ঢাকা, শনিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

পদ্মা সেতু: ঝালকাঠির কৃষকের স্বপ্নের দ্বার উন্মোচন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০২২
পদ্মা সেতু: ঝালকাঠির কৃষকের স্বপ্নের দ্বার উন্মোচন

ঝালকাঠি: পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর উন্মুক্ত হয়েছে ঝালকাঠির সঙ্গে সড়কপথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের সবকটি বাণিজ্যিক পথ। বিশেষ করে জেলার কৃষি খাতে ঘটতে শুরু করেছে বিপ্লব।

এমনটাই স্বপ্ন দেখেছিলেন ঝালকাঠির সবজি চাষিরা। স্বপ্নের দ্বার উন্মোচিত হওয়ায় কৃষকরা পাচ্ছেন তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য। তাই কৃষকের চোখে-মুখে এখন হাসির ঝিলিক।  

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জেলায় ২০২১-২২ অর্থ বছরে বোরো ধানের উৎপাদন ৫১ হাজার ৮২৯.৪৫৮ মেট্রিক টন। শীতকালীন সবজি ৮ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৬০.৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় জেলায় দক্ষিণাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য অর্থকরি ফল হিসেবে প্রায় ৮শ হেক্টর জমিতে প্রায় ৯ হাজার মেট্রিক টন আমড়া উৎপাদন হয়। পাশাপাশি প্রায় ৯শ হেক্টর জমিতে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদন হয়।  

এছাড়া ১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন নারিকেল উৎপাদন হয়। সরিষা ২২২.৭৫ মেট্রিক টন, গম ৪৭৮.৫ মেট্রিক টন, ৫ হাজার ৪ মেট্রিক টন ভুট্টা, ১২ হাজার ৮১২ মেট্রিক টন ডাল উৎপাদন হয় জেলায়। উৎপাদিত এসব সবজি, ধান ও রবি শষ্য স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রির সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে পাইকারদের কাছে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতে হতো কৃষকদের। কিন্তু এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যার সমাধান হওয়ায় কৃষকরা অধিক লাভবান হচ্ছে।  

কৃষকরা জানায়, সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের এসব কৃষিপণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। সেখান থেকে সরাসরি চলে যাবে চাহিদা ভিত্তিক অঞ্চলে।  

ঝালকাঠির সবজি সমৃদ্ধ এলাকা গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের গাভা গ্রামের কৃষক মো. জালাল হোসেন, তেরআনা গ্রামের নূর আলম ও হোসেনপুর এলাকার কৃষক সুজন হাওলাদার জানান, বছরের বারো মাস কৃষির ওপর নির্ভরশীল তাদের জীবন জীবিকা। বিশেষ করে সবজির পাশাপাশি ধান আবাদও হয় প্রচুর। এসব সবজির মধ্যে কাঁচকলা, কাঁচামরিচ, কুমড়া, নারিকেল, আমড়া, পেয়ারা উল্লেখযোগ্য।  

ধান আবাদের চেয়ে সবজি আবাদ করে বেশি লাভবান হওয়ায় তারা অনেকেই এখন ক্রমান্বয়ে সবজি চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। সেতুর কারণে পাইকারদের কাছে সবজির দাম বেশি পাচ্ছেন। কারণ এখন তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে। আগে এ ইউনিয়নের উৎপাদিত কৃষিজাত মালামাল পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাপিয়ে বরিশাল পর্যন্ত যেত। এখন ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে তা ঢাকায় সরবরাহ করে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে পাইকাররা কৃষকের কাছ থেকে এসব পণ্য দ্রুত কিনে ঢাকা সরবরাহ করতে পারবে। এতে করে এখন তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য নিয়ে পচনের চিন্তা করতে হবে না। দামও ভালো পাবার আশা কৃষকদের।
সদর উপজেলার সবজি আবাদের ডিপো বলে পরিচিত নবগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক হরিপদ, সনজীব হালদার, কৃর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের কৃষক স্বপন দাস, শাহজাহান মোল্লা, সনজয় চক্রবর্তী ও বিনয়কাঠি ইউনিয়নের কৃষক জামাল খলিফা ও শাহআলম খলিফার কাছে প্রশ্ন ছিল পদ্মা সেতু চালু হলে আপনাদের জীবন যাত্রা ও জীবিকায় কি প্রভাব পরবে। জবাবে এরা জানালেন, ধান, পাট, গমের পাশাপাশি সবজি বিশেষ করে কাকরোল, ঢেঁড়স, আলু, শাক, লাউ, কচু, করোল্লা, পাতাকপি, ফুলকপি, বেগুন, টমেটো, লেবু ইত্যাদি তাদের এলাকার কৃষিজাত উৎপাদিত শষ্য।  

