা পাকা করেছে। মেম্বার দরাজ গলায় আমাদেরকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ করলেন। আয়োজনও বেশ ভালই টের পেলাম। উন্নত খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে ভেতরের রান্নাঘর থেকে। আমাদের আগমনে ছোট রকমের উৎসবের আমেজ। বাড়ি ভর্তি মানুষ। খাওয়ার আগে কয়েক জনের সঙ্গে আলাদা কথা বললাম। এনামুল আঁড় চোখে পাহারা দিয়েছে সর্বদাই। এয়াকুব মেম্বার এনামুলকে খাতির-যত্ন করতে এমনভাবে পিছে লেগে আছে যে, আমি বিনা বাধায় আলাপের কাজ চালিয়ে গেলাম।

খলশী যশোর জেলার শার্শা থানার পুটখালী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। বাংলাদেশ ও ভারতকে যে ইছামতি নদী বিভক্ত করেছে, তার গা ঘেঁষে এই গ্রাম। বেনাপোল বন্দর থেকে দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। একেবারে অজ পাড়াগাঁ। এই গ্রামের পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি গ্রাম-পুটখালী, রাজগঞ্জ, বারোপোতা, পাঁচ ভূলোট ও অগ্র ভূলোট। সব কটি গ্রামই ইছামতি নদীর গা ঘেঁষে। মেম্বারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, চোরাচালান যেন কোনও অপরাধ নয়।
প্রকাশ্যেই হচ্ছে সব কিছু। স্ত্রী দেখছে তার স্বামী চোরাকারবারের মালামাল বাড়িতে এনে রাখছে। ছেলে-মেয়ে দেখছে, তার বাবা চোরাচালানের ‘ঘাটে‘ দালালি করছে। আবার বাবা দেখছে তার ছেলে ‘ধুড়’ পাচার করছে। এ দৃশ্য নিত্য দিনের। চোরাকারবারীরা যে দেশ ও সমাজের শত্রু সীমান্ত এলাকায় তা বোঝার উপায় নেই। নেই কোনও সামাজিক, প্রশাসনিক প্রতিরোধও। পুরো পরিবেশ-পরিস্থিতিই চোরাচালানের অনুকূল। এখানে চোরাকারবার আর দশটি পেশার মতোই একটি পেশা মাত্র। এর বিরুদ্ধে কথা বলাও যেন নিয়মের বাইরে কথা বলা। চোরাকারবারের সঙ্গে থাকাই এখনকার নিয়ম। মনে পড়ল সাংবাদিক শামীমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য: সীমান্ত এলাকায় বছরে কমপক্ষে ১০/১৫ জন সাংবাদিক স্মাগলারদের বিরুদ্ধে বিপোর্ট করার জন্য প্রাণ হারায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নির্যাতন হয় নানা ধরনের গড ফাদার ও স্মাগলারদের হাতেই।  

মেম্বারকে একলা পেয়ে আমি এক ফাঁকে কাছে ডাকি:
-এয়াকুব সাহেব, একটু এদিকে আসেন।
আমার ডাকে ভিড়ের মাঝ থেকে মেম্বার আমার পাশে চলে আসেন। পনের-কুড়িটি চেয়ার লম্বালম্বি পাতা মেম্বর বাড়ির উঠোনে। আমি আর এনামুল দুই প্রান্তে বসা। মেম্বার প্রান্ত বদল করে আমার পাশে এসে জিজ্ঞেস করলেন:
-জ্বি ভাইজান, বলেন।
আমি অজ্ঞের মতো জানতে চাই:
-বাই ‘ঘাট’ ‘ঘাট’ করছে। ‘ঘাট’ কি?
এয়াকুব মেম্বার যা বললেন, তার সরল অর্থ এই রকম: চোরাকারবারীরা ‘ঘাট’ শব্দটি প্রচলিত অর্থে প্রকাশ না করে ভিন্নার্থে ও প্রতীকী ভাবে ব্যবহার করে। যেখান দিয়ে তারা চোরাচালানের পণ্য আনা-নেওয়া করে, সে জায়গাগুলোকেই তারা ‘ঘাট’ বলে। প্রতিটি সীমান্ত এলাকায় আছে বহু ‘ঘাট’। ‘সিন্ডিকেট’ হচ্ছে চোরাচালান ব্যবস্থাপনাকারী ব্যক্তিবর্গের সংঘ। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সিন্ডিকেটের বিস্তৃতি। যে ঘাট দিয়েই মাল আনা-নেওয়া করা হোক না কেন, তা অবশ্যই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই হতে হবে। সিন্ডিকেট সীমান্তের ঘাট থেকে ঢাকার ঘাট পর্যন্ত নিষিদ্ধ মাল বিপণন করে। এ কাজে লোকাল গুণ্ডা থেকে ক্ষমতার পাণ্ডা পর্যন্ত জড়িত।

এনামুল শুনতে না-পায় মত করে এয়াকুব মেম্বার চুপি চুপি বলেন:
-স্থানীয় প্রভাবশালীরা এখানে সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। ঢাকায় করে বড় কর্তারা। জায়গায় জায়গায় কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে কত হিস্যা দিতে হবে, সেটাও আগে থেকে ঠিক করা আছে। কোনও ঝুট-ঝামেলাই। গায়েবি পাহারায় মাল ডেলিভারি হয়ে যায়। সিন্ডিকেটের ছাড়পত্র পাসপোর্টের মতো কাজ করে। সব গোপন দরজা চিচিং ফাঁক।

