ঢাকা, বুধবার, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৫ মে ২০২৪, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ধসে গেছে তিস্তার বাঁধ, হুমকির মুখে হাজারও বসতঘর

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২২
ধসে গেছে তিস্তার বাঁধ, হুমকির মুখে হাজারও বসতঘর

লালমনিরহাট: গত বছর সংস্কার করা বাঁধ চলতি বছর বন্যার আগেই ধসে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে লালমনিরহাটের ভূমি অফিসসহ তিস্তাপাড়ের হাজারও বসতবাড়ি।

জানা গেছে, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারীর কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা নদীর পানি।

যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশে যায়। দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।  

ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে শীতের আগেই বাংলাদেশ অংশে মরুভূমিতে পরিণত হয় তিস্তা। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্ট হয়। বন্যায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিস্তার বাম তীরের জেলা লালমনিরহাট।

তিস্তা নদী জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় পলি পড়ে ভরাট হয়েছে নদীর তলদেশ। ফলে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে বর্ষাকালে উজানের ঢেউয়ে লালমনিরহাটসহ পাঁচটি জেলায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। এ সময় নদী ভাঙনও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে চর জেগে ওঠে। আর বর্ষায় লোকালয় ভেঙে তিস্তার পানি প্রবাহিত হয়। ফলে বসতভিটা ও স্থাপনাসহ ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলিন হচ্ছে। নিঃস্ব হচ্ছেন তিস্তাপাড়ের মানুষজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) লালমনিরহাট প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে বরাদ্দ দিলেও কাজ শুরু করেন বর্ষাকালে। যা সামান্যতে পানির স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্ষার অথৈ পানিতে জরুরি কাজের নামে বরাদ্দ দেওয়া এসব সরকারি অর্থ কোনো কাজে আসছে না নদীপাড়ের মানুষের।

গত বছর বন্যার সময় লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ গ্রামে নির্মিত বাঁধ সংস্কার করতে জিও ব্যাগ (বালি ভতি বিশেষ ব্যাগ) ডাম্পিং করে পাউবো। যা গত বন্যা পরবর্তীকালে কাজটি সমাপ্ত করা হয়। চলতি বছর বন্যা আসার আগেই গত ০৬ মে মধ্য রাতে ৩০ মিটার বাঁধ ধসে যায়। পরে স্থানীয়রা বালুর বস্তা ফেলে কোনো রকম রক্ষা করে।

স্থানীয়রা জানান, গত বছর বন্যার শেষ দিকে পাঁচ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত করলেও তাড়াহুড়ো করে মাত্র চার হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে। বাকিসব জিও ব্যাগ তিস্তার চরাঞ্চলেই বালুচাপা পড়ে রয়েছে। রাতে আঁধারে জরুরি কাজের অজুহাতে নামমাত্র কাজ করে চলে যায় পাউবো। ফলে এ বছর বন্যা না আসতেই বাঁধটি প্রায় ৩০-৪০ মিটার এলাকা ধসে যায়। নিজেদের বসতভিটা রক্ষায় রাতেই স্থানীয়রা বালুর বস্তা ফেলে কিছুটা রক্ষা করেছেন। এটি ভেঙে গেলে খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন ভূমি অফিস ভবন, খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি), উচ্চ বিদ্যালয় ও খুনিয়াগাছ বাজার তিস্তায় বিলীন হবে। এসব স্থাপনা নদী তীর থেকে মাত্র দেড় ২০০ গজ দূরে।

বাঁধটির পাশে বসবাস করা আব্দুর রউফ (৭০) বাংলানিউজকে বলেন, গত ০৬ মে মধ্য রাতে হঠাৎ বাঁধটি ধসে যায়। পরে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় কিছু বালুর বস্তা ফেলে আমার বাড়িটি আপাত রক্ষা করেছি। খবর দিলে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ পাউবো লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী এসে দেখে গেছেন। জিও ব্যাগ ফেলে সংস্কার করার কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি নেই। শুষ্ক মৌসুমে কাজ না করে বন্যার সময় বরাদ্দ নিয়ে তারাহুড়া করে নাম মাত্র কাজ করে যাবে। যা আবারও ধসে যাবে। এভাবেই তারা সরকারি অর্থ লোপাট করে। ধসে যাওয়া স্থানে ৫-৬ মাস আগে কাজ করেছে। যা আবার বন্যা না আসতেই ধসে গেছে। তাহলে বুঝেন কাজের মান কেমন হয়েছে?

একই এলাকার আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, বাঁধ থেকে মাত্র দেড়-২শ’ গজ দূরে সরকারি অফিস, স্কুল ও হাট-বাজার। নদীর পানি আর একটু বাড়লে ধসে যাওয়া স্থান দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে। তখন সরকারি ভবন, স্কুল আর হাট-বাজারসহ হাজার হাজার বসতভিটা বিলিন হবে। তাই দ্রুত বাঁধটি সংস্কার করা দরকার। এসও এসে বলে জিও ব্যাগ প্রস্তুত আছে। নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশ ছাড়া জিও ব্যাগ ফেলা যাবে না। সেই প্রকৌশলী আবার ফোন ধরে না। সবকিছু বিলিন হলে বাঁধ দিয়ে কী লাভ? শুষ্ক মৌসুমে কাজ না করে বন্যার সময় বস্তা ফেলেই বা কী লাভ? প্রশ্ন তুলেন তিনি।

এসব ছোট ছোট বাঁধ না দিয়ে তিস্তা নদী ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষায় ভিন্ন দাবি তুলেন ওই গ্রামের আব্দুর রশিদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রাস্তা না পেলে পানিতো নদীর পাড় ভেঙে প্রবাহিত হবেই। তিস্তা নদীতো কখনই খনন করা হয়নি। তাই নদীটি খনন করে দুই তীরে বাঁধ নির্মাণ করলে একদিকে যেমন বন্যা আর ভাঙন থেকে রক্ষা হবে, তেমনি হাজার হাজার একর জমি চাষাবাদে আসবে এবং প্রতি বছর এসব বাঁধ সংস্কার ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকারি অর্থও বেঁচে যাবে। তাই তিস্তা খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়ে বাঁধটি পরিদর্শন করেছি। দ্রুত সংস্কার করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাটকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

পাউবো লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বাঁধটির ধসে যাওয়া স্থান পরিদর্শন করে পুনরায় সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আশা করি, আসন্ন বন্যার আগেই সংস্কার করা হবে। গত বন্যা পরবর্তীকালে সংস্কারের পর এ বছর বন্যার আগেই ধসে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, নদীর কাজ এমনই। পানির স্রোতে বিলিন হতে পারে। মাটির নিচেও ধসে যেতে পারে।  

কাজে কখনই গাফলতি ছিল না বলেও জোর দাবি করেন এই নির্বাহী প্রকৌশলী।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২২
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।