ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

নাব্যতা সংকটে পদ্মায় নৌযান চলাচল ব্যাহত

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২২
নাব্যতা সংকটে পদ্মায় নৌযান চলাচল ব্যাহত

ফরিদপুর: চলতি শুস্ক মৌসুমে ফরিদপুরে পদ্মা নদীতে  নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। এতে পণ্যবাহী জাহাজ,  কার্গো, বলগেট ও বড় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

ফলে ঘাটের প্রায় ৭ হাজার কুলি-শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছেন। এছাড়া দূরদূরান্ত থেকে আসা পণ্যবাহী জাহাজও বন্দরে ভিড়তে পারছে না। ফলে নৌ বন্দরের শুঙ্ক আদায়ও কমেছে। সেই সঙ্গে এসব নৌযান থেকে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে থেকে পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করে। তখন থেকেই এসব নৌযানগুলো নাব্যতা সংকটের কবলে পড়ে সিএন্ডবি ঘাটের বন্দরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই দুরাবস্থা চরমে পৌঁছেছে। নাব্যতা-সংকট রক্ষায় কমপক্ষে ১০/১৫ স্থানে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে খনন জরুরি হয়ে পড়ছে। তবে খনন কাজ পরিকল্পিতভাবে না হলে, অল্পদিনের মধ্যেই নৌ চ্যানেলগুলো নতুন বালু এসে ভারাট হয়ে যাবে বলে ঘাটের  নৌযান মালিকরা মনে করেন।

দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরে পণ্য আনা নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌ বন্দরটি শত বছরের প্রাচীন। ২০১৭ সালে সরকার এটিকে তৃতীয় শ্রেণির নৌ বন্দর হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্নস্থান থেকে নৌ পথে এই বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়। ফরিদপুরের সোনালী আঁশ খ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহিঃবিশ্বে রপ্তানি হয়।
 
এছাড়া সিলেট থেকে কয়লা, চট্টগ্রাম থেকে সিমেন্ট, রাজশাহী থেকে বালু, ভারতের গরু ও চালসহ চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ, কমলঘাট,  মিরকাদিম  থেকে এই নৌ পথেই চাল আমদানি হয়। নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে প্রচুর সিমেন্টবাহী জাহাজ ও কার্গো এই বন্দর থেকে খালাস করা হয়। কিন্তু বর্তমানে নদীতে নাব্যতা না থাকায় এবং অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় এসব পণ্যবাহী নৌযান বন্দরে আসতে পারছে না। যেগুলো মাল খালাস করেছে সেগুলো ঘাটে আটকা পড়ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নৌবন্দরে ভিড়তে না পেরে অনেক দূরে ডিক্রীচর, ভূঁইয়াবাড়ি ঘাট, খুশির বাজার,  পিয়াজখালী ঘাট, হাজিগঞ্জের চরহাজীগঞ্জের এলাকা, চরভদ্রাসনের এমপিডাঙী ও গোপালপুরসহ বিভিন্নস্থানে নদীর তীরে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো  বলগেট ও বড় ট্রলার ভিড়ানো রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের  মেঘনা ঘাট থেকে সিমেন্ট নিয়ে আসা জাহাজের মাস্টার মো. সাকিল সেখ বলেন, চরে এসে ঠেকে গেছি। আমার জাহাজে ১২ হাজার বস্তা সিমেন্ট আনা যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত গভীরতা নেই বলে ৮ হাজার বস্তা এনেছি। ৪ হাজার বস্তা সিমেন্ট কম আনতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফরিদপুর ঘাটে আসতে প্রায় দুই কিলোমিটার চরের অস্তিত্ব মিলছে। ৩ দিনের পথ আসতে ৫ দিন লেগেছে।

তিনি আরও বলেন, এতে আমাদের পণ্যের আগ্রহ কমে গেছে। নৌবন্দরে ভিড়তে পারলে প্রতি বস্তা থেকে ১৪ টাকা করে বাড়তি পেতাম। কিন্তু এখন এই তাড়ার অর্ধেক দিয়ে আরেকটি ট্রলার ভাড়া করে মাল খালাস করতে হচ্ছে। এসব কারণে স্টাফ খরচ এবং অন্যান্য ভাড়াও বেড়েছে। এছাড়া জানমালের নিরাপত্তা নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন, পথে পথে চাঁদাবাজদের হানা।

এমভি শতনীড় নামে আরেকটি জাহাজের মাস্টার মো. কামাল বলেন, নাব্যতা না থাকায়, জাহাজের ইঞ্জিনের পাখা ডুবো চরে ঠেকে সুকান আটকে যায়। এতে চালু অবস্থায় জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়।

তিনি বলেন, অন্তত গড়ে ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু সেখানে কোথাও কোথাও  দুই-তিন হাত পানি রয়েছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে ড্রেজিং করা দরকার। পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং না করলে ফের পলি পড়ে, আবার গভীরতা কমে যায়।

পদ্মায় নাব্যতা ফিরছে না কেন জানতে চাইলে সেখানে ড্রেজিংয়ের কাজে নিযুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, ড্রেজিংয়ের পরপরই আবার নতুন পলি ও বালু এসে ভরে যায়। পানিতে প্রচুর পলি থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ফরিদপুর নৌবন্দরের পণ্য খালাসে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান টাইগার  ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার মো. আ. হাকিম বলেন, প্রায় ৮ হাজার কুলি শ্রমিক এই নৌ বন্দরে কাজ করতো। এর মধ্যে অনেক ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও আছেন। জাহাজ, কার্গো না আসায় তারা বেকার হয়ে পড়ছেন, কাজ পাচ্ছেন না।

পদ্মা ট্রান্সপোর্টের মালিক রহমান জানান, বছরের ৫ মাস এখানে পানি কম থাকে বলে পণ্য খালাসে সমস্যা হয়।

ফরিদপুরের সিএন্ডবি ঘাট থেকে শুল্ক আদায়কারী বিআইডব্লিউটিএ কর্মচারী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বন্দরে জাহাজ, কার্গো, বলগেট, বড় ট্রলার ভিড়তে না পারায় তাদের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে।

তিনি জানান, আগে ঘাটটি ইজারা দেওয়া হতো। তবে এখন সরাসরি বিআইডব্লিউটিএর লোকেরা শুল্ক আদায় করেন।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট একজন পোর্ট অফিসার বলেন, নৌবন্দরটিকে সচল করতে নৌচ্যানেলে ড্রেজিং কাজ চলছে। তবে এই ঘাটটি এখনো পথটি বড় নৌযান চলাচলের উপযুক্ত হয়নি। আশা করছি চলতি মৌসুমেই ঘাট পয়েন্টে  ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করলে এই সংকট কেটে যাবে।

কথা হয় ঘাটের কুলি শ্রমিকদের প্রবীণ নেতা মো. তারা মিয়ার (৬০) সঙ্গে। তিনি জানান, এই ঘাটের ১১টি সেক্টরে প্রায় ৮ হাজার কুলি শ্রমিক ছিল। পদ্মার যৌবন থাকা অবস্থায় এই বন্দরে প্রতিদিন ৩/৪ শত নৌযান ভিড়তো। এখন নাব্যতা-সংকটের কারণে সপ্তাহ ১০/১৫ টি বলগেট ও ৩/৪ টি জাহাজ আসে। কাজ নেই, তাই কমপক্ষে ৭ হাজার  শ্রমিক  বেকার হয়ে পড়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২২
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।