ঢাকা, রবিবার, ৩০ ভাদ্র ১৪৩২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

বিশেষ লেখা

নেপাল-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের মিল-অমিলের পোস্টমর্টেম

মোস্তফা কামাল। সৌজনৌ: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৯:৪৭, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫
নেপাল-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের মিল-অমিলের পোস্টমর্টেম মোস্তফা কামাল।

প্রায় একই স্কেলে নেপাল-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশে দুঃশাসকের পতনসহ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। ঘটনাপ্রবাহ কাছাকাছি।

কিন্তু শাসনতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় নেপাল-লঙ্কার সঙ্গে ব্যাপক তফাত বাংলাদেশের। দেশ দুটিতে বাংলাদেশের মতো সংস্কার, ঐকমত্য, মব-গুজব, আন্দোলনকারী ফ্রন্টফিগারদের নানা ক্রিয়াকর্মের ক্যারিকেচার পর্ব নেই।

আগে সংস্কার না নির্বাচন বিতর্ক বাধেনি। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় বা ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বাহাসও জমেনি। সংস্কারের নামে প্রশাসনে রদবদলের হিড়িক, মিল-কলকারখানায় হামলে পড়ার সিরিজও দেখতে হয়নি। লাইফ সাপোর্টে চলে যায়নি তাদের অর্থনীতি।

শঙ্কিত হতে হয়নি তাদের ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের।
শুক্রবার অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কার্কির শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নেপালের পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা। একই ফরমানে আগামী বছরের ৫ মার্চ নির্বাচনের তারিখ জারিও করেন সুশীলা কার্কি। এর আগে দুর্নীতিবিরোধী সহিংস আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের পর সব পক্ষ মিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সুশীলা কার্কিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয়।

বাংলাদেশের মতো আন্দোলনকারীরাই তাঁকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তাব দেন। সুশীলা কার্কি এর আগে ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত নেপালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সততা, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ও দৃঢ়তার কারণে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। সপ্তাহজুড়ে জেন-জি প্রজন্মের চলা বিক্ষোভের জেরে সরকার পতন ও নতুন সরকারের অভিষেকসহ এসব আনুষ্ঠানিকতা ঘটে দ্রুততার সঙ্গে। দেশ কাঁপানো অভ্যুত্থানের পর শ্রীলঙ্কায়ও এ কাজগুলোতে কোনো সময়ক্ষেপণ হয়নি।

জমেনি অভিনন্দন জানানোর মহড়া। নিন্দা ও বিবৃতি বলে যে একটা ব্যাপার আছে তা যেন নেপালের নয়া সরকার জানেই না।
এ সময়টাতে বাংলাদেশে টানা তিন দিন চলেছে জাকসু নির্বাচনে ভোট গণনার বিরক্তিকর আবহ। নেপালের এক প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে, নতুন সরকারও চলে এসেছে। জাতীয় নির্বাচনের তারিখও দিয়েছে। ভারতের জেট এয়ারওয়েজের চাক্কা আকাশ থেকে খুলে পড়ার পর তা খুঁজে পাওয়া গেল এবং তা আবার প্লেনে প্লেনে এনে লাগানোও হলো। চায়নায় এক নতুন সংক্রামক দেখা দেওয়ায় তারা তিন দিনে সেটার প্রতিষেধকও এনে ফেলেছে। তখন পর্যন্তও আমাদের জাকসু নির্বাচনের ফলাফল আসেনি। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করা যায়নি। ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বলতে হচ্ছে, দুনিয়ার কেউ এ নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না।  

শ্রীলঙ্কায় বিপ্লবের কয়েক দিনের মধ্যে সেখান থেকে দুর্নীতি অনেকটা ‘নাই’ হয়ে গেছে। দেশটিতে মিছিল-মিটিংসহ উত্তেজনা চলতে থাকলেও কোনো মিল-ফ্যাক্টরিতে হামলা, কোনো দোকানপাট দখলের তথ্য নেই। মব বলতে কিছু হয়নি। অথচ চরম রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। দায়িত্ব নেওয়ার দিনই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগামী বছরের ৫ মার্চ দেশটিতে হবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন। জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে গত মঙ্গলবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগের পর দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট সাংবিধানিক সংকটকে বেশিক্ষণ পোক্ত করতে পারেনি।  সংকট সমাধানে বিক্ষোভকারী তরুণদের প্রতিনিধিরা দফায় দফায় বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট পৌদেল ও সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেলের সঙ্গে। দ্রুত ফয়সালাও বের করে ফেলেন। ছয় মাসের মধ্যেই নির্বাচন নিশ্চিত করা, সংবিধান সমুন্নত রাখতে এবং জাতীয় ঐক্য এগিয়ে নিতে শর্টকোর্স পন্থা নেন তাঁরা। অন্য কোনো বিষয় সামনে এনে জটিলতা পাকাননি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণু’ অবস্থান নিয়ে আলোচিত ছিলেন সুশীলা। ওই অবস্থানের কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন বিক্ষোভকারী তরুণরা। বাড়তি কোনো দফারফা বা এটা আগে, সেটা পরে—এ ধরনের কোনো পথই মাড়াননি। গুণগতভাবে তা বাংলাদেশের একদম বিপরীত। অবশ্য নেপালে দুর্নীতি কম, টাকা পাচার কম, স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দখল নেই বললেই চলে। স্থানীয় নির্বাচন, ছাত্রসংসদ নির্বাচন, প্রশাসনের পদপদবি ভাগাভাগীর দুষ্টক্ষত আমাদের মতো নয়। নির্বাচন দ্রুত হলে লাভ বেশি না পরে হলে সুবিধা বেশি—এ ধরনের বিষয়ে বহুমত-বহুপথের বালাইও নেই। তাই নির্বাচনের প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়েছে। আর নেপালের ‘জেন-জি’ তরুণরা নতুন প্রধানমন্ত্রীর শপথের দিনই জাতীয় নির্বাচনের তারিখ আদায় করে বিচক্ষণতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের ‘জেন-জি’ তরুণরা এ প্রশ্নে বিপরীত। রাজনৈতিক দলগুলোও বিভক্ত।