এসব পণ্যের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। দ্রুত পচনশীল এসব সবজি হিমাগারে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই জমি থেকে তুলে এনে স্বল্প মূল্যে এতোদিন পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হতো। এসব সবজি পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়া বিক্রি করা যেত না। এখন পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ৩ ঘণ্টার মধ্যে পাইকাররা সবজি নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারছেন। এর আগে তাদের ঢাকা যেতে ফেরিতেই সময় লাগত ৩ ঘণ্টা।  

তারা আরও জানান, এতোদিন তাদের এলাকার আমড়া ও পেয়ারা ১ দিন পর ঢাকা যেত। এখন পদ্মা সেতু পার হয়ে মাত্র ৩ ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে যাচ্ছে দিনেই।

ঝালকাঠি জেলার প্রত্যন্ত উপজেলা কাঠালিয়ার পাটিখালঘাটা ইউনিয়নের কৃষক সুমাইয়া রুবি, মাহাতাব উদ্দিন ও আজাদ হোসেন পদ্মা সেতুর সুবিধা প্রসঙ্গে বলেন, আগে আমাদের উপজেলা থেকে শুধু দূরবর্তী রুটের যাত্রীবাহী বাস চলাচল করতো। এখন সরাসরি ঢাকা থেকে পাইকাররা ট্রাক নিয়ে দিনে দিনে আমুয়া, বরগুনা ও কাঠালিয়া চলে আসবে। ট্রাকে এলাকার কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে ধান, চাল, ভুট্টা, সরিষাসহ রবিশষ্য নিয়ে দিনে দিনে ঢাকায় ফিরে যাবে। যা এতোদিন স্থানীয় বাজারে সামান্য কিছু বিক্রি হয়ে বেশির ভাগ অবিক্রিত থেকে যেত।  

কাঠালিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. বশির জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্মলহোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্টের (এসএসিপি) মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিপণ্য ঢাকায় বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করে কৃষকদের সমিতির মাধ্যমে ঢাকায় বিক্রি করা হবে। এতোদিন পদ্মা সেতু না হওয়ায় এটি সম্ভব ছিল না বলে জানালেন এই মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা।  

ঝালকাঠির সবজি এলাকা বাউকাঠি, জগদীশপুর, ডুমুরিয়া ও ভীমরুলীর পাইকার অমল হালদার, পলাশ মণ্ডল, বিমল হালদার জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আমরা ঢাকার কারওয়ান বাজার, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন আড়তে যোগাযোগ শুরু করেছি। তারা জানিয়েছেন ট্রাকে সবজি নিয়ে এলেই সঙ্গে সঙ্গে বিক্রির টাকা দেওয়া হবে। তবে ভোর ৫টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। যা এখন বাস্তবে সম্ভব।  

এছাড়া বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লেবু, পেয়ারা এবং আমড়া নিয়ে সরাসরি ঢাকায় বিক্রি করা সম্ভব। পাইকাররা জানান, আগে এসব ফল নিয়ে ট্রলারে বরিশাল সেখান থেকে লঞ্চে উঠিয়ে ঢাকায় পাঠাতে খরচ পড়ে যেত। এখন এক ট্রাকে বেশি নিয়ে যেতে খরচ কমছে। এতে চাষিদের আমরা দামও বেশি দিতে পারতেছি।

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম পদ্মা সেতুর সুফল বিষয়ে বলেন, এ সেতুর প্রভাবে ঝালকাঠিতে কৃষি বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটবে। কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন তরান্বিত হবে। এর ফলে দ্রুত কৃষকের উৎপাদিত পণ্য দেশের সব বাজারে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। ফেরির অপেক্ষায় কৃষি পণ্য নষ্ট ও সময় ক্ষেপন হবে না। কৃষকের নগদ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। বাকিতে পাইকারের কাছে বিক্রি করতে হবে না। বিশেষ করে সবজি, আমড়া ও পেয়ারার বাজার তরান্বিত হয়েছে।

পদ্মা সেতু চালুর পর ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদী তীরে গড়ে ওঠা পর্যটন এলাকা ছৈলারচর হতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় স্পট। এমনটাই মনে করেন জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী।  

একই সঙ্গে তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, ঝালকাঠির ব্র্যান্ড পণ্য শীতলপাটি ও পেয়ারা চাষিদের এতো দিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচন হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। কারণ বিশ্বের সব পর্যটকরা এখন সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে ঝালকাঠি এসে ছৈলার চরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। একই সঙ্গে সরাসরি ন্যায্যমূল্যে বেশি করে কিনে নিতে পারবে ঝালকাঠি পাটিকরদের হাতে তৈরি শীতলপাটি। সেই সঙ্গে পদ্মা সেতুর প্রভাবে এ জেলায় ঘটে যাবে কৃষি বিপ্লব। সেতুর কারণে চাহিদা অনুযায়ী জেলার কৃষিপণ্য বিশেষ করে সবজি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।