এনামুল কি আমার ব্যাপারে এয়াকুব মেম্বারকে সতর্ক করে নি? নাকি এয়াকুব মেম্বাররা এতটাই বেপরোয়া যে কাউকে কেয়ার করার প্রয়োজনই বোধ করে না। আমি মনে মনে বেশ অবাক হয়ে এয়াকুব মেম্বারের কথা শুনছি:
-সিন্ডিকেট পরিচালনা যথেষ্ট লাভজনক হলেও ক্ষেত্র বিশেষে ঝুঁকিপূর্ণও। চোরাকারবারে একাধিক গ্রুপ ও সিন্ডিকেট আছে। এদের মধ্যে সমন্বয় ও সমঝোতা রাখতে হয়। নইলে রক্তপাত ও অস্ত্রবাজি শুরু হয়ে যায়।

আরও জানা গেল, ঘাট থেকে মাল ওঠার পর পরই তা লুকিয়ে রাখা হয় নির্দিষ্ট স্থানে। তারপর সেগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহীর নির্ধারিত স্থানে পাঠানো হয়। আগেই লাইন ক্লিয়ারের সঙ্কেত জেনে মাল পথে নামায় সিন্ডিকেট। কখনও লোক দেখানোর জন্য কিছু মাল ধরাও হয়। যেগুলোর খালি কার্টুন পুড়িয়ে ছবি তুলে পত্রিকায় দিয়ে আবার আসল মাল সিন্ডিকেটের কাছেই পৌঁছে দেওয়া হয়। সব খানেই নিজেদের লোক বসিয়ে রাখায় নির্বিঘ্নে চলছে কাজকর্ম। ফলে সব কিছু চলে সাজানো নাটকের মতো।

আরেকজনের কথায় পাশ ফিরে তাকালাম:
-ভাইসাব কলম আছে?
যে লোকটি কলম খুঁজছে, সে এই মাত্র মেম্বারের বাড়ির উঠানে এসেছে। ঢুকার মুখে আমাকে পেয়ে তার প্রয়োজনের কথা জানিয়েছে। তার কলমের খুব দরকার। আমি আলগোছে তাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে সরে আসি। এয়াকুব মেম্বার ততক্ষণে এনামুলের দিকে গিয়ে ভিড়েছে। জটলার আড়াল থেকে আগুন্তুকের কাঁধে হাত রেখে আমার চট করে সটকে যাওয়া কেউ লক্ষ্য করেছে বলে মনে হলো না। দেখে থাকলেও ভাববে, আশেপাশেই আছে। আমি আগুন্তককে দরদ মাখা গলায় প্রশ্ন করি:
-কলম কেন ভাই?
কলম সূত্রে তার কাছ থেকে অদ্ভুত বিবরণ পাওয়া গেল। সে নিজের নাম জানালো আজমত। একটি ঘাটের দায়িত্বে আছে। এই মাত্র বিরাট একটা চালান তার ঘাটে এসেছে। তাকে বলা হয়েছে, পুরো মাসের লেন-দেনের বিবরণ ‘ঢাকার স্যার’কে রাতের মধ্যেই দিতে হবে। এ অঞ্চলের সব ঘাটকে বিবরণ তৈরি করে জরুরি ভিত্তিতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তার কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে। তার এখন যেভাবেই হোক একটি কলম দরকার।
আমি আজমতের দুরূহ দায়িত্বের কথা শুনে আমার কলম ছাড়াও আরও একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলাম। তাকে বললাম:
-আপনার কাজে আমি হেল্প করতে পারি।
আশা ছিল চোরাচালানের খতিয়ানগুলো দেখার দুর্লভ অভিজ্ঞতা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার এক অবিশ্বাস্য সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু কি ভেবে যেন আজমল এ ব্যাপারে সতর্ক থাকলো। সে আমার কলমটা নিলো। কিন্তু আমাকে নিলো না। কাজটা একাই সম্পন্ন করার জন্য সে চলে গেলো ঊর্ধ্বশ্বাসে।

আমি বিমূঢ় হয়ে আজমলের প্রস্থান পথের দিকে চেয়ে আছি। দেখে তাকে ভালো লোক বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু অবলীলায় চোরাকারবারে সঙ্গ দিচ্ছে। তার জীবিকার-কর্ম আর জীবনের-ধর্ম দু রকম হলেও কোনওই সমস্যা হচ্ছে না! জীবনের নৈতিকতা এবং জীবিকার অনৈতিকতার মতো পরস্পরবিরোধী মূল্যবোধ একই মানুষের মধ্যে অনায়াসে সহাবস্থান করতে পারছে! এ রকম মানুষের সংখ্যাই সমাজে বেশি। এরা দিনে দিনে বাড়ছে। এনামুলদের ঘিরে দলে দলে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। অপরাধের সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতার কাঠামোর মধ্যে এনে নৈতিকতা ও অনৈতিকতাকে একাকার করে ফেলেছে।    

আবার ফিরে এলাম এয়াকুবের উঠানের জটলায়। আমার চোখে বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু ও অবক্ষয়ী সমাজের একটি মিনি চিত্র ভেসে উঠলো। আমাকে দেখে এনামুল ডাকলো:
-আয়। খাবি চল।
খাওয়ার কথায় পুরো বাংলাদেশকেই আমার কাছে একটি ঝলসানো মাংসপিণ্ড বলে মনে হলো। যেন একদল লোভাতুর মাংসাশী রাক্ষস সেই খাদ্যের চারপাশে নগ্ন উল্লাসে আদিম নৃত্য করছে!

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭
জেডএম/   

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