নেপালেও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সুশীলাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী করতে সমঝোতায় পৌঁছা একদম সহজ ছিল না। এ নিয়ে মত-দ্বিমত ছিল। তবে সব মতপার্থক্য ছাপিয়ে তাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত ও শপথ নেওয়ার কাজটি তারা দ্রুত সম্পন্ন করেছে। একদিকে চলে তাঁর শপথ ও দায়িত্ব নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা, অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক করার আয়োজন। তা কার্যকর ফল দিয়েছে। এর আলোকে কারফিউ তুলে নেওয়া হয়, কাঠমাণ্ডুর জনজীবনে স্বাভাবিকতার ছন্দ ফেরে কম সময়ের মধ্যে। নেপালের পর এবং বাংলাদেশের ঘটনার আগে শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনাও ছিল শিক্ষণীয় ঘটনা।

প্রায় দেউলিয়া হতে বসা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার সার্বিক পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। মাঝে কিছু জটিলতা পাকলেও খাদ্য ও জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ঊর্ধ্বমুখী। বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত দেশটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল, তার ৭৫ শতাংশ এরই মধ্যে ফেরত দিয়েছে। অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণও একটু একটু করে পরিশোধ করে দিচ্ছে তারা। এ অবস্থায় প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নেপালের স্বাভাবিকতায় ফেরা, শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর নেপথ্য কারণ ও নীতিগুলো বাংলাদেশের জন্য পাঠপঠনের বিষয়। শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি তাদের পরিস্থিতির এমন নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এর পাশাপাশি করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে পর্যটন খাতের ঘুরে দাঁড়ানো, কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়টিও ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকারের নেপাল-বাংলাদেশের মতো অপশাসকের সরকারের মতো চরম নাস্তানাবুদের পর শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে। ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের ভরসা দিতে পেরেছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও সংহত হয়েছে। ফলে সরকার কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনস্বার্থের বিষয়টিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ সেখানে তৈরি হয়েছে। এই জায়গাটিতে দেশটির সাধারণ জনগণও সচেতন। নেপালের জনগণের মধ্যেও সেই ছাপ লক্ষণীয়।

নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালে একটি চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরপরই সেখানে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণ জানে সামনে কী আসছে, তাই আন্দোলনের মঞ্চ থেকে তারা খুব দ্রুত নির্বাচনী মাঠে চলে গেছে। বাংলাদেশে সেই বাস্তবতার ঘাটতির কারণে শুধু নির্বাচন ঘিরে নয়, সরকার কাঠামো নিয়েই বড় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। বৈষয়িক লাভালাভ নিয়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঘেরাটোপ ব্যাপক। এর অনিবার্যতায় নেপাল বা শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশে আন্দোলনকারীরা মাঠ ছেড়ে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারেনি। পারছে না আন্দোলন ও নির্বাচনের মধ্যে একটি প্রাতিষ্ঠানিক সেতুবন্ধ তৈরি করতেও। তারও পর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ঘিরে নানা প্রশ্ন সব সময় থেকেই যায়। জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এসব প্রতিষ্ঠান তেমন নিরপেক্ষ বলে মনে হয় না। বিপরীতে নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কায় অন্তত ন্যূনতম আস্থার জায়গা বিদ্যমান। এত বড় একটি বিপ্লব স্কেলের আন্দোলনের পরও এখানে রাজনৈতিক বিভাজন বুনিয়াদের মতো চেপে রয়েছে। এখানে সমঝোতার চেয়ে মুখোমুখি সংঘাত প্রবণতা বেশি প্রবল। তাই আন্দোলনের পরপরই নির্বাচনকে তারা মুখ্য করতে পারেনি। নেপাল-শ্রীলঙ্কা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বমুক্ত নয়। কিন্তু সেখানে অন্তত এই বিষয়ে ঐকমত্য ছিল যে জনগণের ভোটই হবে চূড়ান্ত সমাধান। নেপাল-শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, সংকট যত গভীরই হোক, দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও স্থিতিশীলতায় আস্থা থাকলে সাধারণ জনগণও খুব দ্রুত ভোটের মাঠে নেমে পড়ে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।