ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

কাজে দেরি হলে খুন্তি দিয়ে খোঁচাত, থুতু ও প্রস্রাব খাইয়ে দিত!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০২২
কাজে দেরি হলে খুন্তি দিয়ে খোঁচাত, থুতু ও প্রস্রাব খাইয়ে দিত! হাসপাতালের বেডে রাবেয়া।

বাগেরহাট: গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঠাঁই হয়েছে রাবেয়া আক্তার ওরফে আকলিমা (১৭) নামে এক কিশোরীর।  

নির্যাতনের শিকার রাবেয়া  বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর বারইখালী গ্রামের সুলতান মোল্লারমেয়ে।

 

শনিবার (০৮ অক্টোবর) বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রাবেয়া জানায়, কাজে দেরি হলেই মোটা লাঠি দিয়ে পেটানো হতো তাকে। চামচ ও খুন্তি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে খোঁচা দিত। শুধু তাই নয় জোর করে থুতু ও প্রস্রাব খাইয়ে দিত। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাও বলতে দিত না।  

এভাবেই সে তার ওপর চলা নির্যাতনের কথা বলতে থাকে।
 
রাবেয়া জানায়, ২০১৫ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে একই গ্রামের জালাল হাওলাদারের মাধ্যমে খুলনার নিরালা এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক এসএম সামছুল হকের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে পাঠায় তার বাবা-মা। সেখানে ৫ বছর কাজ করার পরে রাবেয়াকে সিলেটে সামছুল হকের মেয়ে তানিয়া সুলতানা লাকির কাছে পাঠানো হয়। তিন মাস পরে সেখান থেকে রাবেয়াকে ঢাকার মিরপুরে  ছোট বোন নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় পাঠিয়ে দেয় লাকি। এতদিন ভালো থাকলেও লিজার বাসায় যাওয়ার পরে অমানুষিক নির্যাতন শুরু হয় রাবেয়ার ওপর। তিন বছর নির্যাতন সহ্য করে প্রাণ বাঁচাতে শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ৫ অক্টোবর লিজার ঢাকার বাসা থেকে পালিয়ে মোরেলগঞ্জে বাবার বাড়িতে চলে আসে রাবেয়া। পরে  শুক্রবার (০৭ অক্টোবর) বিকেলে মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় তাকে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাবেয়ার হাত, পা, মুখমণ্ডল, ঘাড়-পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বলও সে।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শর্মী রায় বলেন, ওই কিশোরীর সারা শরীরেই ক্ষতচিহ্ন আছে। এগুলো বেশ পুরাতন। সার্প কাটিং কোনো ক্ষত নেই। সবই ব্লাংক হুইপেন (লাঠি বা এই ধরনের কিছু) দিয়ে আঘাতের চিহ্ন বলে মনে হয়েছে। সে দুর্বলতা ও শরীরের ব্যথার কথা বলেছে। এখন শারীরিকভাবে সে ভালো আছে। তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

হাসপাতালের বিছানায় বসে নির্যাতনের শিকার রাবেয়া বলে, সামছুল হক স্যার ও তার বড় মেয়ে সবাই ভালো ছিল। কিন্তু তার ছোট মেয়ে অন্যরকম। প্রতিটা কাজে সময় বেঁধে দিত। একটু দেরি হলে বা ভুল হলেই মারধর, বকাবাকি করত। একদিন ওয়ারড্রপের ওপর টিকটিকির মল পাওয়ায় আমাকে মুখ দিয়ে পরিষ্কার করায়।  

আমার মা মারা গেলেও বাড়ি আসতে পরিনি। ওই ম্যাডামের স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর মাহফুজুর রহমান স্যারের পোস্টিংয়ের কারণে সৈয়দপুর, ঘাটাইল, সাভার, রংপুর হয়ে ঢাকার বাসায় কাজ করছি। কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হত না। পেটে ভাতে কাজ করতাম। বড় করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে এমন কথা বলে অনেক ছোট বেলায় বাড়ি থেকে কাজে পাঠানো হয়েছিল।

রাবেয়া আরও বলে, আমাকে প্রচুর মারধর করত। লাঠি, খুনতি দিয়ে পেটাত। দেওয়ালে মাথা টাক (আঘাত) দিত। সব সময় একটা ভয়ে থাকতাম।  নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে আমি পালায় আসছি। আমি আর কিছু চাই না, আমার সাথে যা হয়েছে এমন যেন আর কারো এমন জীবনে না হয়। আমার মা নেই। মায়ের শেষ স্মৃতি একটা নাক ফুল আছে ওই বাসায়। আপনারা আমাকে ওইটা এনে দেন বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাবেয়া।
 
রাবেয়ার বড় বোন হামিদা বেগম বলেন, বাবার দুই বিয়ে। প্রথম ঘরে আমরা চার বোন। পরের ঘরে ৭ বোন দুই ভাই। অভাবের কারণে ওকে কাজ দেই। বছরে এক দুই বার কথা হত। আমরা জানতামও রংপুরে আছে। ঢাকায় আছে এই কথা আমাদের জানানো হয়নি।

রাবেয়ার চাচা কাঞ্চন মোল্লা বলেন, ওর বাবা এখন মৃত্যু শয্যায়। গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওর বাবার কাছে ফোন করে বলা হয় রাবেয়া ঢাকার বাসা থেকে পালাইছে। কিন্তু তার আগে আমাদের জানানোইহয়নি মেয়েটা ঢাকায় তাকে। মেয়ে বাড়িতে আসলে, আমরা ওসি সামছুল হক স্যারকে জানাই। তিনি এসে চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন এবং আরও ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি এমন নির্যাতনের বিচার চাই।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক সামছুল হক বলেন, ‘রাবেয়া আমার মেয়েরবাসা থেকে অনেক মালামাল নিয়ে গত বুধবার পালিয়ে গেছে। মিরপুর থানায় জিডি করা হয়েছে। আপনারা শিগগিরই মোরেলগঞ্জ থানার মাধ্যমে মেইল পেয়ে যাবেন।  

এছাড়া আমার মেয়ে রাবেয়াকে মারধর করেছে তাই মানবিক কারণে মোরেলগঞ্জে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০৪8 ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।