ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

মৃৎশিল্পে আশার আলো, সহজে ঋণ চান কুমোররা

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৯ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২২
মৃৎশিল্পে আশার আলো, সহজে ঋণ চান কুমোররা

বগুড়া: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর অন্যতম ‘মৃৎশিল্প’। এটি শুধু শিল্প নয়, আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক।

আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক অনেক গভীর। ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মাটি আর ‘শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তবে নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনও হাজারও মানুষ এই শিল্পকে ধরে রেখেছেন।

বৃহস্পতিবার (০৯ জুন) বগুড়া সদর, গাবতলী, শাহজাহানপুর, কাহালু ও শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় মৃৎশিল্পীদের নানান কর্মযজ্ঞ। এসব এলাকায় কয়েক হাজার মৃৎশিল্পী বসবাস করেন। অভাবের সঙ্গে আপোষ না করে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প ভালোবেসে আজও কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

প্রতিদিন কাক-ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কুমোর পল্লীতে চলে নারী-পুরুষের কর্মযজ্ঞ। বংশ পরম্পরায় এ পেশাকেই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ধরে রেখেছেন মৃৎশিল্পীরা। তারা এ শিল্পেই টিকে থাকার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

গাবতলী উপজেলার মহিষাবান পালপাড়া এলাকার রমেশ পাল বাংলানিউজকে বলেন, মাটির যে কোনো পণ্য তৈরির পূর্বে কাদা প্রস্তুত করতে হয়। এরপর পণ্যের মাপ বুঝে কাদা চাকার মাঝখানে রাখা হয়। পণ্যের পুরো অবয়ব ফুটে ওঠা পর্যন্ত ঘুরতে থাকে চাকা। সঙ্গে চলতে থাকে হাতের কারিশমা। চাকা ঘুরতে ঘুরতে একসময় নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় শিল্প। এরপর তৈরি পণ্য শুকাতে হয়।

তিনি বলেন, শুকানো শেষ হলে পণ্যগুলো স্তূপ আকারে সাজানো হয়। এরপর চুল্লিতে তৈরি পণ্যগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়। শেষে করা হয় পরিষ্কার। ধরন বুঝে পণ্যের গায়ে রঙ মাখাতে তুলির ছোঁয়া লাগে। এরপর সেগুলো প্যাকেটজাত করা হয়। পরে তৈরি পণ্য বাজারে তোলা হয়। এর মধ্যে অনেক পণ্য অর্ডার অনুযায়ী বাড়ি থেকে নিয়ে যান ক্রেতারা। আবার অনেক পণ্য ব্যবসায়ীর ঠিকানায়ও পৌঁছে দেওয়া হয়।

তন্ময় পাল, রঞ্জিত পালসহ একাধিক মৃৎ শিল্পী বাংলানিউজকে জানান, বেঁচে থাকতে হলে কিছু একটা করতে হয়। তাই বংশ পরম্পরায় বাপ-দাদার কাছে শেখা মাটির সামগ্রী তৈরির কাজ করছেন তারা। আগের সুদিন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। একসময় এ শিল্পের মূল্য ছিল। বর্তমান যুগে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাদের কাজের চাপ অনেকটাই কম। ফলে এ পেশার মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

তারা আরও জানান, ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে দিশেহারা হয়ে পরেন মৃৎশিল্পীরা। গত দুই বছর বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠান না হওয়ায় হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের। তবে এ বছর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠানে তৈরি পণ্য বিক্রি করতে পারছেন। ফলে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছেন তারা।

শাহজাহানপুর উপজেলার ডেমাজানি পালপাড়া এলাকার চৈতন্য পাল ও রবিন পাল বাংলানিউজকে জানান, তাদের বয়স ৬০ পেরিয়েছে। বাবা-ঠাকুরদার কাছ থেকে এ কাজ শিখেছেন। অন্য কাজ শেখা হয়নি। তাই মাটির সামগ্রী তৈরির কাজ করছেন।

তারা বলেন, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, থালা-বাসন, পুতুল, খেলনা, সুরাই, মঠক, সানকি, কড়াই পেয়ালা, দইয়ের সরা, ছাইদানি, ফুলদানি, মূর্তি, পাখি, ফুল, ফল, শো-পিস, ঠিলা, পিঠা তৈরির নানা ধরনের তৈজসপত্র ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মানুষের বাসাবাড়িতে আগে খুব বেশি শোভা পেত। অতীতে মানুষের কাছে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের কদর ছিল ব্যাপক। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন এসব জিনিসের ব্যবহার ব্যাপক হারে কমেছে।

তারা আরও বলেন, বর্তমানে দইয়ের সরা ও হাঁড়ি-পাতিলের কদর কমেনি বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর তাতেই আশার আলো দেখছেন জেলার কুমোর শিল্পীরা। কারণ বগুড়া দইয়ের জন্য খ্যাত। প্রতিদিন শতশত মণ দই তৈরি হয় এ জেলায়। দই সাধারণত মাটির তৈরি এসব পণ্যে রাখা হয়।

এদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কাটিয়ে বর্তমানে নববর্ষসহ বিভিন্ন মেলা চলমান রয়েছে। এ কারণে এখন মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। এ সময়গুলোতে মাটির তৈরি থালা-বাসন, খেলনা, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, মাছ, আম, কাঁঠাল, পুতুল, ব্যাংক, খুঁটি, মালসাসহ নানা ধরনের সামগ্রী বেশ ভালো বিক্রি হয়। দামও ভালো পাওয়া যায়। আর এতেই মৃৎ শিল্পীরা এ শিল্পকে নিয়ে এখনও আশার আলো দেখছেন।

তবে তাদের সামনে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থ। সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ দিতে চায় না। সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পাওয়া গেলে গ্রামবাঙলার ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এ শিল্পকে এখনও ভালোভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২২
কেইউএ/এনএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।